‘নরেন্দ্র মোদী ম্যাজিকে’ যেন হাওয়ায় ভাসছিল বিজেপি, আগেরবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় যাদের আসন সংখ্যা ছিল ৩, তারা এবার ঘোষণা দিয়েছিল, জিতবে এবার ২০০টিতে।
Published : 03 May 2021, 01:41 AM
কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, আকাশে ওঠার সেই স্বপ্ন থেকে তাদের মাটিতে নামিয়ে এনেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস।
বাম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ভারতের বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্যটিতে এক দশক আগে ক্ষমতায় আসা মমতা ‘রাম শাসনের’ অপেক্ষা দীর্ঘ করে টানা তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন।
ভোটে নিজে হারলেও জোড়াফুলের এই বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “বাংলার জয় ভারতকে বাঁচাল।”
“এই ভোটে জিতে গোটা দেশের প্রধান বিরোধী মুখ হয়ে উঠলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,” বললেন তার নির্বাচন কৌশলী প্রশান্ত কিশোর।
তাদের এই কথার প্রতিফলন ধরা পড়ে বিশাল ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অভিনন্দন বার্তায়। ধরা পড়ে আরও চারটি রাজ্যে ভোট হলেও পশ্চিমবঙ্গের ফল নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমের মাতামাতিতে।
কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে এক সময় বিজেপির হাত ধরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া মমতা হালে বিজেপি প্রধানমন্ত্রীর মোদীর চরম বিরোধী হিসেবেই পরিচিত করেছেন নিজেকে।
ভারতের পার্লামেন্টে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্যে প্রধান বিরোধী দল বলে কিছু যখন নেই, তখন মমতাকে নিজেদের কণ্ঠস্বর ভাবছেন আঞ্চলিকসহ সর্বভারতীয় দলগুলোর নেতারাও।
আসাম ও ত্রিপুরা করায়ত্ত করে পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিলেন মোদী। ফলে এবারের বিধানসভা নির্বাচন ‘মোদী ভার্সাস মমতা’ লড়াইয়ে রূপ নিয়েছিল।
গেরুয়া শিবিরের প্রচারে বলা হচ্ছিল, এবারই মমতার বিদায় হবে। ২ মের পর ক্ষমতা থেকে তাকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও বলছিলেন অমিত শাহ।
আর তাদের এই আশায় সাহস জোগাচ্ছিল গত লোকসভা নির্বাচনের ফল। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পদ্মফুল ২৯৪টির মধ্যে মাত্র ৩টিতে জিতলও ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখায় চমক।
জাতীয় নির্বাচনে সেবার মোদীর দল ১৮টি আসনে জেতে, আর তার সঙ্গে তুলনা করলে এবার বিধান সভায় ১২১ আসনে জেতার কথা তাদের।
কিন্তু রোববার রাত নাগাদ ২৯২টি (দুটি আসনে ভোট স্থগিত) আসনের মধ্যে সর্বশেষ ঘোষিত ফল অনুযায়ী ২১৩টি আসনে তৃণমূল জয়ী হচ্ছে বলে আনন্দবাজার জানিয়েছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী বিজেপি জিতছে ৭৭ আসনে।
এনডিটিভি জানাচ্ছে, তৃণমূল পেতে যাচ্ছে ২১০টি আসন, বিপরীতে বিজেপি পাচ্ছে ৮০টি আসন। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, ২১৪টি আসনে জিততে যাচ্ছে তৃণমূল, আর বিজেপির আসন সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৭৮।
অর্থাৎ এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে তৃণমূল ২০০ এর বেশি আসন পেতে যাচ্ছে, যেখানে ১৪৮ আসন পেলেই তারা সরকার গড়তে পারে। আর বিজেপির আসন ১০০ পার হচ্ছে না। তবে তারা প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে।
আর এটাও মোটামুটি নিশ্চিত, কংগ্রেস কিংবা বামফ্রন্ট কোনো আসনেই জিতছে না। তবে তাদের মোর্চা থেকে শুধু ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)’ একজন প্রার্থী জিততে যাচ্ছেন।
তৃণমূল জিতলেও তাদের নেত্রীর হার এই নির্বাচনে তাদের জন্য কাঁটা হয়ে বিঁধছে। তৃণমূলত্যাগী শুভেন্দু অধিকারীর চ্যালেঞ্জ নিয়ে নন্দীগ্রামে প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা। নাটকীয়তার ফল ঘোষণার পর দেখা যায়, ১৬২২ ভোটে হেরেছেন তৃণমূল প্রধান।
মমতা নিজে ভোটে হারলেও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দলকে বিজয়ী করাকে বড় করে দেখছেন ভারতের অন্য রাজনীতিকরা।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন এই জয়কে দেখিয়েছেন এভাবে- ‘মোদী+শাহ+বিজেপি+সিবিআই+ইডি+ইসি+গদি মিডিয়া+বিশ্বাসঘাতক’ মিলেও মমতাকে হারাতে পারেনি।
মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী টুইট করেছেন- “বিজেপিকে সহজেই হারিয়ে দেওয়ার জন্য মমতাজী ও পশ্চিমবঙ্গের জনগণকে অভিনন্দন।”
মমতার জয়কে সহজ করতে বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় প্রার্থী দেয়নি উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তেজস্বী যাদব মমতার সঙ্গে দেখা করে সমর্থন জানিয়েছিলেন। অখিলেশ যাদব প্রচারের জন্য পাঠিয়েছেন তার দলের রাজ্যসভা সদস্য জয়া বচ্চনকে।
ভোটগণনার সঙ্গে সঙ্গেই মমতাকে একের পর এক শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন এনসিসির শারদ পাওয়ার, কাশ্মিরের ওমর আবদুল্লাহ, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটে জিতে মোদী ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে সরাসরি মোদীর বিরোধিতা করে যাচ্ছেন মমতা। বারবার বিরোধীদের একজোট হওয়ার ডাক দিচ্ছেন।
কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক দলগুলোকে জোটবদ্ধ করতে সক্রিয় রয়েছেন মমতা। বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে মোদীবিরোধী প্রচারে নিজের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। মহারাষ্ট্রে উদ্ধব সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের হয়েও সরব হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে অখিলেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কাশ্মিরে মেহবুবা মুফতি, ওমর আবদুল্লাদের আটক করার প্রতিবাদও জানাচ্ছেন।
Bengal is a decisive win for the"idea of India", an inclusive, pluralist India where your religion or region don't matter. It shows BJP's electoral juggernaut is not invincible. And it reasserts the value of a federal India where States resist the overweening power of the Centre.
— Shashi Tharoor (@ShashiTharoor) May 2, 2021
এক্ষেত্রে লোকসভা কিংবা রাজ্যসভায় না থেকেও গোটা ভারতে মোদীবিরোধী শীর্ষনেতা হিসেবে মমতা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আর অন্য নেতারাও দৃশ্যত এখন ভরসা রাখছেন তার উপরই।
তাই মমতাকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি তীব্র কটাক্ষ করেছেন মোদীকেও। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী দিনে বাকি বিরোধী দলগুলোও রুখে দাঁড়াবে।
টানা দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর মোদী-অমিত শাহ জুটি সর্বভারতীয় দলগুলোকে কোনঠাসা করে ফেলার পর আঞ্চলিক দলগুলোকেও অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিচ্ছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে মমতার এই জয় বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্য সবাইকে প্রেরণা জোগাবে বলে মনে করছে আনন্দবাজার।
কারণ তাদের ভাষায়, ‘মোদী-শাহের অশ্বমেধের ঘোড়ার লাগাম টানলেন’ তো মমতাই।