বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের পর তিনি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাকি বৃষ্টি খাতুন, তা নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রান্তি।
Published : 10 Mar 2024, 10:42 PM
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে ‘অভিশ্রুতি শাস্ত্রী’ পরিচয়ে সাংবাদিকতা করা যে তরুণীর মৃত্যু হয়েছে, তিনি যে কুষ্টিয়ার খোকসার শাবরুল আলম ওরফে সবুজ শেখের মেয়ে, সেটির প্রমাণ মিলেছে ডিএনএ পরীক্ষায়।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক সেই মৃত্যুর পর তিনি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নাকি বৃষ্টি খাতুন, এ নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা।
ঢাকার একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করা তরুণী নিজেকে অভিশ্রুতি পরিচয় দিয়ে রমনা কালীমন্দিরে পূজা-অর্চনাও করতেন। সহকর্মীরা তাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হিসেবেই জানত।
তবে মরদেহ নিতে এসে সবুজের বক্তব্যে তৈরি হয় প্রশ্ন। তিনি দাবি করেন, মেয়েটির নাম বৃষ্টি খাতুন, অর্থাৎ তিনি মুসলমান পরিবারের সন্তান।
সবুজ সেই তরুণীর যে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়েছিলেন, তাতে বৃষ্টি খাতুন নাম দেখে ‘প্রতারক’ ভেবে পুলিশ তাকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদের পর অবশ্য ছেড়ে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে বন্ধু ও পরিচিতজনদের বক্তব্যে উঠে আসে নানা বক্তব্য। এমন বর্ণনাও আসে যে, মেয়েটি মনে করতেন তিনি পালিত সন্তান। তার আসল বাবা-মা ছিলেন ভারতের, তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।
সবুজ যখন তার বক্তব্যে অটল, তখন ডিএনএ পরীক্ষায় পরিচয় শনাক্তের কথা বললে তাতে রাজি হন তিনি।
১০ দিন পর সেই পরীক্ষার ফল মিলেছে।
সবুজ ও তার স্ত্রী বিউটি বেগমের দেওয়া ডিএনএ নমুনার সঙ্গে ওই নারী সাংবাদিকের ডিএনএ নমুনা মিলেছে বলে জানিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি।
সিআইডির ডিআইজি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম রোববার রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে দুটি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছিল না ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে একটির পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তিনি কুষ্টিয়ার খোকসার শাবরুল আলম সবুজের মেয়ে সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুন।”
তবে রোববার রাত পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারকে কিছু জানানো হয়নি বলে জানান বৃষ্টির চাচাত ভাই টিটু হোসেন। তিনি বলছেন, “বৃষ্টির বাবা মেয়ের লাশ বুঝে নিতে অপেক্ষায় আছেন। তবে এখনো পুলিশের তরফ থেকে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।”
এক প্রশ্নে সিআইডি কর্মকর্তা নাহিদুল ইসলাম বলেন, “যেহেতু পরিচয় শনাক্ত হয়েছে, এখন আমরা মরদেহ হস্তান্তর করে দেব।”
মরদেহ দুটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা আছে।
অভিশ্রুতি-বৃষ্টির বিভ্রান্তি নিয়ে কী তথ্য
অভিশ্রুতি নামে সেই তরুণী কাজ করতেন দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ নামের একটি নিউজ পোর্টালে। সম্প্রতি সেই চাকরি ছেড়ে দেন, তার যোগ দেওয়ার কথা ছিল আরেকটি সংবাদমাধ্যমে।
রিপোর্ট ডট লাইভ ছেড়ে কেস্টারটেক নামে একটি অনলাইন মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে যোগ দেওয়া তুষার হাওলাদারের সঙ্গে গ্রিন কোজি কটেজে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন ‘অভিশ্রুতি’। তুষারও মারা যান সেই রাতে।
বিশের ঘরের ওই তরুণীর জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নামের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন গরমিল পাওয়া গেছে।
লাশ গ্রহণ করতে ১ মার্চ সবুজ শেখ বলেন, “ওর ডাক নাম বৃষ্টি খাতুন। গ্রামে নাম বৃষ্টি, স্কুলে নাম বৃষ্টি, কুষ্টিয়া গভর্নমেন্ট মহিলা কলেজে যখন পড়েছে, তখনও বৃষ্টি, ঢাকাতে যখন ভর্তি হয়েছে ইডেন কলেজে, ঢাবি সাত কলেজের অধীনে, তখনও বৃষ্টি, দর্শনে পড়াশোনা করে রোল নম্বর ২৭৬, তখনও বৃষ্টি।”
তিনি জানান, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেয়ের মন্দিরে যাওয়ার তথ্য জানতেন। তবে এর বেশি কিছু জানতেন না।
রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলছেন, নিয়মিত মন্দিরে এসে হিন্দু ধর্ম চর্চা ও পূজা-অর্চনা করতেন ওই নারী সাংবাদিক।
কাগজপত্রে গরমিল
অভিশ্রুতি বা বৃষ্টির জন্ম নিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, ইডেন কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার প্রবেশপত্র এবং চাকরির জন্মবৃত্তান্তে বাবা-মায়ের নামে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গেছে। তবে, স্থায়ী ঠিকানা সব জায়গায় একই।
২০২১ সালের ৬ জুলাই ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম বৃষ্টি খাতুন হিসাবেই রয়েছে। সেখানে পিতার নাম সবুজ শেখ এবং মাতার নাম বিউটি বেগম। কলেজের প্রবেশপত্রেও তার একই রকম তথ্য আছে।
২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর ইস্যু করা জন্ম নিবন্ধন সনদে নাম অভিশ্রুতি লেখা হলেও বাবার নাম লেখা হয়েছে মো. শাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম।
অন্যদিকে, চাকরির জন্মবৃত্তান্তে নিজের নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী লিখেছেন তিনি। তবে, বাবার নাম লেখা হয়েছে শাবুরুল আলম এবং মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী।
জন্ম নিবন্ধন সনদ এবং জন্ম বৃত্তান্তে জন্ম তারিখ ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর রয়েছে। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রে তার জন্ম তারিখ ৯ মার্চ ১৯৯৮।
অভিশ্রুতির সাবেক কর্মস্থল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের চিফ রিপোর্টার গোলাম রাব্বানী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চাকরির বায়োডাটায় তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। সবুজ শেখই অভিশ্রুতির বাবা এবং বিউটি বেগমই তার মা।
“অভিশ্রুতি হিন্দু ধর্ম চর্চা করতেন বলেই আমরা দেখেছি। নিয়মিত পূজা-অর্চনা করতে মন্দিরে যেতেন। জন্ম নিবন্ধনে তিনি নাম পরিবর্তনও করেছেন। ধর্ম পরিবর্তনের চেষ্টায় থাকতে পারেন হয়ত।”
নাম বা বা ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়ে প্রশ্নে সবুজ সেদিন বলেন, “ধর্ম পরিবর্তনের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো হদিস নাই। আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ নাই যে, ধর্ম পরিবর্তন করছে, নাম পরিবর্তন করছে আমরা জানি না।
অভিশ্রুতি অথবা বৃষ্টি খাতুন, কেন পরিচয় বদলেছিলেন তিনি?
অভিশ্রুতি-বৃষ্টি: ‘বাবার’ পর ‘মায়ের’ ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ
“এক বছর আগে আমি একবার শুনেছি, মন্দিরে গেছে। একজন মন্দিরে যাওয়ার ছবি দেখিয়েছে। তখন আমাকে জানাইছে। হিন্দু বন্ধুবান্ধবদের সাথে চলাফেরা করে, একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেছে, তাদের সাথে গেছে। এটার সত্য-মিথ্যা জানি না।”
রমনা কালী মন্দির কমিটির সভাপতি উৎপল সাহা বলেন, “তার পার্সোনাল বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সাথে যতটুকু শেয়ার করেছে, সেটুকু বলি- সেটা হচ্ছে তার ফ্যামিলি বেনারসে ছিল এবং তার পিতৃ পরিচয়, বেনারসে বাবা ও মা একটি মন্দিরে সেবায়েত হিসাবে ছিল, সেই জায়গা থেকে আসছে।”
“তার ফাদার-মাদার ওখানে মৃত্যুবরণ করার পরে, কোনো একটা ঘটনাচক্রে, সেটি আমাদের কাছে উন্মোচিত হয়নি, বা সেটি বলেনি, ঘটনাচক্রে সে বাংলাদেশে কুষ্টিয়াতে এসেছে এবং এখানে সে পড়াশোনা সে মুসলিম ফ্যামিলিতে করেছে, এটুকু আমরা জানি। এটুকু আমরা শুনেছি তার কাছ থেকে।”