লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলছেন, তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, আশা করছেন ‘দ্রুতই’ সমাধান হবে।
Published : 19 Feb 2024, 12:33 AM
ভালো বেতনের আশায় চাকরি নিয়ে আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় গিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন চিকিৎসক, নার্সসহ ১৪২ জন স্বাস্থ্যকর্মী।
লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে চাকরির ভিসা নিয়ে ২০২৩ সালের জুনে সেখানে যান তারা। তবে এখন পর্যন্ত বেতন পাননি, রয়েছে আবাসনসহ অন্যান্য সমস্যাও।
বিষয়টি নিয়ে গত সপ্তাহে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে ইমেইল করেন এক ভুক্তভোগী। পরে আরও কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন তারা।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা ‘কাজ করছেন’। শিগগিরই সমস্যা সমাধান হবে বলে আশা করছেন।
যুদ্ধ ও পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতায় কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে লিবিয়ার শ্রমবাজার আবার খুলে দেওয়া হয়। অবকাঠামোসহ অন্যান্য খাত পুনর্গঠনে বিভিন্ন দেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে দেশটি। বাংলাদেশী কর্মীদের চাহিদা রয়েছে সেখানে।
লিবিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য কর্মী নিতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসে। চাকরিপ্রার্থীদের সাক্ষাতকার শেষে ১৫৭ কর্মীকে বাছাই করে লিবিয়ার আলামাল আলিবিয়া কোম্পানি ফর মেডিকেল সার্ভসেস। বাংলাদেশ সরকার থেকে অনুমোদন নিয়ে ঢাকার ইজ্জি সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড (ইএসআরএম) এবং মেসার্স আজুর বেঙ্গল লিমিটেড নামে দুটি কোম্পানির মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ দেয় তারা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালের ২০ জুন একটি চিঠিতে ৮৮ জনকে এবং ২২ জুন আরেকটি চিঠির মাধ্যমে ৬৯ জনের নিয়োগের অনুমতি দেয়।
১৫৭ জন চিকিৎসক, নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্টের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপে ১৪২ জন লিবিয়া যান। তাদের লিবিয়ায় বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মন্ত্রণালয়ের নথি থেকে জানা যায়, লিবিয়ার এই চাকরিতে চিকিৎসকদের প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ২২ শ ডলার এবং নার্সদের ৬৫০ থেকে ৯০০ ডলার বেতন দেওয়ার কথা।
একজন চিকিৎসক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, লিবিয়ায় আসার পর সাত মাস পার হলেও চুক্তি অনুযায়ী বেতন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে খাবারের খরচের জন্য সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়।
“হাসপাতাল যে টাকা দেয় তাতে এখানে দৈনন্দিন খরচ চালাতেও হিমশিম খেতে হয়। টানা ৭ মাস স্যালারি না পেয়ে লিবিয়ায় আমরা এবং বাংলাদেশে আমাদের সবার পরিবার অর্থনৈতিক কষ্টে ভুগছে। আমরা সব স্বাস্থ্যকর্মী লিবিয়ায় অর্থনৈতিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় দিন পার করছি।”
আরেকজন চিকিৎসক অভিযোগ করেন, লিবিয়ায় তাদের রিক্রুটিং এজেন্সিকে বিষয়টি জানালেও তারা এড়িয়ে যাচ্ছেন। লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসেও তারা কয়েকবার যোগাযোগ করেছেন।
“দূতাবাস এজেন্সিকে চাপ দিয়েছে, কিন্তু কোনো সুফল আসেনি। এতে দূতাবাসও এখন বিরক্তি প্রকাশ করছে। তাদের কাছ থেকে আমরা আশানুরূপ সাহায্য পাচ্ছি না।”
একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, স্বাস্থ্যকর্মীদের বেশিরভাগের এখনও বৈধ কাগজপত্র করা হয়নি। ফলে তারা অনেকটা অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। যারা আছেন, তাদের সমস্যার মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে আরও স্বাস্থ্যকর্মী নেওয়া হচ্ছে।
“বেতন কবে হবে সে বিষয়ে আমাদের হাসপাতাল, এখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ দূতাবাসও জানে না। প্রতি মাসেই আশ্বাস দিচ্ছে যে সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছে না। আমরা জিম্মিদশায় আছি। আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা কোথাও অভিযোগ করলে বা লেখালিখি করলে লিবিয়ান নিয়োগকারী এজেন্সিসহ আরো কিছু মাধ্যমে আমাদের হুমকি দেয়, যেন আমরা চুপ থাকি।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অংশের দায়িত্বে থাকা ইজ্জি সার্ভিসেস অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আদনান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, লিবিয়ায় থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা সাত মাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না– এই তথ্যটি ‘আংশিক সত্য’।
“তাদের সবার প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। এই সময় শেষে তাদের রেসিডেন্স পারমিট, ব্যাংক কার্ড হওয়ার কথা। তারপর তাদের অ্যাকাউন্টে বেতন চলে যাবে। এখন তাদের চলার জন্য এক থেকে আড়াই হাজার দিনার পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে পকেটমানি হিসেবে। বিষয়টা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সবাই জানে।”
আদনান বলেন, “পুরো বিষয়টি ডিল করছেন সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস। তারা আমাদের যখন চাহিদাপত্র দিয়েছেন, আমরা ধরে নিয়েছি বিষয়টি সবাই অবগত। সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি টিম বাংলাদেশে এসে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাছাই করেছেন। তারা লিবিয়া যাওয়ার পর আমরা জানতে পেরেছি প্রবেশন পিরিয়ডের বিষয়টি।
“আমরা বাংলাদেশ দূতাবাস, সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা বলেছেন, প্রবেশন পিরিয়ড শেষে তাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়েছে, রেসিডেন্স কার্ড পেয়েছেন অনেকে। আমার কাছে যে তথ্য আছে তাতে এই মাসে সবার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকবে।”
তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ পর্যন্ত তারা দুই হাজার দিনার করে পেয়েছেন, যা বাংলাদেশি টাকায় ৩৮ হাজার টাকার মত।
মেসার্স আজুর বেঙ্গল লিমিটেডের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা শাহাদাত কবির বলেন, বেতন নিয়ে সমস্যাটি তারা জানেন। সাধারণত লিবিয়া যাওয়ার পর তিন মাসের মধ্যে বেতন হয়ে যায়। কিন্তু এবার দেরি হচ্ছে।
“এবার টাইমটা একটু বেশি লাগছে। আমরা তো জানতাম না। আমরা তো ভালোর জন্যই পাঠিয়েছি। আমরা যেটুকু জানি এই মাসের মধ্যেই বেতন হয়ে যাবে।”
লিবিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিষয়টি তিনি জানতে পারেন গত বছরের অক্টোবর মাসে। নভেম্বর মাসে লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও উপ-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্বাস্থ্যকর্মীদের চার মাসের বকেয়া বেতন ও আবাসন সঙ্কটসহ বেশকিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
“তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) আমার সামনেই একজন কর্মকর্তাকে বিষয়টি সুরাহা করে দিতে বলেছেন। এক মাস পার হলেও কোনো সমাধান না হওয়ায় আমি হিউম্যান রিসোর্সের ডিজিকে ডেকে বিষয়টি জানাই। তিনি জানালেন, তাদের একটু সমস্যা আছে তবে ওই বছরের মধ্যে পাওনা শোধ করে দেবে। কিন্তু সমাধান হল না।”
রাষ্ট্রদূত বলেন, পরে লিবিয়ার আরেকজন কর্মকর্তাকে দূতাবাসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ওই কর্মকর্তা তাদের অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করার কথা বলেছিলেন।
“তিনি তখন জানান, বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্সরা চুক্তিতে সই করছেন না, ফলে প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে। দূতাবাস পরে উদ্যোগ নিয়ে চুক্তির বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছে।
“এরপর আমি গেলাম তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজির (এশিয়া) কাছে। তিনি আমার সামনেই তাদের স্বাস্থ্য বিভাগে কথা বললেন। তারা জানালেন অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের টাকা দেয় নাই, তাই কর্মীদের দিতে পারছেন না।”
তারপরও সমাধান না হওয়ায় গত ৩০ জানুয়ারি লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পুরো বিষয়টি জানিয়ে একটি চিঠি দেওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রদূত।
“তিনি (লিবিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রী) গত ১২ ফেব্রুয়ারি ওই দেশের সব হাসপাতালে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের বকেয়া বেতন, আবাসনসহ সমস্যাগুলো সমাধান করতে বলেছেন। আমরা সবকিছুর আপডেট আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আমাদের মন্ত্রণালয় এবং এখানে কর্মরত কর্মীদের জানাচ্ছি। আশা করছি দ্রুতই সমাধান হবে।”
এ অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে আরও কর্মী পাঠানো ঠিক হবে কিনা– এমন প্রশ্নে আবুল হাসনাত মুহাম্মদ খায়রুল বাশার বলেন, “এখনও লিবিয়ায় সরকার স্থিতিশীল না, নিরাপত্তা ব্যবস্থাও প্রায়ই অস্থিতিশীল হচ্ছে। তবে বাংলাদেশি কর্মীরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে, তাই তাদের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু আমরা কর্মীদের সেখানে যেতে উৎসাহিত করছি না, আবার নিরুৎসাহিতও করছি না।
“বিষয়টি নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে বিভক্তি আছে। কেউ কেউ বলছে, তারা যে কোনোভাবেই আসতে চান। আমরা বলেছি এটা সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব বিষয়। তারা নিজের দায়িত্বে আসবেন।”
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালক সালেহ আহমদ মোজাফফরকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।