“বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব,” বলেন আইন উপদেষ্টা।
Published : 14 Aug 2024, 12:05 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ‘গণহত্যার’ ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচার করার উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বুধবার সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, “গণহত্যা এবং গুলিবর্ষণ এই সমস্ত ঘটনার জন্য কিছু মামলা হয়েছে আপনারা জানেন। রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন যে, এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করার স্কোপ আছে কি না। আমরা সেটা খতিয়ে দেখেছি।
“১৯৭৩ সানের যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্রুনাল অ্যাক্ট আছে, যেটা পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সংশোধন হয়েছে, সেই আইনে আমরা জুলাই গণহত্যা, জুলাই গণহত্যা বলতে আমরা অগাস্টের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাও বোঝাচ্ছি, এটার জন্য দায়ী যে ব্যক্তিবর্গ আছেন, উনাদের বিচারের জন্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উনাদের বিচারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে একটা ছোটখাটো গবেষণার মত করেছি; করে দেখেছি, এই আইনের অধীনে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা, যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।”
সেক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুনির্দিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ওইসব ঘটনার বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে কি না, তা জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।
জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “আইসিটিতে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে, এটা ক্যাটাগরিকালি বলতে পারেন।”
বিষয়টি আরো ব্যাখ্যা করে আইন উপদেষ্টা বলেন, “সাবেক সরকারের সরকারপ্রধানসহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাদের আদেশ নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, আমরা পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখেছি। আমরা এখানে কোনো ছাড় দেব না। আমরা বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটা পর্যন্ত খতিয়ে দেখব।”
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরুর পর সেখানে ৫১ মামলার রায় এসেছে; দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর আপিল শেষে এ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নেতা, একজন বিএনপির।
সেই আদালতে ছাত্র হত্যার মামলা চালানোর জন্য ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থাকেও পুনর্গঠন করার কথা বলেন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেন, “একটি ইনভেস্টিগেশন টিম আছে, প্রসিকিউশন টিম আছে। এগুলোকে আমরা রিঅর্গানাইজড করার চেষ্টা করছি, আদালতটা একটু পরে করব। ইনভেস্টিগেশন আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার চেষ্টা করছি। জাতিসংঘ থেকে বারবার আমাদের সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বিচারের সত্যিকারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে আমাদের ইনভেস্টিগেশন টিম কাজ করবে। সেটার লক্ষ্যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করব।”
এ বিষয়ে ঢাকায় জাতিসংঘের আসাবিক প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “তারিখ চূড়ান্ত হয়নি। সহযোগিতা চাইব। এ ছাড়া, আমাদের আরও উচ্চ পর্যায় থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থা আছে, উনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। আশা করছি, দ্রুত এটা শুরু করতে পারব।”
বিচার বিভাগীয় সব কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দেশে-বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব বিবরণী আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্য জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান উপদেষ্টা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য কোনো দেশের আইনজীবী যদি জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পক্ষে লড়তে বাংলাদেশে আসতে চান, সরকার তাতে বাধা দেবে না।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রনি হত্যার বিচারেও গতি আসবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “আমরা গুমসহ অন্যান্য বিষয়ের বিচারেও আগাব। কিন্তু আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি জুলাই হত্যাকাণ্ডকে। এটাকে প্রাধান্য দিয়ে বিচার করা হবে,” বলেন উপদেষ্টা।
আয়না ঘর
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর কাউন্টার-টেরোরিজম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) পরিচালিত একটি গোপন আটক কেন্দ্রের নাম হল আয়নাঘর। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে নেত্র নিউজের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আয়নাঘরে বলপূর্বক আটকদের নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়। শেখ হাসিনার পতনের পর আবার আলোচনায় উঠে এসেছে ‘আয়নাঘর’।
আয়নাগরের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য কীভাবে প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, “এটার বিচার করা যায় কিনা সেটার জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। এটার ক্ষেত্রে বিগত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখে উনাদেরও বিচার করা সম্ভব বলে আমরা মনে করছি।
“ভিকটিম পরিবারের বিচার পাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। আপনারা জানেন পুলিশ বাহিনীকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ছাত্রলীগের মত ঐতিহ্যবাহী সংগঠন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকা রাখা সংগঠনকে কি ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে। আমরা শুধু পুলিশ, ছাত্রলীগের অপরাধ দেখলেই তো হবে না, যাদের আদেশে তারা করেছে সে যদি সর্বোচ্চ পর্যায়েরও হয়, তাদেরকেও এই আইনের আওতায় বিচার করা সম্ভব।”
অর্থপাচার ও দুর্নীতি
অর্থপাচার নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে আইন উপদেষ্টা বলেন, “এগুলোরও বিচার করার ইচ্ছা আছে। আমার দেশের সম্পদ, আমার দেশের ব্যাংক লুটপাট করে নিয়ে যাবে, এগুলো আমার আপনার টাকা। এগুলোরও বিচার হবে। জনগণের টাকা যারা লুটপাট করে নিয়ে গেছে সেই টাকা ফেরৎ আনা এবং তাদের বিচার করা অবশ্যই আমাদের কর্তব্য।”
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার হবে কিনা এমন এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অবশ্যই। এই আইনের যতগুলো নিবর্তনমূলক ধারা রয়েছে, যেগুলোর কারণে মানুষ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারছিল না, সেগুলো বাতিল করা হবে।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোন কোন ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার উদ্যোগ নেবে জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, “সাবেক সরকার এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বৈষম্যের বীজ রোপণ করে গেছে। এই বৈষম্য এত সর্বব্যাপী, আপনারা সবাই জানেন। এটা আইডেন্টিফাই করার কিছু নাই। তবে ধর্মের ভিত্তিতে, রানীতির ভিত্তিতে যেসব বৈষম্য হয়েছে এগুলো আমরা আইডেন্টিফাই করব।”