Published : 04 May 2025, 09:55 PM
সিন্ডিকেট গঠন করে বদলি, দায়িত্ব বণ্টন, কার্যাদেশ উপেক্ষা করে পছন্দমত কোম্পানি থেকে তেল কেনাসহ বিভিন্ন অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় এক পুলিশ সুপারের (এসপি) বেতন গ্রেড কমিয়ে দিয়েছে সরকার।
চাকরিবিধি অনুযায়ী তার এসব কর্মকাণ্ডকে ‘অসদাচরণ’ হিসেবে গণ্য করে গত ৩০ এপ্রিল এক প্রজ্ঞাপনে তাকে প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা জরিমানা এবং বেতন গ্রেডের ‘নিন্মতর ধাপে অবনমিতকরণ’ দণ্ড দেওয়া হয়।
মোহাম্মদ নজরুল হোসেন নামে ওই এসপি বর্তমানে সিআইডি সদর দপ্তরে কর্মরত রয়েছেন। এর আগে এপিবিএন এর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্ড থাকার সময় তিনি এমন অনিয়মে জড়িত ছিলেন বলে প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
ওই এসপির বিরুদ্ধে গত ১৯ জানুয়ারি কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার বিরুদ্ধে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির সই করা এ আদেশ দেওয়া হয় ৩০ এপ্রিল, যা রোববার মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
আদেশের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এসপি নজরুল হোসেনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরকারি কর্মচারী বিধিমালা অনুযায়ী ‘দুর্নীতির’ প্রমাণ না পেলেও ‘অসদাচরণের’ প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
এসপি নজরুল এপিবিএন এ দায়িত্ব পালনকালে কয়েকজন পুলিশ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট গঠন করে ব্যাটালিয়নের বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়ার কথা তুলে ধরে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “সিন্ডিকেট সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে চিরকুট/টোকেনের মাধ্যমে ফান্ড/সেরেস্তায় পদায়ন হতে ইচ্ছুক সদস্যদের নাম/পদবি সংগ্রহ করে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে বদলি/পদায়নের ব্যবস্থা করেন।”
এতে বলা হয়, তিনি একই ব্যক্তিকে বিভাগীয় ভান্ডারে বারবার পদায়নের মাধ্যমে স্টোরের মালামাল বিলি-বণ্টনে অনিয়ম, কার্যাদেশ উপেক্ষা করে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি মূল্যে জেনারেটর কেনা এবং ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে প্রথম দরদাতাকে কার্যাদেশ না দিয়ে ২য়, ৩য়, ৪র্থ সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ প্রদানের অভিযোগ প্রমাণের কথা বলা হয়েছে।
এ অনিয়মের মাধ্যমে এসপি নজরুল সরকারের ৮ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭০ টাকা আর্থিক ক্ষতি করেছেন তুলে ধরে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ এর ৪(২) এর উপ-বিধি (১) (গ) অনুযায়ী সেই টাকা সরকারি কোষাগারে জরিমানা হিসেবে আদায় এবং বিধিমালার ‘৪(২) এর উপ-বিধি (১) (ঘ) অনুযায়ী’ আগামী তিন বছরের জন্য বেতন গ্রেডের ‘নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ' দন্ড প্রদান করা হয়েছে।”
যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা দ্বিতীয় এপিবিএন এর কমান্ড্যান্ট থাকাকালীন এসপি নজরুল তার রানার মোশারফ হোসেন তপাদারের মাধ্যমে ব্যাটালিয়নের ক্যান্টিন বরাদ্দে অনিয়ম করার অভিযোগ আনা হয়।
তার বিরুদ্ধে সদর ক্যান্টিনের দায়িত্ব পছন্দের ব্যক্তিকে প্রদান করা, ক্যান্টিন ও মেসে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা, যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও শান্তিপ্রাপ্ত এএসআই আল-আমিনকে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ করে ডি-স্টোরের মালামাল বিলি-বণ্টনের নামে লুটপাট করার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ তদন্ত করা হয়।
এছাড়া অ্যাডজুটেন্ট মুসলেম উদ্দিন, নায়েক-অভি কুমার এবং নায়েক- সিরাজুল ইসলামকে বদলি করার পরও দায়িত্বে বহাল রাখা, সব ক্রয় প্রক্রিয়ায় সিন্ডিকেটকে সন্তুষ্ট করে ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া ও ভুয়া ভাউচার সংগ্রহ করে ডি-স্টোরের কিছু মালামাল প্রদর্শন করে এক মাসের বরাদ্দ দিয়ে কয়েকমাস চালানো এবং বরাদ্দের বাকি অর্থ সিন্ডিকেট সদস্য, তিনি এবং তার স্ত্রীর মধ্যে ভাগাভাগি করার অভিযোগ ছিল এসপি নজরুলের বিরুদ্ধে।
এছাড়া নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তুলে পরস্পর যোগসাজশে চিরকুট/টোকেনের বিভিন্নজনকে সেরেস্তায় বদলি করা, পুলিশ সদরদপ্তর কর্তৃক প্রায় ৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকার কোডিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় মালামালের কোন বিতরণ রেজিস্টার সংরক্ষণ না করা এবং নিজ খেয়াল খুশিমত ইলেকট্রিক সামগ্রীর জন্য একটি রেজিস্টার খুলে ৪ লাখ ২৬ হাজার ১৪৫ টাকার সামগ্রী ক্রয় করে তা ব্যবহার ও এ বিষয়ে তিনি নিজে বা অন্য কোন কর্মকর্তাকেও তদারকির দায়িত্ব প্রদান না করার অভিযোগ রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগের মধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ৫২০ শতাংশ জমি তার স্ত্রী এবং স্ত্রীর বড় বোন কামরুন নাহারের নামে ৩৪ লাখ টাকা দিয়ে লিজ গ্রহণ করা এবং তার স্ত্রী ফয়জুন নাহারের নামে সেগুনবাগিচায় ফ্লাট ক্রয় করার জন্য ডাউন পেমেন্ট বাবদ ৩৫ লাখ টাকা এবং কিস্তি হিসেবে ৩০ লাখ টাকা পরিশোধ করার তথ্য সামনে আসে।
এর বাইরে নিজ উদ্যোগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে 'ধীরে বহে মুক্তাগাছা' নামে একটি পার্ক প্রতিষ্ঠা করেন, সেখানে ১০ টাকা মূল্যের টিকেটের বিনিময়ে প্রবেশের অনুমতিসহ বিভিন্ন সংগঠনকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট করা, সরকারি নিয়ম-কানুনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে দরপত্র সিডিউল প্রস্তুতের মাধ্যমে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাড়তি টাকায় জেনারেটর কেনা, দরপত্র জামানত বাজেয়াপ্ত না করার অভিযোগও আনা হয়।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘ব্যক্তিগত শুনানি’ অনুষ্ঠিত হয়। শুনানিতে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ‘প্রমাণিত হলে’ গুরুদণ্ড আরোপের সম্ভাবনা থাকায় তদন্তের জন্য এসবির ডিআইজি জি এম আজিজুর রহমানকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
তার দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে ‘অসদাচরণের’ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তির এ সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়।
তার এই শাস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি অন্যায় ও জুলুমের শিকার হয়েছি।
“আমি ফ্যাসিস্ট শাসনামলের আইজিপি বেনজীরের আক্রোশের শিকার হয়েছি। সে সময়ে আমার ১১ বার পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছে। ২০১৪ সালে সুনামগঞ্জের এসপি থাকাকালীন আমিই একমাত্র এসপি যাকে ওএসডি করা হয়েছিল।
“আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলো আপনারা স্থানীয় প্রতিনিধিদের দিয়ে যাচাই করুন। যদি এসব অভিযোগের একভাগও সত্যতা পাওয়া যায় তাহলে আমি স্বেচ্ছায় রিজাইন দিয়ে চলে যাব।”
অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে প্রজ্ঞাপণ হলেও বিষয়টির তদন্ত আগে হওয়ার তথ্য দিয়ে সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, “গত জানুয়ারিতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেই ভিত্তিতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আমি ন্যায়বিচার পাইনি।”
এই শাস্তির বিরুদ্ধে ‘আপিল’ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “৩০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়, আমি একটা আপিল করব। যদি ন্যয়বিচার না পাই স্বেচ্ছায় চলে যাব।”