গবেষণায় দেখা গেছে ৬৯ শতাংশ মানুষেই বার্তা বোঝে না। ফেনী, কুমিল্লার বন্যার্তরা বলছেন, তারা পানি ধেয়ে আসার কোনো ধরনের আভাস পাননি।
Published : 02 Sep 2024, 01:58 AM
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বাতাবাড়িয়া গ্রামের আরমান হোসেন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন হাঁটু পানিতে তলিয়েছে তার ঘর। সেখানে তিনি পরিবারের ১২ জন সদস্যকে নিয়ে টানা ৫ দিন বন্দি অবস্থায় ছিলেন।
তিনি বলছেন, সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন থেকে আবহাওয়ার ভারি বৃষ্টির যে বার্তা পাচ্ছিলেন সে টিকে তিনি বর্ষার স্বাভাবিক বৃষ্টি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন।
এই সতর্কতা থেকে এত বেশি বৃষ্টি এবং পরবর্তীতে যে বন্যা হবে সেটি আঁচ করতে পারেননি। বন্যা হবে স্থানীয়ভাবে সে প্রচার এবং সরকারি প্রশাসনিক কোনো কার্যক্রমও সেখানে হয়নি।
তার মতই পূর্ব বাতাবাড়িয়া গ্রামের মানুষরা এবার আকস্মিক বন্যায় বিকল্প ব্যবস্থাও নিতে পারেনি।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকের শিক্ষার্থী আরমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বার্তা বুঝতে তাদের কষ্ট হয়; সেই বার্তা দিয়ে তারা ভয়াবহতা কতটুকু হবে তা আঁচ করতে পারেন না।
“গ্রামের মানুষ তো আরও বুঝতে পারে না, এ কারণে সতর্কও হয় না। আগে জানতে পারলে এবং বুঝতে পারলে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া যেত। শহর বা উঁচু এলাকা দেখে থাকার ব্যবস্থা করতে পারতাম।”
বন্যায় ঘরের আসবাবপত্র সব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকগুলো হাঁস-মুরগি খুঁজে পাওয়া যায়নি, মাছের ঘের, পুকুর থেকে সব মাছ চলে গেছে।
“আগে সতর্ক হতে পারলে আমাদের এতটা ক্ষতি হত না।”
ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার কাজলের রেখা গ্রামের বাসিন্দা অনন মজুমদারেরও একই আক্ষেপ, বন্যা আসছে, সেটা যদি আগে জানা যেত!
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বিপৎসীমার উপর দিয়ে যে বলে এতে আমরা ধারণা নদীর তীর উপচে পড়বে। এগুলো বুঝতে কষ্ট হয়। সহজ ভাষায় প্রচার করলে আমরা বুঝতে পারতাম, সতর্ক হইতাম। অনেকের ঘরে কোমর পর্যন্ত পানি উঠছে, গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নষ্ট হইছে। এখনও পানিতেই থাকতে হচ্ছে।
“বন্যার পানি এলাকায় ঢুকার পর স্থানীয়ভাবে মাইকে বলা হইছে, ‘পানির লেভেল বাড়তে পারে; সতর্ক থাকবেন’। কিন্তু তখন আর লাভ হয়নি, এতে বোঝাও যায়নি বড় বন্যা হবে।”
উজানের তীব্র ঢল এবং অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত ২০ অগাস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। পরে দ্রুতই তা ছড়িয়ে যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
সরকারি হিসাবে এই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অর্ধ কোটির বেশি মানুষ, মৃত্যু হয়েছে ৫০ জনের বেশি।
অথচ উজানে ভারতে যে পানি বাড়ছে, সেই তথ্য বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র পেয়েছিল, আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছেও তথ্য ছিল যে ত্রিপুরায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হচ্ছে। এই পানি বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে যাবে, এই বিষয়টি অনুমেয়ই ছিল।
বার্তা বোধগম্য করার উপায়?
‘বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতি জনআস্থার নানা দিক’- বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আমিনুল ইসলামের করা একটি গবেষণা চলতি বছরের মার্চে প্রকাশ পেয়েছে।
সেখানে দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ মানুষের কাছে আবহাওয়ার বার্তা বোধগম্য নয়।
আমিনুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবাই বুঝবে এমন শব্দ ব্যবহার করতে হবে এবং এখানে একজন ল্যাঙ্গুয়েজ এক্সপার্ট এবং কমিউনিকেশন এক্সপার্টের কাজ করতে হবে।”
আবহাওয়ার বার্তা মানুষ মাঠপর্যায়ে কীভাবে গ্রহণ করে এ নিয়ে ২০০৭ সালের সিডরের পর গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা।
তিনিও বলছেন, পূর্বাভাসের ভাষা আগের চেয়ে সহজ এবং সঠিক হলেও যে অঞ্চলে বন্যা; ঘূর্ণিঝড় এসব হতে পারে সেখানকার মানুষের তা বোধগম্য না।
“সতর্ক সংকেতগুলোর স্থানীয় কিছু মিনিং আছে। আমরা যেভাবে ১ থেকে ১০ গ্রেড করি, তারা সেভাবে করে না। টেলিভিশনের স্ক্রলে সতর্কসংকেত দেওয়ার সময় গানের অনুষ্ঠান এসব চললে সেটাকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না।
“বিজ্ঞানসম্মত বার্তাটাকে সাহিত্য করা যাবে না, সাধারণ ভাষায় লিখতে হবে এবং কোন জনগোষ্ঠীর জন্য দেওয়া হচ্ছে সেটাকে টার্গেট করতে হবে। নির্দিষ্ট অঞ্চলভিত্তিক ভাষায় সেখানকার মিডিয়ায় প্রচার করতে হবে। ওই এলাকায় কোন মাধ্যমটা মানুষ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে সে ডেটা বের করে সেই মাধ্যমে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।”
পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর বলছেন, “নদীর পানি বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার বেড়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও ৫ সেন্টিমিটার বাড়বে; এতে মানুষ কী বুঝবে?
“আবহাওয়া অফিস বলেছে, ভারি বৃষ্টিপাত হবে। সাধারণ মানুষ জানে না, ভারি, মধ্যম ও হালকা বৃষ্টিপাত কী। পূর্বাভাসের পাশাপাশি সতর্কতাও জারি করতে হবে সঠিকভাবে। জ্যামাইকা, বার্বাডোজের মত ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দেশগুলোতে যেভাবে দেওয়া হয়।“
তাহলে কী করা যায়- এই প্রশ্নে আইনুন নিশাত বলেন, “সব দেশের পূর্বাভাসে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়; কোন জায়গাটা আক্রান্ত হতে পারে এবং সেখানে ঘূর্ণিঝড় হতে কতদূরে, বাতাসের গতিবেগ কত, কত ফুট জলোচ্ছ্বাস হতে পারে। বাংলাদেশের মত ১, ২, ৩ নম্বর এমন সতর্কতা কোথাও নেই। এ ধরনের সতর্কতা জাহাজের ক্যাপ্টেনদের জন্য তৈরি, যেটি কেবল পেশাদাররা বুঝবে; সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে না।
ধীরে ধীরে পূর্বাভাস ব্যবস্থাপনাটাকে স্থানভিত্তিক পদ্ধতিতে নিয়ে আসার পরামর্শ তার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, পূর্বাভাস ঠিক কি ভুল, এর চেয়ে যে ভাষায় বলা হচ্ছে অর্থাৎ মাঝারি থেকে ভারি, উত্তরপূর্ব এসব কেউ কখনও গ্রহণ করবে না।
“বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হবে, বিপৎসীমাটা কী? মানুষ তো সেটা জানে না। যে জায়গাটা ওই এলাকার মানুষ প্রতিদিন দেখে এ রকম একটা নিশানা ঠিক করে, এর উপর পানি গেলে বাধ ভেঙে যাবে; তার মানে বিপদ- এভাবে বলতে হবে।
“যার জন্য সংকেতটা, তার কাছে যেতে হবে, কোন ভাষায় দিলে সে বুঝবে এটা জানতে হবে। আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এবং মন্ত্রণালয়ের এই দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের অবস্থা যদি এমন হয়- ভারত যদি বলতও ‘আমরা আমাদের বাঁধ খুলে দিচ্ছি’, তাও একই ঘটনাই ঘটত।”
বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাসফিকুস সালেহীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বৃষ্টির পূর্বাভাস জানাটা জরুরি। বৃষ্টির পর সেটা মেপে জানানো হয় কত মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রয়োজন হয় পরের দিন বা তার পরের দিন কতটুকু বৃষ্টি হতে পারে সেটার।
“বাংলাদেশের উজানে বৃষ্টি কেমন হতে পারে সেটা তো ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দেয়; সবার কাছেই এভেইল্যাবল। তারপরও ভারতের সঙ্গে যদি কাজ করা যেত, তাহলে আরও উন্নত হত আমাদের পূর্বাভাস সিস্টেম।
“এক ঘণ্টা বা দু্ই ঘণ্টা পরপর আপডেট করে মানুষের কাছে তথ্যগুলো পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে পারে। এলাকাভিত্তিক পূর্বাভাস করে বলা যেতে পারে, এখানে ‘এই মাত্রার’ বন্যা হতে পারে, এই জায়গাগুলো ডুবে যেতে পারে ‘এত ঘণ্টার মধ্যে’। এই ধরনের তথ্য অ্যালার্ট সিস্টেমের মধ্যে থাকতে হবে। ৪/৫ ঘণ্টা আগেও এমন তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছানো গেলে কাজে দেবে।”
তার মতে, বিভাগ এবং অববাহিকা ভিত্তিক আভাস না দিয়ে স্কেলটাকে আরও কমিয়ে আনতে হবে। আর ২ বা ৩ নম্বর সতর্কসংকেতে মানুষ আরও বিভ্রান্ত হয়। পানি বিপৎসীমার ৫/৬ মিটার উপর দিয়ে যাবে বলার চেয়ে ওই এলাকায় বন্যা হবে কিনা, হলে কখন হবে এবং কী মাত্রায় হবে সেটা বলা উচিত।
“তখন মানুষ ভয়াবহতাটা বুঝবে। ৬ ঘণ্টা আগে রেড অ্যালার্ট দিলে মানুষ দ্রুত সেখান থেকে সরে যাবে। যখনই অ্যালার্ট সিস্টেম করে দেওয়া হবে তখন কোন কোন জেলা বা উপজেলা প্লাবিত হতে পারে সেভাবে বলা হবে।
“আরেকটু সাহস করে বলে দিতে হবে, কতটুকু বৃষ্টি হবে। অতি ভারি বৃষ্টি হবে বলছি মানে ৮৯ মিলিমিটারের বেশি, এর উপরে আর কিছু বলছি না। কিন্তু ৯০ আর ২৫০ মিলিমিটার তো অনেক তফাত। এটাকে আরেকটু স্পেসিফিক করতে হবে।”
সহজ ভাষায় প্রকাশ করবে কে?
ভারত এবং জ্যামাইকার আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা গেছে, নিয়মিত পূর্বাভাস দেওয়ার পাশাপাশি রং ভিত্তিক সতর্কতাও দিয়ে আসছে তারা। তবে বাংলাদেশের আবহাওয়ার ওয়েবসাইটে এমন দেখা যায় না। যদিও বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ সেটি করে আসছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পূর্বাভাসটা দাপ্তরিক ভাষায় লিখতে হয়; তারপরও সেটাকে আরও সহজভাবে বলার চেষ্টা করছেন তারা।
“যদিও এর দায়িত্ব পুরোপুরি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের, আমরা শুধু প্রস্তুতির কাজটা করি; দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তাই বলে। পানি বাড়বে কি কমবে, বন্যা হবে কি হবে না- এসব উল্লেখ করি আমরা। আরও সহজ কোন পরামর্শ পেলে আমরা সেভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করব।
“হলুদ এবং লাল অ্যালার্ট দিয়ে অলরেডি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করি, সেটার প্রচার না থাকলেও কীভাবে পৌঁছানো যায় সে চেষ্টা আমাদের সবসময় থাকে।”
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অধিদপ্তর বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সদস্য হওয়ায় তাদেরকে একটা ক্যাটাগরি মানতে হয়। তারপরও সহজ ভাষায় দেওয়ার বিষয়ে তাদের ভাবনা আছে।
“যদিও এটা আমাদের দায়িত্ব না, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কাজ। আর মাঝারি, ভারি বৃষ্টির মানে তো নিচে দেওয়া থাকে। বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনাকে তো মানতে হবে, এ কারণে অতি ভারি বলি। ভারতে যে কালার কোড দেয় সেটা প্রদেশভিত্তিক। আমাদের ওয়েবসাইটে তিন ঘণ্টা পরপর উপজেলা ভিত্তিক পূর্বাভাসও দেওয়া হয়।”
আবহাওয়ার নিয়মিত বুলেটিনে বিভাগ ভিত্তিক পূর্বাভাস দেওয়া হলেও অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে উপজেলা পর্যায়ের পূর্বাভাস জানার সুযোগ রয়েছে।
২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি নীতিমালা প্রকাশ করেছে। সেখানে সময়মত স্থানীয়দের কাছে বোধগম্য ভাষায় সতর্ক সংকেত এবং বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ করবে মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক- ই- আজম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। আমি সংশ্লিষ্ট জায়গায় আপনার বক্তব্যটি উপস্থাপন করব।”
আস্থার সংকট কেন?
গবেষণায় আবহাওয়ার বার্তা নিয়ে আস্থার শঙ্কটের বিষয়টিও উঠে এসেছে। তবে বিশেষজ্ঞ এবং আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো বলছে, এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সঠিক বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
‘বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রতি জনআস্থার নানা দিক’- ওই গবেষণা বলছে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে ৬৪ শতাংশের আস্থা একেবারেই কম। ৩৩ শতাংশের কিছুটা আস্থা আছে, আর আস্থা আছে মাত্র ৩ শতাংশ উত্তরদাতার।
গবেষণায় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আমিনুল ইসলাম তরুণ প্রজন্মের কাছে জানতে চান আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বার্তায় তাদের আস্থা কিনা। তবে সেখানে উত্তর আসে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য না।
কারণ হিসেবে তারা বলছে, যে খবরটা তারা পায় দৈনন্দিন জীবনে তার ঠিক উল্টোটা ঘটে। আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের কারণেও তাদের আস্থার শঙ্কট রয়েছে।
তিনি বলেন, “আবহাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য, কৃষি, সমাজব্যবস্থা, মানুষজনের ঘরে-বাইরে বের হওয়া সবকিছু নির্ভর করে। আস্থার প্রশ্নে সঠিক তথ্য দিতে হবে।”
আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট বার্তায় আস্থা ফেরাতে কী করা উচিত জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, “বাংলাদেশে দায়িত্বের অবহেলা রয়েছে; ফলে কাজের মাধ্যমে তা ফেরাতে হবে। মানুষ যখন দেখবে বুঝবে কথার সঙ্গে কাজের মিল আছে, এবং যাদের জন্য কাজ তাদেরকে নিয়ে কাজ করতে হবে।”
আস্থার প্রশ্নে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলেন, পূর্বাভাস হওয়ার ফলে এখানে ভুল বার্তা থাকতেই পারে। তারপরও ভুল বার্তার সংখ্যা তাদের কম রয়েছে বলে দাবি তার।
“খালি খালি মানুষকে আতঙ্কিত না করে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। ফেনী বন্যার সময়ও ১৬ তারিখ থেকে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছি। ১৯ তারিখ ফ্লাড অ্যালার্ট দিয়েছি, ২০ তারিখে হয়ে গেছে।”
এ বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, বর্তমানে তাদের ৮০ ভাগের উপর পূর্বাভাস সঠিক হচ্ছে।
“অনেক জায়গায় শতভাগও মিলতেছে। প্রাকৃতিক বিষয় কোথাও কোথাও কিছুটা না মিলতেও পারে।”
জনবল সংকট
২০১০ সালের ২৬ অগাস্ট হাই কোর্ট ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের জারি করা সামরিক শাসন, এর পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত জারি করা সকল সামরিক আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশ, সামরিক আইন আদেশ ও সামরিক আইন নির্দেশ, সব আদেশ, কার্যক্রম, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে।
পরের বছরের ১৫ মে আপিল বিভাগ এরশাদের শাসনামলে জারি করা সব সামরিক ফরমান, আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে। তবে ওই সময়কালের কিছু বিষয় শর্ত সাপেক্ষে মার্জনা করা হয়েছে। বহাল রাখা হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষে করা সব চুক্তি।
এই নির্দেশের আওতায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের নিয়োগ, পদোন্নতি চলে আসে, ফলে এরপর থেকে এসব বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মজিদুল ইসলাম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলছেন, তাদের প্রক্রিয়াধীন প্রস্তাবনায় ১ হাজার ৩৩৮ জনবল দরকার। কিন্তু এ সময়ে সারাদেশে পাঁচশও কম জনবল রয়েছে।
সারাদেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৬০টি অফিস রয়েছে, সেখানে প্রয়োজনের তিন ভাগের এক ভাগ লোক দায়িত্ব পালন করছে। বেশিরভাগ অফিস চলছে দুইজনকে নিয়ে।
আবহাওয়ার অফিসগুলো সাধারণত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, তিন ঘণ্টা পরপর সেখান থেকে আবহাওয়ার বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেক্ষেত্রে ৮ ঘণ্টার বদলে একেকজনকে ১২ ঘণ্টা ধরে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মজিদুল ইসলাম বলেন, “অমানবিক কাজ হচ্ছে। উপরি পাওনাও নেই তাদের, এই ডিউটিটা করার দরকার ৫ জনের। এটার ফলে তারা স্বাভাবিক ভাবেই ডিউটিতে ফাঁকি দেবে, ডেটা কোয়ালিটিও কমে যাচ্ছে। তাদের তো রেস্ট নিতে হবে, পরিবার আছে। হয়ত তৈরি করা ডেটা পাঠাচ্ছে তারা।”
ঢাকার অফিসেও জনবল কম থাকায় প্রয়োজনের অর্ধেক লোক দিয়ে দায়িত্ব পালন করাতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
মজিদুল বলেন, “প্রতি বছর অবসর নেওয়ার ফলেও সংখ্যাটা কমছে। কিন্তু ওই জায়গাটার ঘাটতি পূরণ হচ্ছে না। অবশিষ্ট জনবলের উপর চাপ পড়ছে। ৮ ঘণ্টার জায়গায় বাধ্য হয়ে ১২ ঘণ্টা, ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে। একেকজনকে একাধিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। গবেষণার সময় পাচ্ছে না। নতুন নিয়োগের জন্য ২০১৫ সাল থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখনও সঠিকভাবে নিয়োগবিধি তৈরি হয়নি।”
চার জন নিয়ে চলছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া জানান, অন্তত ১১ জনের প্রয়োজন রয়েছে তাদের।
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কতটুকু?
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলছে এ বিষয়ে তাদের কোনো সংকট নেই।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, “আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট না থাকলেও জাপান, কোরিয়া, চীনের স্যাটেলাইট থেকে তথ্য নেওয়ার সুযোগ আছে। রাডার ব্যবস্থা আছে। প্রযুক্তিগত কোন অসুবিধা নেই।”
আর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম বড়ুয়া বলছেন, “টেকনোলজির সঙ্গে আপডেট থাকার চেষ্টা করি, এটা প্রতিনিয়তই চেইঞ্জ হয়।”
আরও পড়ুন:
বন্যা আসছে জেনে কী করেছে বাংলাদেশ?
বন্যা মোকাবিলা: ভারতের সঙ্গে 'উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা' চান ইউনূস
ডাম্বুর গেট খোলার কথা কেবলই 'অপপ্রচার': ত্রিপুরার মন্ত্রী
অগাস্টের বন্যার এমন ভয়াল রূপ কেন?
প্রাণে বাঁচার পর এবার কিস্তি শোধের দুশ্চিন্তা
উজানের দেশের কাছে 'যথাসময়ে' বন্যার পূর্বাভাস চাওয়া হবে: রিজওয়ানা
ফেনীর বন্যা: 'হাইল্লা তোয়াই হাইয়ের না, চাইল দি কিয়া করমু?'