লন্ডন সফরে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
Published : 09 Apr 2025, 11:08 PM
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে ৫ কোটি ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বিশ্বের তিনটি বড় প্রতিষ্ঠান, যারা মামলা চালাতে তহবিল সহায়তা দিয়ে থাকে।
পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের অংশ হিসেবে লন্ডন সফরের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর প্রতিষ্ঠান তিনটির সঙ্গে কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস লিখিতভাবে বুধবার এ তথ্য দিয়েছে।
এ বছর ১৭ থেকে ২১ মার্চ লন্ডন সফরের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করার সক্ষমতা বিষয়ক একাধিক কর্মশালাতেও অংশ নেন, যার আয়োজক ছিল বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন।
এ বিষয়ে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গভর্নর আরো অনেক বিষয় নিয়ে সেখানে কথা বলেছেন। তার মধ্যে অর্থ পাচার এবং সেই অর্থ উদ্ধারের বিষয় ছিল।”
গভর্নরের লন্ডন সফর নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস লিখিত তথ্য দিয়েছে, যেখানে লন্ডনে গভর্নর কি কি ধরনের কর্মসূচি ও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন সেসব বিষয় রয়েছে।
এতে বলা হয়, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রধান আহসান এইচ মনসুর যুক্তরাজ্য সফরকালে সরকারি ও বেসরকারি খাতের অংশীজনদের সঙ্গে বড় পরিসরে বৈঠক করেছেন, যেখানে তিনি দেশ থেকে চুরি হওয়া এই অর্থ উদ্ধারে জোর দিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস বলেছে, “লন্ডনে গভর্নর বিশ্বের বড় তিনটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। মামলার পরিচালনায় তহবিল সহায়তা দেওয়া এসব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সম্পদ উদ্ধারে আইন সংস্থা ও তদন্তকারী নিয়োগে সহায়তা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
“প্রতিষ্ঠান তিনটি বলেছে, যদি মামলা করার মত পর্যাপ্ত প্রমাণ জোগাড় করতে পারে তাহলে ৫ কোটি ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করবে তারা। গভর্নর তাদের যত শিগগির সম্ভব বাংলাদেশ এসে অর্থ পাচারের মামলাগুলো পর্যালোচনা করে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।”
প্রেস অফিসের লিখিত তথ্যে বলা হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ১৬ বছরে চুরি করা এবং অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই ধরনের এই সম্পদ চুরি প্রধান মাধ্যম ছিল ‘ব্যাংক খাত ও সরকারি দুর্নীতি’।
বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ অন্তত ২০ শতাংশে পৌঁছে এবং তা বাড়ছিল তুলে ধরে প্রেস অফিস বলেছে, “এ অবস্থায় ১০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্পদ উদ্ধার পর্যালোচনা বৈঠক করেন এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে গন্তব্য দেশগুলোতে কার্যক্রম জোরদারের নির্দেশ দেন।”
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য ও ১০ শিল্প গোষ্ঠীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় থাকা শিল্প গ্রুপগুলো হল- বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, এস আলম, জেমকন, নাবিল, নাসা, ওরিয়ন, সিকদার, আরামিট ও সামিট। এসব গ্রুপের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়।
এই অর্থ ফেরত আনতে দুদককে মূল ভূমিকায় রেখে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর যৌথভাবে এ কাজ করার কথা বলা হয়েছে। তাদের কাজ সমন্বয় করবে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করা আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস বলেছে, লন্ডন সফরে গভর্নর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেন।
১৭ মার্চ গভর্নর লন্ডনে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা অল পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ (এপিপিজি) এর সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যের এমপি জো পাওয়েল, রূপা হক ও ব্যারোনেস উদ্দিন এবং সাবেক বিচারমন্ত্রী অ্যালেক্স চক। এছাড়া ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, স্পটলাইট অন করাপশনসহ বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী সংগঠন, প্রধান কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা সেখানে ছিলেন।
বৈঠকে গভর্নর বলেন, চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধার শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও।
কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশকে আরও বেশি সহায়তা দিতে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায় এবং জরুরিভাবে পাচারকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনার পরামর্শ দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এসসিডিও) এর পার্লামেন্টারি আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট ক্যাথরিন ওয়েস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংক খাত সংস্কার ও শক্তিশালীকরণের পাশাপাশি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের সম্পদের গুণমান পর্যালোচনা (একিউআর) বিষয়ে এফসিডিও এর সহায়তার প্রশংসা করেন।
১৯ মার্চ লন্ডনে বাংলাদেশের সম্পদ উদ্ধার বিষয়ে একটি সেমিনার হয় যেখানে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। সেখানে সরাসরি ও ভার্চুয়ালি ১০০ জন উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় আইন সংস্থার প্রতিনিধি ও ফরেনসিক তদন্তকারীরাও ছিলেন।
বাংলাদেশের সম্পদ পাচারের এ ঘটনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও জটিল ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে আহসান এইচ মনসুর এই সম্পদ উদ্ধারে বেসরকারি খাতের আইন সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার বিষয়ে জোর দেন।
তিনি বলেন, বিশ্ব ব্যাংক ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর) এর সহায়তায় বাংলাদেশ এপ্রিলের মধ্যে টার্মস অব রেফারেন্স (টিওআর) চূড়ান্ত করবে, যাতে অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত হতে পারে।
এছাড়া পাচার হওয়া সম্পদ উদ্ধারে আইন করার প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
সেখানে যুক্তরাজ্যের সাবেক বিচারমন্ত্রী অ্যালেক্স চক বলেন, পাচার অর্থ ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়ায় সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) সহযোগিতার পাশাপাশি বাংলাদেশ লন্ডনের আইনজীবীদের যুক্ত করে লাভবান হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রেস অফিস বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর লন্ডন সফরকালে আল জাজিরা, ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, গার্ডিয়ান ও ডেইলি মেইলকে সাক্ষাৎকার দেন। এগুলোতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সম্পদ উদ্ধার প্রচেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরেন। কীভাবে আন্তর্জাতিক মহলে এই উদ্যোগকে আরও দৃঢ়ভাবে উপস্থাপন করা যায় এবং সহায়তা পাওয়া যাবে সে বিষয়ে যুক্তরাজ্যের দুটি কৌশলগত যোগাযোগ সংস্থার সঙ্গে পরামর্শ করেন তিনি।