ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, পানি নেমে যাওয়ার পরপরই ঋণের টাকা আদায় করতে আসবেন বিভিন্ন সংস্থার কর্মীরা।
Published : 01 Sep 2024, 01:42 AM
বেসরকারি একটি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে কয়েক মাস আগে নতুন ঘর করেছিলেন ফেনীর ফাজিলপুর উপজেলার শিবপুরের বাসিন্দা ঠাকুর চান দাশ। কিন্তু পরিবার নিয়ে তার নতুন ঘরে থাকার সুখ ভেসে গেছে এক সপ্তাহের বন্যায়।
বানের পানি ধীরে ধীরে সরতে শুরু করলেও কবে কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন, কীভাবে ঘুরে দাঁড়াবেন আর ঋণের কিস্তিইবা পরিশোধ করবেন কীভাবে- এসব নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় সময় কাটছে ঠাকুর চানের।
ফেনীর বানভাসি বিভিন্ন উপজেলার অনেক খেটেখাওয়া মানুষের দশাও ঠাকুর চানের মতই।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত ফেনীর বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অনেক গ্রাম, সড়ক ও ঘরবাড়ি এখনও পানির নিচে থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় পরিস্থিতি উন্নতির দিকে।
এসব এলাকায় কয়েকদিন ধরে পানি নামতে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ।
বন্যার ক্ষত দৃশ্যমান হচ্ছে পানি নেমে যাওয়ার পর। পানিতে অনেকের গোলার ধান ভেসে গেছে, কারও ভেঙেছে ঘর। কারও ঘর টিকে থাকলেও বানের পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে জিনিসপত্র।
বানভাসি মানুষের সঙ্গে কথা জানা গেছে, তাদের এখন নতুন চিন্তা- কীভাবে তৈরি হবে ঘর? কীভাবে চলবে সামনের দিনগুলো। পাশপাশি তাদের দুঃশ্চিন্তার আরেকটি কারণ বিভিন্ন এনজিও বা সমিতি থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে।
বানের পানির কারণে ঠাকুর চান স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ফাজিলপুর রেল স্টেশনে। গত রোববার তার সঙ্গে কথা হয় সেখানে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে ঠাকুর চান বলেন, ২০ অগাস্ট থেকে তাদের এলাকায় পানি উঠতে শুরু করে। পানি এত দ্রুত বাড়ে যে, পরদিন দুপুরের মধ্যে ঘর তলিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচাতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে স্টেশনে ঠাঁই নেন।
ঠাকুর চানের ভাষ্য, নিজের কিছু জমানো টাকার সাথে বিভিন্নজনের কাছ থেকে ধার ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ঘর তৈরি করেছিলেন। গত মাসের শুরুর দিকে নতুন ঘরে উঠলেও বানের পানিতে ভেঙে গেছে সেটি।
“যেদিন পানি উঠছে, ওই দিন সকালে বাজারে পান বিক্রি করে দুপুরে বাড়িতে গেছিলাম। বানের পানিতে পানভর্তি ভ্যান গাড়ি ভাসি (ভেসে) গেছে।”
এখন নতুন করে ঘর তৈরি আর ঋণের টাকা পরিশোধের চিন্তায় দিশেহারা অবস্থা বলে জানালেন তিনি।
বন্যায় ঘর ডুবে যাওয়ায় প্রতিবেশীর পাকা ভবনে আশ্রয় নিয়েছিলেন সোনাগাজী উপজেলার সুলাগালী গ্রামের রহিমা খাতুন।
চার দিন পর সোমবার বিকাল থেকে পানি কমতে শুরু হলে মঙ্গলবার ঘরে ফিরে রহিমা দেখেন, কোনো কিছুই আগের মত নেই। গোলার ধান, পোষা হাঁস-মুরগী সবই গেছে তার।
রহিমার ভাষ্য, ঠিকমত ত্রাণও পাননি তিনি। খাবার জোগানের পাশাপাশি কয়েকটি ঋণের কিস্তি কীভাবে পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে তাকে।
সাপ্তাহিক, মাসিক কয়েকটি ঋণের কিস্তি শোধের দায় রয়েছে এই নারীর।
গ্রাম পুলিশ সদস্য আব্দুর শুক্কুর মাসে সাড়ে ছয় হাজার টাকা ভাতা পান। কিন্তু তা তিন মাস অন্তর হাতে আসে।
কোরবানির ঈদের আগে ভাতা পেয়েছিলেন শুক্কুর। নতুন ভাতা পাওয়ার আগেই সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন তার চাকরি থাকবে কি না বা ভাতা আসবে কি না, সেটা নিয়ে যত চিন্তা শুক্কুরের।
সমস্যার কথা বলতে গিয়ে শুক্কুর বলেন, সাপ্তাহিক ও মাসিক কিস্তিতে ঋণ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে ১১ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে।
বানের পানিতে ঘরবাড়ি নষ্ট হওয়ায় কী করবেন, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না শুক্কুর।
সোনাগাজীর আমিরাবাদ ইউনিয়নের চরডুব্বা গ্রামের হাজেরা বেগম ও বাচারা বেগমের চিন্তাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে।
তাদের ভাষ্য-, চার দিন আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে সোমবার বাড়ি ফিরেছেন তারা। পানিতে বাড়ির সবকিছু নষ্ট হয়েছে। সেগুলো ঠিক করতে হবে, আবার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, যেসব এনজিও বা সমিতি থেকে তারা ঋণ নিয়েছিলেন, তাদের কর্মীরা বন্যার কারণে টাকা আদায় করতে আসেননি। কিন্তু পানি নেমে যাওয়ার পরপরই তারা আবার সক্রিয় হবেন। ঋণদাতা সংস্থাগুলোও ঋণ মওকুফ বা পরিশোধ নিয়েও কিছু জানায়নি।
সবমিলিয়ে এই দুর্ভোগ কতদিন বইতে হবে, সেটাই এখন ঋণগ্রস্তদের ভাবনা।