‘আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি চাই’
Published : 29 Sep 2024, 07:52 PM
এক ছেলেকে হারিয়ে আরেক ছেলের জীবন নিয়ে শঙ্কায় রূপসী চাকমা। বেঁচে থাকা ছেলেটিকেও রাস্তাঘাটে মেরে ফেলা হবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটছে এই মায়ের।
এই মা বলেন, “আমার পরিবারের সবাই এখন আতঙ্কে রয়েছে। আর কোনো মা তার ছেলেকে এভাবে না হারাক, এটাই চাই। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি চাই।”
সম্প্রতি দিঘীনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে সংঘাতের ঘটনার তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার দাবিতে রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানেই কথা বলছিলেন রূপসী, তার ছেলে জুনান চাকমা ওই সংঘাতে নিহত হয়েছেন।
রূপসী বলেন, “আমার ছেলে কোনো দলীয় রাজনীতিতে ছিল না, খুবই নিরীহ ছাত্র ছিল। তবুও হত্যা করা হয়েছে তাকে।”
নিহত জুনান ও রুবেলকে ‘শহীদ’ হিসেবে বর্ণনা করে রূপসী বলেন, “ছেলে হারানোর কষ্ট কতটুকু, সেটা মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমি যেভাবে আমার ছেলে হারিয়েছি, সেভাবে যেন আর কেউ না হারায়।”
জুনানের কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রূপসী। প্রথমে বাংলায় বক্তব্য শুরু করলেও বেশিদূর এগোতে পারেননি তিনি, কষ্টের কথাগুলো চাকমা ভাষাতেই বর্ণনা করেন। তখন তার বক্তব্য আরেকজন বাংলায় অনুবাদ করে দেন।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় জুনান চাকমা এবার পানছড়ি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির স্বনির্ভর এলাকায় গুলিতে নিহত হন তিনি।
একই স্থানে গুলিতে মারা যান রুবেল ত্রিপুরা। ওই দিন বিকালে দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের সময় প্রতিপক্ষের বেধড়ক পিটুনতে ধনরঞ্জন চাকমাও নিহত হন।
নিহতদের পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে বিচারের দাবি জানান।
রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা ত্রিপুরা বলেন, “আমার সন্তান রাজমিস্ত্রীর কাজ করে পরিবার চালাত। ১৯ তারিখ রাতে যখন দীঘিনালায় হামলা হয়, তখন খাগড়াছড়িতেও হামলার একটা আশঙ্কা ছিল। তাই হাজারো যুবক পাড়ায় পাড়ায় দায়িত্ব পালন করতে যায়।
“ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে বলে শুনেছি। ছেলের আয়েই পরিবার নির্ভর করত। আমার ছেলের এ বছরই নতুন ঘর তোলার কথা ছিল।”
ধনরঞ্জন চাকমার ছেলে বিনক চাকমা দীঘিনালার সংঘাতের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, “এখন আমরা বাজারে-দোকানে গেলেও ভয় হয়।”
সংঘর্ষে আহত রাঙামাটি সদরের বাসিন্দা কুকুমনি চাকমা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান।
তিনি বলেন, ১৯-২০ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও স্বনির্ভরে এবং রাঙামাটি শহরে পাহাড়িদের ওপর হামলা হয়। এই হামলায় চারজন নিহত ও শতাধিক মানুশ আহত হন, যারা সবাই পাহাড়ি।
গুরুতর আহত দু'জন চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তাদের সংজ্ঞাও নেই।
দীঘিনালায় ১০৫টি দোকান ও রাঙামাটিতে ছোট-বড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “হামলাকারী সেটেলার বাঙালিরা রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা চালায় এবং সেখানে গ্যারেজে রাখা নয়টি গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়।”
সেদিন বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মৈত্রী বিহারেও হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। পরে প্রশাসন রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করে।
বৃহস্পতিবার সরকার একটি তদন্ত কমিট গঠন করলেও এই ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে এখনও ভয় ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
হামলার সূত্রপাত যেভাবে
সংবাদ সম্মেলনে একটি সংবাদমাধ্যমকে উদৃত্ত করে বলা হয়, ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামে এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু হয়।
প্রথম দিকে খাগড়াছড়ি মডেল থানার ওসি আব্দুল বাতেন মৃধা বলেছিলেন, একটি মোটরসাইকেল চুরি করে পালানোর সময় বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা খেয়ে মামুন আহত ও পরে হাসপাতালে মারা যান।
মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার ১৯ সেপ্টেম্বর বাদী হয়ে খাগড়াছড়ি মডেল থানায় তিনজনের নামসহ একটি হত্যা মামলা করেন।
আসামিরা হলেন, খাগড়াছড়ির সদর উপজেলার শালবন (শাপলার মোড়) এলাকার মো. শাকিল (২৭), পানখাইয়া পাড়ার রফিকুল আলম (৫৫) এবং ওই পাড়ারই দিদারুল আলম (৫০)। এ ছাড়া তিনি অজ্ঞাত ১০ থেকে ১২ জন ‘পাহাড়ি ও বাঙালিকে’ আসামি হিসেবে তুলে ধরেন এজাহারে।
মামুনকে ‘পাহাড়িরা হত্যা করেছে’ অভিযোগ তুলে ১৯ সেপ্টেম্বর বাঙালি ছাত্র পরিষদ দীঘিনালা সদরে একটি মিছিল বের করে। তারা ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের কালো হাত ভেঙে দাও, পাহাড়িদের ধরে ধরে জবাই কর, আমার ভাই মরল কেন প্রশাসন জবাব চাই'- এমন সব স্লোগান দেন।
সেখান থেকে মধ্যরাতে ‘পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা মারছে, গুলি করছে’ বলে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর সেটলাররা পাহাড়িদের দোকানে ব্যাপক লুটপাট চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলায় মোট ১০৫টি দোকান পুড়ে যায়, যার মধ্যে বাঙালিদের ২৬টি ও পাহাড়িদের ৭৯টি।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ওই ঘটনার প্রতিবাদে পাহাড়িরা মাইনি ব্রিজ এলাকায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করলে ‘ফাঁকা গুলি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ’ করে দেওয়া হয়। এসময় ধনরঞ্জন চামকা আঘাত পান এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন; হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান।
১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালায় সেটলাররা পাহাড়িদের ওপর হামলা, দোকানে লুটপাট ও উপদ্রুত অঞ্চলে আগুন দেওয়া হলেও অনেক বাঙালি এই হামলা থেকে বিপদগ্রস্ত পাহাড়িদের রক্ষা করেছে বলে তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
কুকুমনি চাকমা বলেন, দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে হাজারো পাহাড়ি রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা সেনাবাহিনীর সামনেই বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।
দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে সেনা-সেটলার হামলার প্রতিবাদে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামে একটি সংগঠন রাঙামাটি শহরে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। এসময় মিছিলের পেছন দিকে হামলা হয়, অনিক কুমার চাকমা (১৯) নামে এক ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
কুকুমনি বলেন, “ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলে, আমরা পাহাড়ি জনগণও নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আত্মমর্যাদাসহ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু আজ এ হামলার পর আমাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। সরকার ঘটনা তদন্তের জন্য ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, কিন্তু এই কমিটির ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। “
পরিবারের দাবি
পাহাড়ে যা ঘটেছে, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তার তদন্ত চান হতাহতদের পরিবারের সদস্যরা। সেই সঙ্গে বেশ কিছু দাবি তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তুলে ধরেছেন।
দোষীদের শাস্তি, নিহত-আহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, আহতদের সুচিকিৎসা, সহিংসতার সঙ্গে জড়িত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত এবং প্রচলিত ও সেনা আইনে বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের দাবি তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, “জুলাই-অগাস্টের হত্যার বিচার চাইছি, তাহলে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের হত্যার বিচার চাইব না কেন? দেশটা সবার। সবার সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে। আমি পার্বত্য চুক্তিকে শান্তি চুক্তি বলতে চাই। তাহলে সেই চুক্তি কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না?”