প্রাথমিক বৃত্তির ফলাফলে এই বিভ্রাটে বিশ্বাস নড়ে গেছে অনেক অভিভাবকের।
Published : 04 Mar 2023, 12:44 AM
“মেয়েটা স্কুলের ফার্স্টগার্ল, ওর টিচার-আমরা সবাই ভেবেছিলাম ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাবে, কিন্তু প্রথম ফলে পেল সাধারণ গ্রেডের বৃত্তি। পরে যখন সংশোধিত ফল বের হল তখন দেখা গেল আমার মেয়েটা বৃত্তিই পায়নি। মেয়েটা এতো বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে, কী বলব, ওর মন খারাপ দেখে আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেছে।”
রাজধানীর সাউথপয়েন্ট স্কুল থেকে ২০২২ এর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় বসেছিল আদিবা চৌধুরী (ছদ্মনাম)। বৃত্তি পেয়েও আবার তা বাতিল হওয়ায় আদিবার ভেঙে পড়ার কথা জানাচ্ছিলেন তার মা।
হতাশা প্রকাশ করে তিনি বললেন, “হুট করেই সরকার ওদের বৃত্তি পরীক্ষায় বসাল। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা, সেই পরীক্ষায় আবার ফলাফল নিয়ে এতো গণ্ডগোল। ছোট মানুষ এরা, এদের তো মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। একদিনের ব্যবধানে ফল বদলে তারা কী এমন পরিবর্তন এনেছে আমি বুঝতে পারছি না।”
মেয়ের সাথে ঘটে যাওয়া এই ঘটনায় আদিবার মায়ের ‘ভরসা উঠে গেছে’ সরকারি পাঠ্যক্রম থেকেও। এই অভিভাবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, “সিক্সে যখন উঠল তখনই দেখলাম নতুন কারিকুলাম দিয়েছে সেটাও নাকি পরীক্ষামূলক। ফাইভের বৃত্তিটাও তাদের দিয়েই শুরু করা হল। আমি তো আমার বাচ্চাকে বারবার গিনিপিগ বানানোর জন্য দিতে পারি না। যে ম্যাসাকারটা এখন আবার বৃত্তি নিয়ে হল, তাতে এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমি আর মেয়েকে রাখব না, ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়ে দেব।”
পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়ে নিম্ন মাধ্যমিকে পা রাখা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা কারা সরকারি বৃত্তি পাবে, তা নির্ধারণে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রায় এক যুগ পর পুনরায় চালু হওয়া এই বৃত্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে মঙ্গলবার। কিন্তু ‘কারিগরি ত্রুটি’র কথা বলে সেদিনই আবার ফল স্থগিত করা হয়। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ করা হয় সংশোধিত ফলাফল।
স্থগিত করা ফলাফল প্রকাশ করে অধিদপ্তর জানায়, মঙ্গলবার বৃত্তিপ্রাপ্তদের যে সংখ্যা প্রকাশ করা হয়েছিল-সংশোধিত ফলাফলে সেটিই রয়েছে।
সংখ্যা এক থাকলেও ফল পাল্টে যায় অনেক শিক্ষার্থীর। প্রথম প্রকাশিত ফলে ট্যালেন্টপুল বা সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পেয়েছে– এমন শিক্ষার্থীদের কারো কারো রোল সংশোধিত ফলে বৃত্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় আর দেখা যায়নি। আবার প্রথম ফলাফলে বৃত্তি পায়নি এমন অনেক শিক্ষার্থী সংশোধিত ফলাফলে বৃত্তি পেয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এই ঘটনাটিকে বলছেন, ‘দুঃখজনক’। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের কারিগরি জায়গাকে তো আমরা এখনো বিশ্বমানের জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি। ভুল হতেই পারে। কিন্তু এত বড় কারিগরি ত্রুটি হবে যে পুরো ফলাফলই পালটে ফেলতে হবে- এটা দুঃখজনক।”
২০২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষা দেয় সারা দেশের ৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৯ জন শিক্ষার্থী।
দেশের প্রতিটি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে এবার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
বাংলা, প্রাথমিক গণিত, ইংরেজি ও প্রাথমিক বিজ্ঞান এ চারটি বিষয়ে বৃত্তি পরীক্ষা হয়। মোট নম্বর ছিল ১০০; সময় ছিল-২ ঘণ্টা।
এ বছর বৃত্তি পাচ্ছে মোট ৮২ হাজার ৩৮৩ জন ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে ৩৩ হাজার জন ট্যালেন্টপুলে (মেধাবৃত্তি) এবং ৪৯ হাজার ৩৮৩ জন সাধারণ বৃত্তি পেয়েছে। স্থগিত করার পর সংশোধিত ফলাফলেও এই সংখ্যা ঠিক রাখা হয়েছে।
ট্যালেন্টপুল বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ৩০০ টাকা এবং সাধারণ গ্রেডে বৃত্তিপ্রাপ্তরা মাসে ২২৫ টাকা করে পাবে। তাছাড়া উভয় ধরনের বৃত্তিপ্রাপ্তদের প্রতি বছর ২২৫ টাকা করে এককালীন দেওয়া হবে। এই বৃত্তি তারা পাবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।
যে ম্যাসাকারটা এখন আবার বৃত্তি নিয়ে হল, তাতে এই শিক্ষাব্যবস্থায় আমি আর মেয়েকে রাখব না, ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়ে দেব।একজন অভিভাবক
বৃত্তির এমন ফলাফল পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে সারা দেশের অনেক বিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্তের সংখ্যাতেও। ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা থেকে অংশ নেওয়াদের মধ্যে একজন ছাত্রী স্থগিত ফলাফলে বৃত্তি পেলেও সংশোধিত ফলে তার রোল আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার বৈখেরহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে স্থগিত করা ফলাফলে কেউই বৃত্তি না পেলেও সংশোধিত ফলাফলে বিদ্যালয়টি থেকে দুজন ট্যালেন্টপুলে এবং দুজন সাধারণ কোটায় বৃত্তি পেয়েছে।
একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ বলেন, এখানে দেখার বিষয় দুটো।
“শিক্ষার্থীর দিক থেকে দেখলে ব্যাপারটা তাদের জন্য অনেক খারাপ। এটি তাদের সামনের দিনের জীবনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারাতে পারে। আবার আরেক দিক থেকে দেখলে, ফলাফল সংশোধন না হলে যার আসলেই পাওয়ার কথা সে বঞ্চিত হত।
“তাই কেউ যেন ভেঙে না পড়ে, কেউ যেন বঞ্চিত না হয় সেজন্য কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল শতভাগ সচেতন থেকে ফলাফল তৈরি করে তা প্রকাশ করা।"
সারাদেশে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও এই ফল বিভ্রাটের প্রভাব পড়েছে৷
প্রথমবার ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেও পরে সংশোধিত তালিকায় আর নাম আসেনি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার নবীপুর গ্রামের এক ছাত্রের। তার পরিবারের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা নিয়ে ছেলেটা ও বাসার সবার খুব মন খারাপ। সবাইকে বলে দিছিল বৃত্তি পাইছে। এখন না পাওয়ায় কষ্ট পাইছে অনেক।”
নেত্রকোণা সদর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম ফলাফলে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল সাউদা আহমেদ তোয়া। কিন্তু সংশোধিত ফলাফলে তার রোল দেখা যায় সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পাওয়াদের তালিকায়।
তোয়ার বাবা সাফায়েত আহমদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমার মেয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাইছিল। তার রোলটা এখন সাধারণ গ্রেডে চলে গেছে। অসম্ভব কষ্ট পাইছে সে। গতরাতেও খুব কান্নাকাটি, আমরা বাবা মা, আত্মীয়-স্বজন মিলে তাকে থামাতে পারি নাই। মন ভালো করার জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসছি। আমাদেরও তো মন খারাপ।"
তার এলাকায় অনেকের ক্ষেত্রেই এমন পরিবর্তন দেখা গেছে বলে জানালেন সাফায়েত আহমদ। তিনি বলেন, “নেত্রকোণা সদরে এমন অনেক শিক্ষার্থীর ফলাফল বদলে গেছে। আগে বৃত্তি পাওয়া অনেকে নতুন তালিকায় নাই, আবার কয়েকজন নতুন ফলাফলে পাইছে, কিন্তু আগের ফলাফলে সে বৃত্তি পায় নাই।
"আমার বয়স হয়ে গেছে ৫০ এর উপরে। এমন নজির আমি আর দেখি নাই। এইটার কারণে শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মধ্যে হতভম্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নতুন এই ফলাফলও অনেকে বিশ্বাস করতে পারতেছে না।"
কতজনের ফল পাল্টালো, জানে না কেউ
মোট বৃত্তিপ্রাপ্তের সংখ্যা এক থাকলেও কতজন শিক্ষার্থীর ফলাফলে পরির্তন এসেছে তা জানাতে পারেননি একটি জেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, এমনকি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও।
নেত্রকোণা জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তাহমিনা খাতুন বলেন, "আমাদের জেলায় কত শিক্ষার্থীর ফলে এমন পরিবর্তন এসেছে সে পরিসংখ্যান আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। শিক্ষার্থী-অভিভাবক কেউ সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে একজন ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন কী অবস্থা। আমাদের কাছে তো মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি, আসলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব৷"
ফল পাল্টানোর সংখ্যা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. ফারুক আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "কত শিক্ষার্থীর ফল সংশোধিত তালিকায় পাল্টেছে তা অধিদপ্তর ভালো বলতে পারবে। যা ঘটে গেছে, এটা তো দুঃখজনক। কিছু করার নেই, ভবিষ্যতে যেন এমন না হয় সেই চেষ্টা করতে হবে।"
আর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, “এই ডেটা তো একটা একটা করে দেখতে হবে, সফটওয়্যারে কমান্ড দিলে চলে আসবে। তবে ওই সঠিক হিসাবটা আমরা করিনি।”
শিক্ষার্থীর দিক থেকে দেখলে ব্যাপারটা তাদের জন্য অনেক খারাপ। এটি তাদের সামনের দিনের জীবনের উপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে, অনেকেই আত্মবিশ্বাস হারাতে পারে। আবার আরেক দিক থেকে দেখলে, ফলাফল সংশোধন না হলে যার আসলেই পাওয়ার কথা সে বঞ্চিত হত।মাসুম বিল্লাহ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক
নজর দেওয়ার জায়গা যেখানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা অল্প বয়সের ছেলেমেয়ে, এদের বৃত্তি পরীক্ষাটা জীবনের প্রথম কোনো বড় পরীক্ষা। তাদের ফলাফল দেওয়ার আগে এটা কয়েকবার চেক করা দরকার ছিল। একবার দেওয়া হল, একরকম পরে আবার সেটা পালটে গেল, এটা তাদের জন্য এক ধরনের মানসিক পীড়ার কারণ। মনে হচ্ছে এটা ছেলেখেলা, কিন্তু এটা তো ছেলেখেলা নয়।”
তার পরামর্শ, “আমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবক দুপক্ষেরই এখন দায়িত্ব এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বোঝানো যে ওটা ভুল ছিল, এ নিয়ে কষ্ট পাওয়ার বা ভেঙে পড়ার কিছু নেই।
“ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন না হয় তার জন্য একটাই উপায় সঠিক মানুষকে সঠিক জায়গায় নিয়োগ দিতে হবে। কারিগরি দিক দিয়ে দক্ষ ও যোগ্য জনবলকে এসব জায়গায় নিয়োগ দিলে এমন ভুলের পরিমাণ কমে আসবে।”
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, “বৃত্তি পেয়েও যাদের ফল পাল্টেছে, তাদের মন খারাপ হবে এটা স্বাভাবিক। তারা বাচ্চা, বড়দেরই মন খারাপ হয়। বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল পরিবর্তনে দেখা যায় বড় হলেও শিক্ষার্থীরা ভেঙে পড়ে। কিন্তু আমাদের বৃত্তির সংখ্যা যেহেতু ফিক্সড, এর মধ্যেই আমাদের থাকতে হবে। এর মধ্যেই আমরা কাজ করছি।”
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, যান্ত্রিক কিছু ত্রুটি ধরা পড়ায় ফল স্থগিত করা হয়েছে। তবে সেই ত্রুটি ঠিক কোথায় ছিল, সেটা স্পষ্ট করা হয়নি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে।
ফলাফলে ত্রুটির কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব মোছা. নূরজাহান খাতুনকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের ওই কমিটিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (আইএমডি) এবং মন্ত্রণালয়ের সিস্টেম অ্যানালিস্ট সদস্য হিসেবে থাকছেন। তাদের তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
পুরনো খবর: