সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, তুরিন আফরোজ কিংবা যে কারও ক্ষেত্রে শুধু ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত’ হোক।
Published : 10 Apr 2025, 09:14 AM
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ‘হত্যাচেষ্টা’ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন আইনজীবী তুরিন আফরোজ, যিনি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালনের দিনগুলোতেও আলোচনায় ছিলেন।
একাডেমিক লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকে একাধিক বিষয়ে তিনি পড়েছেন, নিয়েছেন উচ্চতর ডিগ্রি, যার সবশেষটি আইনের। পরে দেশে ফিরে আইন বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন।
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আর বিদেশের পড়ালেখার জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ ঘটাতে চেয়েছিলেন তুরিন। দেশের সর্বোচ্চ বিচারাঙ্গনে আইনজীবী হিসেবে থিতু হওয়ার মধ্যে তার কর্মজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয় যুদ্ধপরাধীদের বিচার কার্যক্রম।
আন্তর্জাতিক আইনের বিস্তৃত পরিসরের তাত্ত্বিক জ্ঞান নিয়ে নিজের আগ্রহ থেকেই তিনি যোগ দেন সেই কাজে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সঙ্গে কাজ করা তুরিন আফরোজ যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে নাম লেখান; পরের কয়েক বছর আদালতে শীর্ষ আসামিদের বিচারে আইনজীবী হিসেবে ভূমিকা রাখেন।
বাংলাদেশের পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ায় আইনজীবী হিসেবে কাজ করা ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বিভিন্ন মামলার বিচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
তবে শেষটা তার সুখকর হয়নি। এক আসামির সঙ্গে ‘গোপন বৈঠক করে অসদাচরণের’ অভিযোগ মাথায় নিয়ে তাকে বিদায় নিতে হয় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম থেকে।
এবার আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি; মঙ্গলবার আদালত তাকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, তুরিন আফরোজ কিংবা যে কারও ক্ষেত্রে শুধু ‘ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত’ হোক।
“কেউ যদি রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তার বিচার করা হোক। আর যদি ক্ষতি না করার পরেও কাউকে হেনস্তা করা হয়, তাহলে হেনস্তাকারীদেরও বিচার হোক।”
যেভাবে আইন পেশায়
সহকর্মীদের চোখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ও বাণিজ্য আইনে বিশেষ পারদর্শী তুরিন আফরোজের জন্ম ১৯৭১ সালে ঢাকায়; তার বাবা তসলিমউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ সরকারের রাজস্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের আদি নিবাস নীলফামারী জেলার জলঢাকা থানার চাওরাডাঙ্গি গ্রামে।
তুরিন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করেছেন ঢাকার হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। ১৯৮৮ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মানবিক শাখার সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে স্নাতক পাসের পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন তিনি। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে এলএলবি করে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন সিডনি থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনে এলএলএম করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় ‘আইন ও উন্নয়ন অর্থনীতির’ উপর পিএইচডি করা তুরিন আফরোজ ব্যারিস্টার ও সলিসিটর হিসেবে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস সুপ্রিম কোর্টে।
দেশে ফিরে এসে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। পড়িয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের তিন বছরের মাথায় প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার এক সহকর্মী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, “আমরা কেউ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমের উপর পড়ালেখা করি নাই। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমের উপর লেখাপড়া করে তিনি এখানে এসেছিলেন। অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই, তার তাত্ত্বিক যে ভিত্তিটা, এটা ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের।”
বাংলাদেশের যুদ্ধপরাধ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের হাউজ অব লর্ডস ও হাউজ অব কমন্স, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট এবং বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেনের পার্লামেন্টে শুনানিতে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তুরিন আফরোজের।
‘জেনোসাইড, ওয়ার ক্রাইমস এবং ক্রাইম এগেইনস্ট হিউম্যানিটি ইন বাংলাদেশ: ট্রায়াল আন্ডার ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭১’ এবং ‘ট্রায়ালস অব ১৯৭১ বাংলাদেশ জেনোসাইড: থ্রো এ লিগ্যাল লেন্স’ নামে বই রয়েছে তার প্রকাশনার মধ্যে।
‘অসদাচরণের’ অভিযোগে বিদায়
যুদ্ধাপরাধ মামলার এক আসামির সঙ্গে ‘গোপন বৈঠক ও মামলার স্বার্থবিরোধী ভূমিকা’ রাখার অভিযোগ তোলা হয় তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ মাথায় নিয়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে চলে যেতে হয় তাকে।
২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে তাকে অপসারণ করে আওয়ামী লীগ সরকার।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর থাকার সময় ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। ট্রাইব্যুনালে তার ইতিবাচক ভূমিকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলে প্রশংসার খবরে তিনি রাজনীতি নিয়ে উচ্চাভিলাষী হয়ে পড়েন বলে তার ঘনিষ্ঠরা তখন বলেছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল থেকে তুরিনকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে ওই সময় আইন ও বিচার বিভাগের সলিসিটর অনুবিভাগের প্রজ্ঞাপনে ‘শৃঙ্খলা ও পেশাগত আচরণ ভঙ্গ এবং গুরুতর অসদাচরণের’ কথা বলা হয়।
তাকে অপসারণের পর তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, তার বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেওয়া ‘জরুরি’ হয়ে পড়েছিল।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ।
২০১৮ সালের এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর তুরিন ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখা করেন।
ওই অভিযোগ ওঠার পর প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ওয়াহিদুল ও তুরিনের কথোপকথনের রেকর্ড ও বৈঠকের অডিও রেকর্ডসহ যাবতীয় ‘তথ্য-প্রমাণ’ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ২০১৮ সালের ৯ মে তাকে ট্রাইব্যুনালের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তুরিন সে সময় অভিযোগের বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি। এক ফেইসবুক পোস্টে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও ওই গোপন বৈঠকের কথা তিনি অস্বীকার করেননি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তখন তিনি বলেছিলেন, “একজন যুদ্ধাপরাধীকেও ট্রাইব্যুনাল আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়। পরে প্রমাণ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বা অপরাধের প্রমাণ হয়। আর আজকে একজন যুদ্ধাপরাধী এসে বলল তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে, অভিযোগ করল আর সেটাই সত্যি হয়ে গেল! তুরিন আফরোজকে আত্মপক্ষ সমর্থনেরও সুযোগ দেওয়া হল না।”
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কাজে সম্পৃক্ত তুরিন বলেন, “প্রসিকিউশনে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। এজন্য আমি গর্ববোধ করি। সম্মানের সাথে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের একটা অংশ আমি হয়েছি। এত কিছুর পরও আমি চাই বিচার চলুক, আরও সফলতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাক।”
পারিবারিক বিরোধে সংবাদের শিরোনামে
সৎ মা এবং ভাইদের সঙ্গে বাড়ি নিয়ে বিরোধে বিভিন্ন সময়ে সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক এই প্রসিকিউটর।
বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া উত্তরার বাড়ি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সৎ ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজের সঙ্গে মামলা চলছে তুরিন আফরোজের।
এ নিয়ে আদালতের রায়ের পর আপিলের প্রেক্ষিতে সবশেষ গত ১২ মার্চ পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৩০ এপ্রিল দিন নির্ধারণ করেছে আদালত।
উত্তরার এ বাড়ি নিয়ে ২০১৭ সাল থেকে আদালতে বিচারাধীন মামলার খবর অনুযায়ী, তুরিন আফরোজ ২০১৭ সালের ১১ মে মামলাটি করেছিলেন।
ঢাকার দেওয়ানি আদালতে করা এ মামলায় সৎ মা শামসুন্নাহার ও সৎ ভাই শিশিরকে বিবাদী করা হয়।
আরজিতে তার দাবি, উত্তরার বাড়ির মালিক তিনি এবং তার দখলে রয়েছে। তার ভাই শিশির ও মা শামসুন্নাহার মালিক না হয়েও দখল নিতে বেআইনি চেষ্টা চালাচ্ছেন। এক বছর পর ২০১৮ সাল বাদীপক্ষের আবেদনে বাড়িটি নিয়ে স্থিতাবস্থা দেয় আদালত।
অপরদিকে আদালতে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে শিশিরের দাবি, তার বাবা তসলিম উদ্দিন কখনও তুরিনকে এ বাড়ি দান করেননি। তার মা শামসুন্নাহার তাকে (শিশির) এ সম্পত্তি দান করেছেন। পরে ঋণ নিয়ে তিনি বাড়ি করেন এবং ভোগ দখলে ছিলেন।
এর মধ্যে তুরিন আফরোজকে গ্রেপ্তারের পরদিন একদল ব্যক্তি নিয়ে তার ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ রাজধানীর উত্তরার বাড়ি ‘দখলের চেষ্টা’ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিশির উত্তরার ওই বাড়িটি নিজের দাবি করে সবাইকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ করেন তুরিনের মেয়ে। বাড়ির নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর এবং ‘নেইমপ্লেট’ সরিয়ে ফেলার অভিযোগও করেন তিনি।
ওই বাড়ির একটি তলায় আইনজীবী তুরিন আফরোজের পরিবারের সদস্যরা থাকেন এবং বাকিগুলো ভাড়া দেওয়া।
পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে হস্তক্ষেপ করলে শিশির দলবদল নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। এ ঘটনার পর পুলিশের তরফে গ্রেপ্তার তুরিনের ১৭ বছর বয়সী মেয়েকে ‘অভয়’ দেওয়া হয়; নতুন কোনো সমস্যা হলে পুলিশকে অবগত করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
বুঝলাম না, আমি কোন পক্ষের লোক: আদালতে তুরিন আফরোজ
তুরিন আফরোজ গ্রেপ্তারের পর মামার বিরুদ্ধে বাড়ি ‘দখলচেষ্টার’ অভিযোগ মেয়ের