শেখ হাসিনা সরকারের সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক আইজিপিসহ তিন পুলিশ কর্মকর্তাকেও আসামি করা হয়েছে মামলার আর্জিতে।
Published : 13 Aug 2024, 01:13 PM
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় পুলিশের গুলিতে এক দোকান মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হত্যা মামলার আবেদন সরাসরি এজাহার হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
গুলিতে নিহত মুদি দোকান মালিক আবু সায়েদের ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ এস এম আমীর হামজার (শাতিল) দায়ের করা মামলা গ্রহণ করে ঢাকার মহানগর হাকিম রাজেশ চৌধুরী মঙ্গলবার এ আদেশ দেন।
দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় দায়ের করা এ মামলা আদালত আমলে নেওয়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হবে।
শেখ হাসিনা ছাড়াও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. হারুন অর রশীদ এবং যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারকে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে।
পাশাপাশি পুলিশের অজ্ঞাতনামা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাদের এ মামলায় আসামি করার আবেদন করেছেন মামলার বাদী।
সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলন অগাস্টের শুরুতে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়। জেলায় জেলায় সহিংসতায় মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রায় তিনশ মানুষের প্রাণ যায়। ৫ অগাস্ট আন্দোলনারীদের ঢাকামুখী লংমার্চের মধ্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করেন এবং পালিয়ে ভারতে চলে যান। এরপর তার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম মামলা।
এজাহারে যা বলা হয়েছে
মামলার এজাহারে বলা হয়, “কোটা আন্দোলনের মধ্যে গত ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুরে বছিলার ৪০ ফিট এলাকায় ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিল-সমাবেশ করছিল। সেখানে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। রাস্তা পার হওয়ার সময় স্থানীয় মুদি দোকানি আবু সায়েদ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।”
মামলার বাদী এজাহারে বলেন, নিহত আবু সায়েদের পরিবার অত্যন্ত গরীব। তার পরিবার পরিবার থাকে পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায়। তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না। এ কারণে সচেতন নাগরিক হিসেবে এ হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে তিনি আদালতে মামলা করেছেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলন কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে পুলিশের আইজিপি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধীন পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়ে মিছিলে গুলি চালান। পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। কাজেই এর বিচার হওয়া প্রয়োজন।”
কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
মামলার এক নম্বর আসামি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এজাহারে তার বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়েছে, তিনি আন্দোলন ‘শক্ত হাতে’ দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
দুই নম্বর আসামি আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে আন্দোলন দমনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিন নম্বর আসামি সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন, চার নম্বর আসামি ডিএমপির (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, ছয় নম্বর আসামি ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং সাত নম্বর আসামি যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তাদের অধীন পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেন।
অপরদিকে মামলার পাঁচ নম্বর আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন বলে মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে। আর অন্য ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর নির্দেশে হত্যাকাণ্ড ঘটান বলেও এজাহারে বলা হয়েছে।
বাদীর অভিযোগ, “ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ ছাত্র-জনতাকে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে হত্যা করেন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এসব হত্যার বিচার হওয়া আবশ্যক। আবু সায়েদ হত্যার তদন্ত হলে অজ্ঞাতপরিচয় আরও তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যদের নাম উঠে আসবে।”
ফৌজদারি মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা আমলযোগ্য। এসব মামলায় পুলিশ গ্রেপ্তাতারি পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে। সুতরাং আদালত যখনই মামলার আবেদনটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন, তখনই স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তাতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেছে। এ ধারাটি জামিনযোগ্য নয় এবং আপোষ যোগ্য নয়। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।”
মামলার অপর একটি ধারা হলো, দণ্ডবিধির ১৪৯ ধারা। এ ধারা অনুযায়ী বেআইনি সমাবেশে থাকা কোনো সদস্য কোনো অপরাধ করলে অন্য সদস্যরাও একই অপরাধে দোষী হবে।
আমিনুল গণী টিটো বলেন, “এ অপরাধটির জন্য বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা গেলে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারে, অন্যথায় নয়। অর্থাৎ পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চাইলে তা পাবেন না।
“অপরাধটির জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেওয়ার মত বা সমন দেওয়ার মত পরিস্থিতি থাকলে তা আদালত দিতে পারবেন। আর অপরাধটি মীমাংসাযোগ্য বা আপোষযোগ্য নয়। পরিস্থিতি অনুযায়ী এ ধারায় জামিন মিলতে পারে। ১৪৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে প্রকৃতির অপরাধ হয়েছে সেই প্রকৃতির সাজা হবে।”
এ মামলায় আরেকটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে, যেটি দণ্ডবিধির ৩৪ ধারা। এ ধারার সংজ্ঞা হল, ‘সাধারণ অভিপ্রায়’। অর্থাৎ কিছু মানুষের একই ধরনের ইচ্ছা কিংবা বাসনার দরুন কোনো অপরাধমূলক কাজ।