সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে যেসব প্রাণহানি হয়েছে, সেজন্য দায়ি করা হচ্ছে চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশত্যাগ করা শেখ হাসিনাকে।
Published : 15 Aug 2024, 01:38 AM
ছাত্র-জনতার প্রবল গণ আন্দোলনে সরকার পতনের আগে-পরে দাবি উঠেছে ‘গণহত্যার’ বিচারের; দেশ ছাড়ার ৯ দিনের মধ্যেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তদন্তের আবেদন হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে, যেটি তিনি নিজেই গড়ে ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠলে যেসব প্রাণহানি হয়েছে সেজন্য দায়ি করা হচ্ছে চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনাকে।
বুধবার একই দিনে সহিংসতার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিচারের আওতায় আনতে একটি হত্যাসহ দুই মামলার পর গণহত্যার অভিযোগ তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন জমা পড়ে।
এক আইনজীবীর করা এ আবেদনে তদন্তের কার্যক্রম এগোলে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নিজের গড়া ট্রাইব্যুনালেই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামী লীগ সভাপতিকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের এ সংক্রান্ত এক বক্তব্য আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করার খবর এল।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এমন আবেদনের পর যুদ্ধাপরাধের বাইরে সাম্প্রতিক ঘটনায় ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যায় কি না সেই আলোচনাও সামনে আসে। এ নিয়ে মিলেছে দুই আইনজীবীর বিপরীতমুখী বক্তব্য।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন অগাস্টের শুরুতে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিনশ মানুষের প্রাণ যায়।
ছাত্র-জনতার ঢাকামুখী লংমার্চের দিন গত ৫ অগাস্ট দুপুরে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবর আসে। সেদিন বিকালে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান সাংবাদিকদের বলেন, পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথমে হেলিকপ্টার ও পরে সামরিক বিমানে চড়ে আগরতলা হয়ে সেদিন রাতেই দিল্লি পৌঁছান বাংলাদেশের টানা ১৫ বছরের প্রধানমন্ত্রী। এখনও তিনি সেখানেই আছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেলবিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সহিংসতার ঘটনাগুলোকে বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তারা।
এরই মধ্যে গত দুদিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে তিনটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দুটি পৃথক অভিযোগ হত্যার ঘটনায় এবং অন্যটির অভিযোগ অপহরণ ও নির্যাতনের।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, “১৯৭৩ সানের যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) অ্যাক্ট আছে, যেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধন হয়েছে, সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, জুলাই গণহত্যা বলতে আমরা অগাস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এটার জন্য দায়ী যে ব্যক্তিবর্গ আছেন, উনাদের বিচারের জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উনাদের বিচারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটা ছোটখাটো গবেষণার মত করেছি।
“করে দেখেছি, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।”
আইসিটিতে ছাত্র হত্যার মামলা চালানোর জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকেও পুনর্গঠন করার কথাও এদিন বলেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিন মামলার পর ট্রাইব্যুনালে আবেদন
কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতন আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বুধবার সকালেই সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘গণহত্যার’ ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উদ্যোগ নেবে।
তার এই বক্তব্যের কয়েক ঘন্টার মধ্যে কোটা সংস্কার ঘিরে সংঘটিত ‘হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের’ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন এক আইনজীবী।
বুধবার করা এ আবেদনে আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয়।
সরকারি চাকরিতে কোটা আন্দোলনের সময় নিহত বাগেরহাটের আরিফ আহমেদ সিয়ামের বাবা মো. বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বুধবার এ আবেদন জমা দেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান এমন আবেদন জমা হওয়ার তথ্য দিয়ে এটি তদন্তের প্রক্রিয়া শুরুর কথা বলেছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা অভিযোগটি গ্রহণ করেছি। এরপর পেপার ওয়ার্ক হবে, আমরা ঘটনাস্থলে যাব, সারাদেশে যেখানে যেখানে ঘটনা হয়েছে সব জায়গায় গিয়ে তদন্ত করা হবে। তারপর প্রতিবেদন জমা দেব।”
অভিযোগের সময় ও ঘটনাস্থলের বিষয়ে আবেদনকারী আইনজীবী তামিম সাংবাদিকদের বলেন, “১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ অগাস্ট ২০২৪ পর্যন্ত দেশে ছাত্র-জনতার উপর যে গণহত্যা চলেছে সেই গণহত্যাকে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে তদন্ত করার জন্য আমি একটি দরখাস্ত এনেছি।
“যাদের ‘ইনস্টিগেটিং’ বক্তব্যের কারণে পুলিশের কিছু সদস্য, র্যাবের কিছু সদস্য রাস্তায় নির্মমভাবে আমাদের ছোট ছোট শিশুকে গুলি করে হত্যা করেছে। এটা গণহত্যা হয়েছে। এই সিস্টেম ক্রাইম, এই পরিকল্পিত ক্রাইম-এটা একমাত্র এই ট্রাইব্যুনালেই হওয়া সম্ভব।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য যাদের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করা হয় তারা হলেন সাবেক সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এবং সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
এছাড়া রয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক মো. হারুন অর রশিদ।
একই অপরাধে ব্যক্তির পাশাপাশি দল এবং সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার আর্জি জানানো হয়েছে বলে অ্যাডভোকেট তামিম জানান।
তিনি বলেন, ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযোগটি তদন্ত করবে এবং সত্যতা পেলে মামলা করার সুপারিশ করবে। এরপর এই অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে মামলা দায়ের করা হবে।
তামিম আরও বলেন, এসব আসামির পাশাপাশি নাম উল্লেখ না করে শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা চাওয়া হয়েছে আবেদনে।
শেখ হাসিনার নামে তিন মামলা
আগের দিন হত্যা মামলার পর বুধবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা এবং অপহরণ-নির্যাতনের অভিযোগ পৃথক দুই মামলা হয়েছে।
মিরপুরে গুলিতে ফয়জুল ইসলাম রাজন নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বুধবার কাফরুল থানায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের নিহত ওই শিক্ষার্থীর ভাই মো. রাজীব (৩২) বুধবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের মামলার আবেদন করলে শুনানি নিয়ে হাকিম আহমেদ হুমায়ুন কবির অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে কাফরুল থানাকে নির্দেশ দেন।
শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজন হত্যার মামলার প্রথম আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
অন্য আসামিরা হলেন- হাসিনা সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এমপি মইনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান কচি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজি মেজবাউল হক সাচ্ছু, এমপি কামাল আহম্মেদ মজুমদার, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মানুন, অতিরিক্ত আইজিপি ও র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, স্থানীয় আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা সালামত উল্লাহ সাগর, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সদস্য দীপংকর বাছার দীপ্ত।
এছাড়াও এ মামলায় আওয়ামী লীগের আরও ৫০০ থেকে ৬০০ নেতাকর্মীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
এর আগে বুধবার সকালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে এবার অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা।
তার জবানবন্দি শুনে ঢাকার মহানগর হাকিম ফারজানা শাকিল সুমু চৌধুরী অভিযোগটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন।
মামলায় হাসিনা ছাড়াও তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, র্যাবের সাবেক ডিজি বেনজীর আহমেদ এবং র্যাবের অজ্ঞাতপরিচয় ২৫ সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে মঙ্গলবার শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয় ঢাকার আদালতে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় ওই মামলা দায়ের করা হয়। আদালত অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করতে মোহাম্মদপুর থানাকে নির্দেশ দেয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন পাস হয়।
দীর্ঘদিন সেই ট্রাইব্যুনালে বিচার না হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর আইনে কিছু সংশোধনী আনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার।
এরপর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিচারপতি নিজামুল হককে চেয়ারম্যান, বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদকে সদস্য করে বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গঠন করা হয়।
এরপর ২০১২ সালের ২২ মার্চ প্রতিষ্ঠা করা হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে এই আদালতের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক শাহীনুর ইসলাম।
২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল থেকে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের প্রথম মামলার রায় আসে। ওই মামলায় পলাতক যুদ্ধাপরাধী মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছিল।
এরপর ‘মিরপুরের কসাই’ হিসাবে খ্যাত জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে আপিলের ক্ষেত্রে আসামি ও প্রসিকিউশনের সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। সেই পথ ধরে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বরে।
মাওলানা আজাদ, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদদের মত যুদ্ধাপরাধীদের মোট ১১টি রায়ের পর ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে অকার্যকর আছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।
এখনও কার্যকর থাকা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ এ পর্যন্ত একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪৪ মামলার রায় এসেছে।
জামায়াত নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিচারের রায় রয়েছে তার মধ্যে।
ট্রাইব্যুনাল যাত্রা শুরুর পর সেখানে প্রথম ৫১ মামলার রায়ে দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল শেষে এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একজন বিএনপির।
আইসিটির এখতিয়ার কী?
এই সময়ে সংঘটিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যাবে কি না, তা নিয়ে দুই আইনজীবী দুই রকম বক্তব্য দিয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের অধীনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জড়িতদের বিচার করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে সদ্য পদত্যাগ করা প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।
তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী সেই ট্রাইব্যুনালেই এসব অপরাধের বিচার করা সম্ভব বলে মনে করছেন আইনজীবী গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম।
এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রশ্নে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পরে কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। তাহলে কীভাবে এখানে এই বিচার হবে, সেটা আমার পক্ষে বোধগম্য নয়।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় বিচারকাজ পরিচালনার তিনটি দিক তুলে ধরে এই অধিকার কর্মী বলেন, “এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় তিনজন বিচারক থাকবেন তারা কোর্ট, প্রসিকিউশন টিম থাকবে, তদন্তকারী সংস্থা থাকবে।
“এখন আমরা দেখছি, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এটিকে এফআইআর হিসেবে গণ্য করে এটি পিবিআইকে তদন্ত করতে দেয়া হল। আপনি যদি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে চান, তাহলে মামলা দায়ের হলে সেটাকে আবার আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে গঠিত তদন্ত সংস্থায় পাঠাতে হবে।
“দেশীয় যেসব তদন্ত সংস্থা রয়েছে, এদের আওতায় এটা পড়ে না। আর অন্যদিকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে, ৩০২ নম্বর ধারা দিয়েছে। এই নরমাল প্যানেল কোর্ট আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের আইনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।”
অন্যদিকে আইনজীবী গাজী মনোয়ার হোসেন তামিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এর ধারা – ৩ এর উপধারা ১ অনুসারে ‘টার্গেটেড পিপলের’ উপর হত্যা, গণহত্যা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের বিচার হতে পারবে। এখানে দেশে আন্দোলনরত জনগোষ্ঠীর উপর গণহত্যা চালানো হয়েছে-কোনো একক ব্যক্তির উপর নয়।
“এ আইনের প্রস্তাবনায় স্পষ্ট বলা আছে আইনটি পাস হওয়ার আগে ও পরের যে কোনো হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের বিচার এই ট্রাইব্যুনালে হতে পারবে। এখানে ইতোমধ্যে ৫৬টি বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এখন এটা ‘স্যাটেলড’। বিচার করতে কোনো সমস্যা নেই।”
১৯৭১ সালে দেশের মুক্তিকামী মানুষকে টার্গেট করায় যেমন সেটা গণহত্যা হয়েছিল, ঠিক এবারের আন্দোলনেও ওই টার্গেট পিপলকে হত্যা করা হয়েছিল; তাই সেটা গণহত্যা বলে তিনি মত দেন।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির (পেনাল কোড) ৩০২ ধারায় যে মামলা হয়েছে তা উল্লেখ করলে তিনি বলেন, “এ ঘটনায় পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় মামলা চলতে পারে না। কারণ এটা কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়নি। এখানে একটা গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে হত্যা চালানো হয়েছে। তাই এটা গণহত্যা। ৩০২ ধারার মামলাগুলো বরং এখানে নিয়ে আসা উচিত।”
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তে আবেদন
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে 'জুলাই গণহত্যার' বিচারের উদ্যোগ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবার 'অপহরণ-নির্যাতনের' মামলা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ