“আমরা মনে করি, ঘরের কাজে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি মেনে না নিলে আমরা আগানোর পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ব।”
Published : 10 Dec 2023, 11:27 PM
শিক্ষাক্রম নিয়ে চলা বিতর্কের মধ্যে এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান এ বিষয়ে প্রচারণায় ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন।
মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যেসব পরিবর্তন এনে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের চাহিদা পূরণের দিকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে মনে করেন তিনি।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের নিয়মিত আয়োজন ইনসাইড আউট আলোচনা অনুষ্ঠানে মশিউজ্জামান বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এসেছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।
শিক্ষাক্রম প্রণয়নে নেতৃত্ব দেওয়া এনসিটিবির এই সদস্য মনে করেন, মানুষ নেতিবাচক আলোচনা বেশি শুনতে চায়। সে কারণেই সরকার সব সমালোচনার জবাব দিলেও ভুল তথ্যগুলোই বেশি প্রচার পেয়েছে।
শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক দূর করতে সরকার ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেও তা যথেষ্ট ছিল না, ইনসাইড আউট এর আলোচনায় স্বীকার করেন সরকারের এই কর্মকর্তা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ইনসাইড আউটের এ পর্ব।
২০২২ সালে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর পর চলতি বছর সারাদেশে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হয়। আগামী শিক্ষাবর্ষে এ তালিকায় যুক্ত হবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা।
নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়ার মতো একগুচ্ছ পরিবর্তন এনে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থা আমূল পাল্টে দেওয়ার রূপরেখা এসেছে।
মুখস্ত নির্ভরতা কমবে
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলছেন, সরকার একটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, যার মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম শত বছরের মুখস্ত নির্ভর ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবে।
“মুখস্ত নির্ভরতা- এটা ব্রিটিশ আমল থেকে চলছে, এখনো আমরা সেভাবেই ভাবি। কিন্তু আমরা এটাকে পরিবর্তন করতে চাচ্ছি প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে।”
এই শিক্ষাক্রমের ধরণ সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা, “এখানে শিক্ষার্থীরা মুখস্ত করবে না, হ্যান্ডসাম কার্যক্রম থাকবে। তারা অভিজ্ঞতা থেকে শিখছে। বছরজুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। আমাদের জন্য এটি খুবই নতুন। শতবছর ধরে যেটা চলছে এটা তার মতো না।”
দীর্ঘদিনের পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে আসার কারণেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন বলে মনে করেন এনসিটিবির শিক্ষাক্রমের দায়িত্বে থাকা এই সদস্য।
নতুন শিক্ষা পদ্ধতির এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠবে, আশা করছেন তিনি।
“মুখস্তনির্ভর শিক্ষা শিক্ষার্থীদের আচরণে কোন প্রভাব রাখতে পারেনি। কারণ তারা শুধু পরীক্ষার জন্য মনে রেখেছে, এরপর ভুলে গেছে সব; কিছু শিখতে পারেনি। এখন অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের মধ্য দিয়ে যাবে তারা। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফ্যান্টাস্টিক প্রতিক্রিয়া আসছে। এরা খুব ক্রিয়েটিভ। শিক্ষক-অভিভাবকরাও অভিভূত।”
মিথ্যা প্রচারণা ছিল অপ্রত্যাশিত
নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আগের মাসে শিক্ষাক্রম নিয়ে এই প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য অস্বস্তি তৈরি করেছে। রাস্তায় কর্মসূচি পালন ছাড়াও বিরোধীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের কাঁটাছেড়া করছেন। তাদের অভিযোগ, শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে।
ফেইসবুক-ইউটিউবে শিক্ষকদের ব্যাঙের লাফ, হাঁসের ডাক, সাইকেল চালানোর মত ভিডিও ছড়িয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করা হচ্ছে।
নানামুখী ট্রলের মুখে ‘অপপ্রচার ঠেকাতে’ আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করে এনসিটিবি বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। এর আগে এনসিটিবির মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী।
সমালোচনা থাকলেও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একাধিক প্রতিবেদনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকরা নতুন শিক্ষাক্রমকে ইতিবাচক হিসেবেই উল্লেখ করেছেন।
এই বাস্তবতা তুলে ধরতে সরকারের ব্যর্থতায় শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্কের মধ্যে যেতে হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন ছিল অধ্যাপক মশিউজ্জামানের কাছে।
প্রচারণায় ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে এনসিটিবির এই সদস্য ইনসাইড আউটের আলোচনায় বলেন, “এ ধরনের সমালোচনা আমরা প্রত্যাশা করিনি।”
শিক্ষাক্রম নিয়ে সব প্রশ্নের জবাব এনসিটিবি দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নতুন কারিকুলাম, নতুন টেক্সট বই নিয়ে যেসব বিষয়ে এসেছে আমরা প্রেস কনফারেন্স, সোশাল মিডিয়ায় এর ব্যাখ্যা দিয়েছি। তবে যেভাবে প্রতিক্রিয়া এসেছে সেভাবে এগুলো বড় আকারে যায়নি।
“কারণ মানুষ নেতিবাচক তথ্য শুনতে চায়। এগুলো শেয়ারও হয় বেশি। এ কারণে ভুল তথ্য ছড়ায় দ্রুত।”
অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, সরকার সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের বিষয়ে চিন্তা করছে, ভবিষ্যতে এসব বিষয়ে আরও মনোযোগ থাকবে।
“যেহেতু আমরা একটি মৌলিক পরিবর্তনে গিয়েছি, তাই শিক্ষক-অভিভাবকদের মনে অনেক সংশয়, অনেক দ্বিধা, অনেক প্রশ্ন ছিল। আমরা শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছি। শিক্ষাক্রম নিয়ে সবার মতামত চেয়েছি; ওয়েবসাইটে দিয়েছি, গণমাধ্যমে দিয়েছি।”
বিজ্ঞানে জোর কি কমেছে?
নতুন শিক্ষাক্রমে আগের মত নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন থাকছে না। আসছে জানুয়ারি থেকেই এই ব্যবস্থায় ঢুকে পড়বে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা।
এ নিয়ে সমালোচনার জবাবে অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, সব শিক্ষার্থীদের আরও বেশি বিজ্ঞান শিক্ষার আওতায় রাখতেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
“প্রকৃতপক্ষে আমাদের ১৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান গ্রুপে পড়ে। ৮১ শতাংশ বিজ্ঞান নেয় না। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ বিজ্ঞান পাঠের বাইরে থাকছে। আবার নবম-দশম শ্রেণিতে ফল খারাপ হলে অর্ধেক শিক্ষার্থী একাদশ-দ্বাদশে বিজ্ঞান ছেড়ে দেয়।”
বিজ্ঞানের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, “ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে তাদের বিজ্ঞান ও গণিত পড়ার পরিধি একটু একটু করে বাড়ে। নবম-দশম শ্রেণিতে এর পরিসর অনেক বেশি। সেখানে আমরা শতভাগ শিক্ষার্থীকে আরও বেশি বিজ্ঞান পড়াতে চাই।”
ছকবাঁধা চিন্তা থেকে বের হতে শিক্ষা কার্যক্রমে রান্না
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যেসব সমালোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের রান্না করা, ঘর পরিষ্কারের মত বিষয়ও রয়েছে।
রান্না বা গৃহ ব্যবস্থাপনা জীবনমুখী শিক্ষারই অংশ দাবি করে অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, “অনেকগুলো বিষয় আছে যে কারণে আমরা রান্না বিষয়টি রেখেছি। প্রত্যেকেরই খাদ্যের প্রয়োজন আছে। এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমাদের জন্য। অনেকে ধরেই নেয় এটি মা-বোনদের কাজ বা একজন নারী রান্নার কাজটা করবে। কোনো ছেলে বা পুরুষ এটি করতে পারবে না।
“এই স্টেরিওটাইপ ধারণা থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে আনার জন্যই আমরা বিষয়টি রেখেছি। আমরা মনে করি, ঘরের কাজে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বিষয়টি মেনে না নিলে আমরা আগানোর পরিবর্তে পিছিয়ে পড়ব।”
রান্নার রং, মশলার পরিমাপসহ এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যাকে বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরি হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি।
নতুন শিক্ষাক্রম গবেষণার আলোকেই
মশিউজ্জামান জানান, ২০১৭-১৯ সালে তারা ৬টি গবেষণা করেছেন, এরপর দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের দিকে গিয়েছে এনসিটিবি।
“এটি না করলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে আমরা টিকে থাকতে পারব না। বিশ্বে অনেক পরিবর্তন এসেছে, প্রযুক্তি বদলে গেছে- ভবিষ্যতে সেখানে এগুতে হলে দক্ষতা লাগবে। তাই বড় পরিবর্তনে আমাদের যেতে হয়েছে।
“১০২টি দেশের শিক্ষাক্রম আমরা দেখেছি, অনেক উন্নয়নশীল দেশে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে। কেউ কেউ মনে করে আমরা সেখান থেকে এটি নিয়েছি। কিন্তু এটি আমাদের জাতীয় প্রয়োজন ও বাস্তবতার নিরিখে তৈরি করা হয়েছে।”
শিক্ষক প্রশিক্ষণের কী হবে?
নতুন পাঠপ্রক্রিয়া শিক্ষকদের অভ্যস্ত করতে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মশিউজ্জামান জানান, প্রতিবছরই সরাসরি ও অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
“এ ধরনের শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকরা নানামুখী সমস্যায় পড়তে পারে। সেজন্য প্রযুক্তিনির্ভল ফিডব্যাক সিস্টেম রাখা হয়েছে। অনলাইন গ্রুপ করা হয়েছে। তারা সমস্যায় পরলে নক করবেন, সমাধান পাবেন।”
এই শিক্ষাক্রমে শহর ও গ্রামের শিক্ষার্থীদের বৈষম্য দূর হবে আশা করে এনসিটিবির এই সদস্য বলেন, “নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের আগে আমরা পাইলটিং করেছি। সেখানে হাওর, চর, উপকূলবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি, তারা ঢাকা শহরের প্রতিষ্ঠানের মতই পারফর্ম করেছে।”