পাঠ্যপুস্তকে ভুল: সংশোধন ও তদন্তে হবে দুই কমিটি

"হয়ত সর্ষের মধ্যেও কোথাও ভূত আছে,” বলছেন শিক্ষামন্ত্রী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Jan 2023, 09:30 AM
Updated : 24 Jan 2023, 09:30 AM

নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য ছাপানো পাঠ্যপুস্তকের ভুল সংশোধনে এবং কেন ভুল হল তা তদন্তে দুটি কমিটি করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

একটি কমিটি হবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, যারা কাজ করবেন ভুল সংশোধন নিয়ে। অন্য কমিটি হবে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে, যারা এ ঘটনার পেছনে ‘কারো ইচ্ছাকৃত ভুল বা অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য’ ছিল কি না তা অনুসন্ধান করবে। 

নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইয়ের ভুল-ভ্রান্তি, তথ্য বিকৃতি, সংশোধনী এবং এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ নিয়ে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী কমিটি করার কথা জানান।

তিনি বলেন, "আমি নানা মাধ্যম থেকে পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে আলোচনা শুনছি। গণমাধ্যম, রাজনীতির মাঠ, আজকাল সামাজিক মাধ্যম অনেক সরব, সব জায়গা থেকেই আমরা বইয়ের ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা শুনছি। আমরা আগেও বলেছি, আমাদের এই বইগুলো নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষামূলকভাবে আমরা প্রণয়ন করেছি। আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে মতামত পাচ্ছি, সব জায়গা থেকে পাচ্ছি। আমরা শিক্ষার দায়িত্বে যারা আছি, এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যারা আছি, মানুষের মধ্যে বইগুলো নিয়ে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, সেটিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।"

মন্ত্রী বলেন, "বইগুলোকে ঘিরে যে ভুল ধরা পড়ছে তা নিয়ে আমরা দুটি কমিটি করছি। একটি আমাদের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে, শুধু বিষয় বিশেষজ্ঞ না, ধর্ম, স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এমন নানা বিষয়ে যে বিশেষজ্ঞরা আছেন তাদের নিয়ে আমরা একটা কমিটি করছি। আমরা একটা লিংক দিয়ে দেব, দেশ বিদেশ থেকে আমাদের এই বই নিয়ে যে কোনো মতামত আমাদের জানালে এই কমিটির মাধ্যমে কোথাও কোনো ভুল থাকলে তা সংশোধন করা হবে।

"হয়ত সর্ষের মধ্যেও কোথাও ভূত আছে। এনসিটিবির ভিতরেও যদি কেউ থেকে থাকে যে কেউ ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এই ভুলগুলো করেছে। বই ছাপানোর বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এখানে ভুল করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোথাও কারো গাফিলতি বা ইচ্ছাকৃতভাবে নেতিবাচক কোনো দিকে নেওয়ার অভিপ্রায় থেকে থাকলে তা খুঁজে বের করতে আমরা আরেকটি কমিটি করে দিচ্ছি।"

দ্বিতীয় কমিটিতে শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্য মন্ত্রণালয়, এমনকি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকেও সদস্য থাকতে পারে বলে জানান মন্ত্রী। 

দীপু মনি বলেন, "সারা বিশ্ব এখন রূপান্তরের কথা বলছে। আমরা এই রূপান্তরের সাথে যুক্ত আছি। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের আমন্ত্রণে আমি রূপান্তরমূলক শিক্ষার একটি আয়োজনে গেছি। সে অনুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তরের অংশ হিসেবেই আমরা নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করেছি।

"একটি বছরে এ পাঠ্যবই একেবারে সঠিক করে ফেলা একটি দুরূহ কাজ। এবছর আমরা বইগুলো পরীক্ষামূলক হিসেবে দিয়েছি। আমাদের পাইলটিং চলছে। সারাবছর আমরা সবার কাছ থেকে মতামত নেব এবং সেখানে পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জন-পরিশীলনের সুযোগ থাকবে।"

বইয়ের মধ্যে ধর্মীয় ও অন্যান্য নানা বিষয় নিয়েও মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, "বইগুলো প্রণয়নের সাথে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম তারা বইয়ের কোথাও যেন ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ বিদ্বেষ-বৈষম্য না থাকে তার জন্য সতর্কতা অবলম্বনের চেষ্টা করেছি।

"বইয়ে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা আছে। সংবেদনশীল কোনো বিষয় থাকলে আমরা নিশ্চয় নজর দেব। আওয়ামী লীগ কখনোই ধর্মবিরোধী বা বিদ্বেষী কিছু কখনো করেনি। কাজেই অনেক অভিযোগ আসতে পারে, অভিযোগের সত্যতা থাকলে তা সংশোধন করা হবে।"

সারাদেশে ২০২৩ সালে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছে সরকার। তা শিক্ষার্থীদের হাতেও পৌঁছে গেছে এ মাসের শুরুতে।

নতুন বই হাতে পাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন ভুল ও পরিবর্তন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। এসব নিছকই ভুল, না উদ্দেশ্যমূলক, সে প্রশ্নও উঠেছে।

সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ের একটি অংশে হুবহু অনুবাদ করে তুলে দেওয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছেন বইটি রচনা ও সম্পাদনায় যুক্ত থাকা অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক হাসিনা খান।

নবম ও দশম শ্রেণির জন্য ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রকাশিত তিন বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে মোট নয়টি ভুল চিহ্নিত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড। এজন্য দেওয়া হয়েছে সংশোধনী।

নতুন শিক্ষাক্রমের বই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ‘আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেছে’ মন্তব্য করে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, "আমার বাচ্চাদের সাথে কথা হয়, তাদের মায়েরা-বাবারা বলছে, শিশুরা আগ্রহের সাথে শিখছে, তারা স্কুলে যাচ্ছে। শিক্ষাক্রমটিও তাদের ভাল লেগেছে। এটি যেমন সত্য, তেমনি বইয়ে কোনো ভুল থাকলে সেটিও সত্য। কোথাও ভুল থাকলে পরবর্তী সংস্করণে তা সংশোধনের সুযোগ থাকবে।"

তিনি বলেন, "ভুলটা হয়তো বড়, যা আরও আগে চিহ্নিত হওয়া দরকার ছিল, সংশোধন হওয়া দরকার ছিল। ভুল, ভুলই। ভুল হলে আমি তা স্বীকার করে নেওয়ার পক্ষে। আগে না হলেও এটি নিয়ে এখন যে আলোচনা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী সে সংশোধন হচ্ছে তা আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। আমি আশা করব পাঠ্যপুস্তককে ঘিরে কোথাও যেন কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করা না হয়।" 

নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদানের ব্যাপারে শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং তা চলমান আছে বলেও জানান মন্ত্রী। 

পাঠ্যবই থেকে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা বিষয় সরিয়ে ফেলার ব্যাপারে একটি পক্ষের আলোচনা নিয়ে মন্ত্রী বলেন, "কোনোকিছু কারো ধর্ম বা বিশ্বাসে আঘাত দিলে তা নিশ্চয় সংশোধন করা হবে। কিন্তু এসব কথা বলে কেউ যদি মৌলবাদ ছড়ায়, তাহলে তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। মৌলবাদ ভিন্ন বিষয়৷"

অন্যদের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং উভয় মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

Also Read: সপ্তমের বিজ্ঞান বইয়ে হুবহু অনুবাদের দায় স্বীকার জাফর ইকবাল ও হাসিনা খানের

Also Read: নবম-দশমের ৩ বইয়ে ৯ ভুলের সংশোধনী দিল এনসিটিবি