“তিনি (ইউনূস) শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন, সে কারণে শ্রম আইনে মামলা হয়েছে”, বলেন আনিসুল হক
Published : 12 Jun 2024, 08:08 PM
নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস ‘অসত্য কথা’ বলছেন অভিযোগ এনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, দেশের কোনো নাগরিক আইন ভঙ্গ করলে যেভাবে বিচার হয়, সেভাবেই তার বিচার হচ্ছে।
বুধবার সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷
এই আলোচনায় ইউনূসের বিচারের বিষয়টিও স্থান পায় বলে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে।
বৈঠকে ইইউ প্রতিনিধিদলকে মন্ত্রী বলেন, ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন একটি মামলা করেছে৷ মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে৷ আর আদালতে বিচারাধীন মামলা সম্পর্কে তিনি কোনো কথা বলেন না।
গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ইউনূসের বিরুদ্ধে কিছু কর ফাঁকির মামলাও ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি (ইউনূস) আপিল বিভাগ পর্যন্ত গিয়ে হেরে যাওয়ার পর কর দিয়েছেন৷”
তবে ইউনূস সেন্টার ‘প্রতিবাদ লিপিতে’ দাবি করেছে, সুপ্রিম কোর্ট ‘ইউনূসের কর ফাঁকি নিয়ে’ কোনো রায় দেয়নি। কর নিয়ে ‘আইনি ব্যাখ্যার জন্য’ তিনি সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন।
একই দিন গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং ওই অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় আদালতে হাজিরা দেন ইউনূস।
এই মামলায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যানের বিচার শুরু হয়েছে। দোষী সাব্যস্ত হলে এই নোবেলজয়ীর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে বলে জানিয়েছেন দুদকের আইনজীবী।
আদালত থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদেরকে ইউনূস বলেন, “যেটার বিচার হবে, সেটা বুঝতে পারছি না আরকি। এটাই হচ্ছে হয়রানি। আমার কাছে, আমার সহকর্মীদের কাছে বোধগম্য হচ্ছে না। আমরা সারাজীবন তো মানুষের সেবাতেই কাটিয়ে দিই। সেবা করার জন্য অর্থ আত্মসাৎ করতে আমরা আসিনি। অর্থ ব্যয় করার জন্য এসেছি।”
ইউনূসের এসব বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী বলেন, “তিনি যেসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন, এসব কথা অসত্য এবং এসব কথা বাংলাদেশের জনগণের জন্য অপমানজনক।”
গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে করা মামলার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “তিনি (ইউনূস) শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন করেছিলেন, সে কারণে শ্রম আইনে মামলা হয়েছে এবং একটি মামলায় আদালত তাকে সাজা দিয়েছেন৷ এখনও অনেক মামলা পেন্ডিং আছে।”
ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আর কী কী ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে- এই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ শ্রম আইন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স আইন, উপাত্ত সুরক্ষা আইন, সাইবার নিরাপত্তা আইন, ইইউ নির্বাচন কমিশন থেকে বাংলাদেশে একটি টিম এসেছিল, সেই টিমের রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী চিন্তা-ভাবনা করছে, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আইন সম্পর্কেও তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে৷”
কবে নাগাদ সংশোধিত শ্রম আইন পাস করা হবে, সেটাও প্রতিনিধিদল জানতে চেয়েছিল বলে জানান তিনি।
আনিসুল হক বলেন, “প্রতিনিধিদলকে বলে দেওয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে নালিশ করা হয়েছিল, সেই নালিশটার শেষ আমরা চাই৷
“তাদেরকে আরও বলেছি, শ্রম আইন সংশোধন নিয়ে আমরা যথেষ্ট কাজ করেছি৷ আমার মনে হয় বিষয়টা শেষ করে দেওয়া উচিত৷ তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, আগামী নভেম্বরে আইএলও-এর যে গভর্নিং বডির মিটিং হবে, সেখানে আমাদের সমর্থন করার৷”
ইউনূস সেন্টারের প্রতিবাদ
উচ্চ আদালতে আপিলে হেরে ইউনূসের ১২ কোটি টাকা দানকর পরিশোধ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তার প্রতিবাদে এদিন বিবৃতি দিয়েছে ইউনূস সেন্টার।
এতে দাবি করা হয়, ইউনূস কখনোই কর ফাঁকির দায়ে ‘অভিযুক্ত হননি’।
১১ জুন রয়টার্সের একটি সংবাদে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের দৃষ্টি আকর্ষণ হয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে কর কর্তৃপক্ষের কখনও কোনো কর ফাঁকির মামলা ছিল না। সুতরাং, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কর ফাঁকির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় দেওয়ার প্রশ্নটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।”
২০১১-১২ অর্থবছরে মুহম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট ও ইউনূস সেন্টারে ৬১ কোটি ৫৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা দান করেন নোবেলজয়ী ইউনূস।
ওই দানের বিপরীতে ১৯৯০ সালের দানকর আইন অনুযায়ী প্রায় ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কর দাবি করে ইউনূসকে নোটিস পাঠায় এনবিআর।
২০১২-১৩ অর্থবছরে মুহম্মদ ইউনূস ট্রাস্টে তিনি দান করেন ৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিনি মুহম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট ও ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্টে ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা দান করেন।
ওই দুই দানের বিপরীতে প্রায় এক কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং এক কোটি ৫০ লাখ টাকা দানকর চেয়ে আরও দুটি নোটিস দেওয়া হয় তাকে।
এনবিআরের সেসব নোটিসের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কর আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ইউনূস। তার দাবি ছিল, নিজের ‘মৃত্যুচিন্তা’ এবং পরিবারের কল্যাণ কামনায় দানকর আইন অনুযায়ী তিনি ওই অর্থ দান করেছেন। সুতরাং এনবিআর ওই দানের জন্য কর দাবি করতে পারে না।
শুনানি শেষে ২০১৪ সালে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল ইউনূসের মামলা খারিজ করে এনবিআরের পক্ষে রায় দেয়। এরপর হাই কোর্টে তিনটি আয়কর রেফারেন্স মামলা করেন ইউনূস।
তবে ‘মৃত্যু চিন্তা’র যে কথা আইনে বলা আছে, তা ইউনূসের ওপর প্রযোজ্য ছিল না, কারণ, তার মৃত্যু হতে পারে, এমন কোনো জটিল রোগ বা অন্য কোনো বাস্তবতা ছিল না।
এরপর হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে গিয়েও হেরে সেই কর পরিশোধ করেন তিনি।
ইউনূস সেন্টার বলে, “অধ্যাপক ইউনূস আদালতে গিয়েছিলেন একটি আইনি পয়েন্টে সিদ্ধান্ত নিতে। কোর্টের কাছে প্রস্তাব ছিল যে দান আয়কর আইনের আওতায় আসে কিনা। যেহেতু কর কর্তৃপক্ষ তার দানের উপর কর আরোপ করেছিল এবং এ বিষয়টি নিয়ে মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। যখন সুপ্রিম কোর্ট কর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একমত হয়, তখন অধ্যাপক ইউনূস কর প্রদান করে। এতে বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে।”
মামলার কোনো পক্ষই ‘কর ফাঁকি’র কথা বলেনি উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে কর কর্তৃপক্ষ কোনো অভিযোগ নিয়ে আদালতে যায়নি। বরং অধ্যাপক ইউনূসই একটি আইনি সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতে গিয়েছিলেন।”
কর কর্তৃপক্ষ কখনই কোনো বিষয়ে ইউনূসের বিরুদ্ধে আদালতে যায়নি বলেও দাবি করে ইউনূস সেন্টার।
আরও পড়ুন
মামলা খারিজ, ১২ কোটি টাকা দানকর দিতেই হবে ইউনূসকে