পশ্চিমবঙ্গে পদ্ম এবার ফুটল না কেন?

স্লোগান ছিল ২০০; ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, ১০০ আসন পাওয়াও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে বিজেপির। বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই টিকে থাকছেন।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 May 2021, 06:38 PM
Updated : 2 May 2021, 07:01 PM

রোববার পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফল ঘোষণার পর হারের চুলচেরা বিশ্লেষণে নেমেছেন ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির হতাশ নেতারা।

অবশ্য গত বারের ৩টি থেকে এবার আসন ১০০ এর কাছাকাছি পৌঁছনোতে সান্ত্বনা খুঁজছেন দলটির রাজ্য সভাপতি।

আসাম, ত্রিপুরা করায়ত্ত করার পর পশ্চিমবঙ্গকে পাখির চোখ করেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অমিত শাহসহ দলীয় নেতারা বারবার ছুটে এসেছেন ভোটের প্রচারে।

গত লোকসভা নির্বাচনের সাফল্যের উপর ভরে করে এবার মমতাকে বিদায় করে দেওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়ে বসে গেরুয়া শিবির।

আর সে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে ১২ দফা সফর করে ১৮টি জনসভা করেছিলেন শুধু মোদীই। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সভা করেন ৬২টি। অন্য রাজ্যের নেতা ও মন্ত্রীরা ১১৭ দিন প্রচার চালিয়েছিলেন।

তারপরও এ অবস্থা কেন? তূণমূলের জোড়া ফুল ছাপিয়ে পদ্ম কেন ফুটল না?

এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজেপির মধ্যে আলোচনা চলছে, অনেক জায়গাতেই দলের পুরনো নেতা, কর্মীদের উপর ভরসা না রেখে নবাগতদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, “প্রার্থী ঠিক করার ক্ষেত্রেও রাজ্য নেতাদের কথা অনেক সময়ই শোনা হয়নি। তাতে নিচের স্তরের কর্মীদের মনোবল ভাঙা হয়েছিল। সমর্থকদের মনোবলও যে ভেঙে গিয়েছিল, তাও এখন স্পষ্ট।”

এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রায় গোটাটাই নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছিল বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তা নিয়ে রাজ্য বিজেপির নেতাদের চাপা অসন্তোষ এখন বের হতে শুরু করেছে।

এলাকাভেদে দলের অবস্থা দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় পাঁচ নেতাকে। যাদের সঙ্গে রাজ্য নেতাদের ভালো বোঝাপড়া ছিলো না বলে অনেকেই বলছেন। বিজেপির এই হারের জন্য এটাকেও কারণ হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ

ভোটের ঠিক আগে তৃণমূল থেকে অনেক নেতা বিজেপিতে এসে প্রার্থী হয়ে যাওয়ায় দলের পুরনো নেতা-কর্মীরা সেটা ভালোভাবে নেয়নি। আর তৃণমূল ত্যাগী নেতাদের সরাসরি টিকিট দেওয়াটাও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

রোববার ফলের প্রাথমিক ধারণা মেলার এমন আলোচনাও শুরু হয়েছে যে, অনেক জায়গাতেই দলের পুরনো নেতা, কর্মীদের ওপর ভরসা না রেখে নবাগতদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

ভিন্ন রাজ্যের অবাঙালি নেতাদের প্রচারণাকে মমতার জন্য বর হিসেবেও দেখছেন অনেকে। আর মমতাও বিভিন্ন সভায় এসব বিজেপি নেতাদের `গুণ্ডা‘ আখ্যা দিয়েছেন। মানুষকে বুঝিয়েছেন পশ্চিমবাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় আসলে রাজ্য অবাঙালিদের হাতে চলে যাবে।

ক’দিন আগেও বাংলায় নতুন সরকার আসা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী বিজেপির স্বপ্নভঙ্গের কারণ সম্পর্কে রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গী বলছেন, “হয়ত বাংলার মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করেন।”

মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাউকে ভোটারদের সামনে আনতে না পারাও বিজেপির ব্যর্থতার একটি কারণ বলে আলোচনা উঠেছে।

ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে যে সুবিধা দেয়নি, তাও এখন দৃশ্যমান।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা কেবল হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপিকে ভোট দেয়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো হিন্দু বাঙালিরা এবার বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিলে দলটি অনেকটাই এগিয়ে থাকত।

নরেন্দ্র মোদী

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিজেপির প্রচার মুসলমানদের তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা করলেও হিন্দুদের তাদের পেছনে জড়ো করতে পারেনি।

ভোটের ফলে হার নিশ্চিত হওয়ার পর বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, এই ফলের কারণ দলের মধ্যে বিশ্লেষণ করে খুঁজে বার করতে হবে।

২০০ আসনের কথা বলে ১০০ থেকেও কেন দূরে- তার দিলীপের বক্তব্য, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২৫ বছর পরিশ্রমের পরে ক্ষমতায় এসেছেন। আমাদের অনেক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আমি সার্বিকভাবে মনে করি, রাজ্যের মানুষ আমাদের আরও ৫ বছর বিরোধী হিসেবে দেখতে চায়।”

বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে রাজ্যে ১২১ আসনে এগিয়ে ছিল। সেই হিসেবেরও কাছাকাছি নেই বিধানসভা নির্বাচনের ফল।

এই প্রসঙ্গে দিলীপ বলেন, “লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচনের ফলের মধ্যে ফারাক ছিল। আমার অনেক শক্তি বাড়িয়েছি।”

বিজেপির রাজ্য সভাপতি বলেন, “তবে এটা ঠিক, যে লক্ষ্য আমরা নিয়েছিলাম তার তুলনায় আমাদের সাংগঠনিক ক্ষমতা কম।

“আমরা মাত্র ৩ আসনে জিতেছিলাম ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। সেই জায়গায় ৫ বছরে আমরা যেখানে পৌঁছেছি, সেটা কম নয়।”

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

৩৪ বছর ধরে যে বামরা পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছিল, তারা এবার নেই হয়ে গেছে বিধানসভায়, থাকছে না তার আগে দুই দশক শাসন করা কংগ্রেসও। তাদের নিশ্চিহ্ন করে বিরোধী দলের আসনে বসতে যাচ্ছে বিজেপি।  

বিজেপি এবার ক্ষমতায় না গেলেও এই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে তাদের মূল সংগঠন আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জয় দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক সত্যহিন্দি ডটকমের সম্পাদক আশুতোষ।

এনডিটিভিতে এক লেখায় তিনি লিখেছেন, যেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতা করে মমতা বিজেপিবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন, তাকেই চণ্ডীপাঠ করে নিজের হিন্দুত্ব তুলে ধরতে হয়েছে। একসময় আম আদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়ালকেও হনুমান চল্লিশা পড়তে হয়েছিল। মমতাকে নিজেকে ব্রাহ্মণ হিসেবে প্রমাণও দিতে হয়েছে।

আর এসবেই আরএসএসের জয় দেখছেন আশুতোষ। 

আর তাই ইতিহাস স্মরণ করে তৃণমূল কংগ্রেসেরও সতর্ক হতেই হবে। কেননা, ২০০৬ সালে রাজ্য বিধানসভার ২৩৫টি আসন জিতে ক্ষমতায় গিয়েছিল বামফ্রন্ট। তারপরের নির্বাচনেই তৃণমূলে কাছে হেরে তাদের আসন ৬২টিতে নেমে আসে। মমতার দলের ফল এবার সেই ২০০৬ সালের বামফ্রন্টের মতোই।