প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যবই প্রস্তুত হলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই পেতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হবে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত।
Published : 30 Dec 2023, 12:18 AM
বছরের শুরুর দিন শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়ার রীতিতে কোভিডকালে যে ছেদ পড়েছিল, তা থেকে এবারও বের হতে পারছে না জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবি।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের পাঠ্যবই প্রস্তুত হলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই পেতে শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করতে হবে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত।
এনসিটিবি বলছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে সময় লাগায় বই মুদ্রণে যেতে দেরি হয়েছে। এ দুটি শ্রেণিতে আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হবে। ফলে তৈরি করতে হচ্ছে একেবারে নতুন বই।
২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুর পর পাঠ্যবই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনায় পড়তে হয়েছে এনসিটিবিকে। এবার সে বিষয়টি মাথায় রেখেই বাড়তি নজর দিতে গিয়ে পাণ্ডুলিপি ছাপাখানায় পাঠাতে দেরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন কর্মকর্তারা।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম আশা করছেন, ১০ জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীরা সব বই হাতে পাবে। তবে সব বই প্রস্তুত হতেই জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যাবে বলে জানাচ্ছেন ছাপাখানা মালিকরা।
২০১০ সালে বছরের প্রথম দিন উৎসব করে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া শুরু করেছিল সরকার।
মহামারীর কারণে ছাপার কাজ শেষ না হওয়ায় ২০২১ সালে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে বই পায়নি। ২০২২ ও ২০২৩ সালেও সব বই পেতে অনেক শিক্ষার্থীকে মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭টি বই বিতরণ করবে এনসিটিবি। এর মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় অষ্টম শ্রেণিতে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ও নবম শ্রেণিতে ৫ কোটি ৬ লাখ বই বিতরণ করা হবে।
এ পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণির ৭০ শতাংশ ও নবম শ্রেণির ৫৫ শতাংশ বই প্রস্তুত করে পাঠানো হয়েছে বলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “যে কয়দিন আছে, নবম শ্রেণির বই চলে যাবে। নবম শ্রেণির কাজ যেসব প্রেস পেয়েছে, তাদের দৈনিক ১০-১৩ লাখ করে বই ছাপানোর ক্যাপাসিটি রয়েছে। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির বই উপজেলায় পৌঁছাতে সাত থেকে দশ দিন বেশি সময় লাগতে পারে।”
তবে আরআর প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের স্বত্বাধিকারী জহুরুল ইসলাম জানান, কার্যাদেশ অনুযায়ী নবম শ্রেণির বই ২৪ জানুয়ারি ও অষ্টম শ্রেণির বই ১৩ জানুয়ারির মধ্যে দেওয়ার কথা তাদের।
পাণ্ডুলিপি দেরিতে পাওয়ার কথা জানিয়ে মোল্লা প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের মালিক মিন্টু মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নির্বাচনের একটি ঝামেলায় পড়ে যাব। ৫ তারিখ থেকে ছাপা বন্ধ হয়ে যাবে।
“আমরা ভেবেছিলাম, ১০ জানুয়ারির মধ্যে বই পৌঁছে দেব। কিন্তু আরও সপ্তাহ খানেক সময় লাগবে বেশি। ২০ জানুয়ারি হয়ে যেতে পারে।”
পাণ্ডুলিপি তৈরিতে দেরি
প্রাথমিকের সব বই ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি ছাপাখানাতেই গেছে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে।
আরআর প্রিন্টিংয়ের মালিক জহুরুল ইসলাম জানান, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাদের পাণ্ডুলিপি পাওয়ার কথা থাকলেও সংশোধনীর কারণে তা পিছিয়ে যায়।
ছাপাখানা মালিকরা অষ্টম শ্রেণির বইয়ের পাণ্ডুলিপি ১২ ডিসেম্বর এবং নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের দুটি ও সামাজিক বিজ্ঞানের একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি ১৫ ডিসেম্বরের পর পাওয়ার কথা বলছেন।
সংশোধন করতে গিয়ে পাণ্ডুলিপি ছাপাখানায় পাঠাতে দেরি হওয়ার কথা বলেছেন এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) মো. মশিউজ্জামানও।
তার কথায়, “বই যেহেতু নতুন রচনা করা হয়েছে, কিছু বই দেখে শেষ করতে, রিভিউ করার পর মতামতের ভিত্তিতে সংশোধন করতে সময় লেগেছে। আমরা রিভিউ করে রিভিউয়ারদের মতামতের ভিত্তিতে আবার সংশোধন করেছি।”
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সরকারকে বছরজুড়ে সমালোচনার মধ্যে থাকতে হয়েছে এবার। পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তু, মূল্যায়ন পদ্ধতি, বিভাগ বিভাজন থেকে শুরু করে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
বেশি বিতর্ক হয়েছে ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে। পাঠ্যবইয়ে না থাকলেও ‘বানর থেকে মানুষ সৃষ্টির’ কথা উঠেছে সংসদেও।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু ‘ইসলামের প্রতি চরম আঘাত’ করা হয়েছে অভিযোগ করে সংসদে পাঠ্যবই প্রণয়নে জড়িতদের ‘ব্লাশফেমি আইন’ করে বিচারের দাবি জানান।
পাঠ্যবইয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতা, দেব-দেবী, সংস্কৃতির পাঠ রাখা নিয়েও আপত্তি এসেছে নানা মহল থেকে।
নগ্ন মূর্তির ছবি, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নামে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা, বয়ঃসন্ধিকালের পাঠে কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে বর্ণনা, মুসলিম শাসকদের উপেক্ষা করে হিন্দুদের গুণগান- এমন অভিযোগ এনে রাস্তায় কর্মসূচিও পালিত হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ভারতবর্ষ দখল করেছেন নাকি বিজয় করেছেন তা নিয়েও ছিল বিতর্ক।
এছাড়া সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে ওয়েবসাইট থেকে হুবহু অনুবাদ তুলে দেওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছিলেন বইটি রচনা ও সম্পাদনায় যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।
সরকার শুরুতে নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবইয়ের সমালোচনাকে অপপ্রচার বললেও পরে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বই দুটি প্রত্যাহার করে নেয়।
এছাড়া এই দুই শ্রেণির ৪০ বইয়ে ৪২৮টি সংশোধনী দিতে হয় এনসিটিবিকে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, এবার এসব বিতর্ক এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছি, যাতে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবেও ত্রুটি খুঁজে বের করতে না পারে।
“অষ্টম-নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা হয়ত অনেক জায়গায় শতভাগ বই পাবে না। ৫-৬টা করে বই পাবে, বাকিগুলো হয়ত ১০ জানুয়ারির দিকে পাবে।”
ছাপার মান ঠিক থাকবে তো?
শুল্ক ছাড় নিয়ে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করে বিদায়ী বছরে নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়ে পাঠিয়েছিল ছাপাখানাগুলো।
আরআর প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের স্বত্বাধিকারী জহুরুল ইসলামের দাবি, এ বছর কাগজের মান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বইয়ের উজ্জ্বলতা ৮৫ জিএসএম থেকে কমিয়ে ৮০ জিএসএম করা হয়েছে।
তবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলছেন, বই ছাপানোর ওপর কিছুটা প্রভাব পড়েছে ভোটের কারণে।
“আমাদের বইগুলো ছাপা হয় রোল কাগজে, আর পোস্টার ছাপা হয় ফ্ল্যাট কাগজে। ফ্লাট কাগজে সাধারণত আমাদের বইয়ের কাভারটা ছাপা হয়। এর ফলে একটু প্রভাব পড়েছে। তবে বেশি প্রভাব পড়েনি। কারণ মূল বইটা রোলিং কাগজে ছাপা হয়।”
অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “প্রতিবারই বইয়ের মান নিয়ে কথা ওঠে। কাগজ নিয়ে কথা ওঠে। এটি আংশিক সত্য, পুরোটা সত্য নয়। প্রেস মালিকরা মানে ছাড় দিতে চায়, ধরা পড়লে আমরা বই কেটে দিই। অনেককে জরিমানা করি।
“সিন্ডিকেট করে দাম কমিয়ে ফেলা হয়। সরকারি রেট ৩ টাকা ১৫ পয়সা, এরা ১ টাকা ৯০ পয়সায় কাজ করতে চায়। এখন ১ টাকা ৯০ পয়সা দরে আমি কী বই পাব, বলেন?”
আরও পড়ুন-
পাঠ্যপুস্তকে ভুল: সংশোধন ও তদন্তে হবে দুই কমিটি
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রচারে ঘাটতি ছিল: অধ্যাপক মশিউজ্জামান
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির দুই বই প্রত্যাহার
সপ্তমের বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু অনুবাদের দায় স্বীকার জাফর ইকবাল ও হাসিনা খানের