প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের ভাষ্য, ভালো চিত্রনাট্য এবং অভিনয়শিল্পী না হলে কেবল 'হাইপ' তুলে দর্শককে হলমুখী করা সম্ভব নয়।
Published : 04 May 2024, 12:51 PM
বছরের অন্য সময়ে সিনেমা মুক্তি দিলেও, ঈদে যেন এই কাজে জোয়ার আসে ইদানিং। এবারও তাই হয়েছে। রোজার ঈদে ১১টি সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবে সেগুলোর বেশিরভাগই দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে ব্যবসাতেও হয়েছে 'ভরাডুবি'। প্রেক্ষাগৃহ মালিকদের ভাষ্য, ভালো চিত্রনাট্য এবং অভিনয়শিল্পী না হলে কেবল 'হাইপ' তুলে দর্শককে হলমুখী করা সম্ভব নয়।
হল মালিকরা গ্লিটজকে বলেছেন, গত বছরের তুলনায় এবারে হলগুলোয় ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা গেছে। বেশিরভাগ হলে দর্শকদের উপচে পড়া ভিড় তো ছিলই না এবং কোনো কোনো সিনেমা একেবারেই দর্শক টানতে পারেনি।
ঈদের সিনেমাগুলোর মধ্যে 'রাজকুমার' ও 'ওমর' বেশি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও তেমন দাপট দেখাতে পারেনি কোনোটিই। মুক্তি পাওয়া ১১টি সিনেমার মধ্যে বেশিরভাগই ঈদের চতুর্থ সপ্তাহে এসে হল থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হলমালিক এবং সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষের বেশি হতাশা সুপারস্টার শাকিব খানের সিনেমা নিয়ে। তারা বলছেন, গেলবার মুক্তি পাওয়া শাকিবের 'প্রিয়তমা'র ধারেকাছে পৌঁছুতে পারেনি 'রাজকুমার'। 'প্রিয়তমা'র এক ভাগও আয় হয়নি 'রাজকুমার'র। যে প্রত্যাশা নিয়ে তারা সিনেমাটি হলে তুলেছিলেন, সেটি পূরণে ব্যর্থ হয়েছে আরশাদ আদনান প্রযোজিত ও হিমেল আশরাফ পরিচালিত এই সিনেমাটি।
ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো হল-‘রাজকুমার’, ‘ওমর’, ‘কাজল রেখা’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘মোনা: জ্বীন-২’, ‘সোনার চর’, ‘লিপস্টিক’, ‘গ্রিনকার্ড’ ‘আহারে জীবন’,‘মায়া: দ্য লাভ’ ও ‘মেঘনা কন্যা’।
আর ঈদের তৃতীয় সপ্তাহ পেরিয়ে মুক্তি পেয়েছে 'শ্যামা কাব্য' ও 'ডেডবডি'।
ঢাকার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে খোঁজ নিয়ে হতাশার খবরই পাওয়া যায়।
ঢাকার পুরনো হল মধুমিতার কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের ভাষ্য, “ঈদের ১১টি সিনেমার সবকটি সুইসাইড করেছে। আমরা শাকিবের 'রাজকুমার' ধরে রেখেছি, তবে এটার বিক্রিও কমে এসেছে।”
শাকিবের সিনেমা সেভাবে না চলার বিষয়ে নওশাদের বক্তব্য, হলিউড অভিনেত্রীকে নিয়ে সিনেমা বানানোই ভুল হয়েছে।
তিনি বলেন, “‘রাজকুমার’র দুর্বল দিক হল অভিনেত্রী। এই আমেরিকান নায়িকাকে সবাই গ্রহণ করতে পারেনি। সব সিনেমাই ঈদে আসতে চায়, এসে কী লাভ হল, এবার যদি বোঝে। আমার মনে হয় আমাদের দেশের নির্মাতাদের ক্রিয়েটিভিটি শেষের দিকে তাই সিনেমা ভালো চলছে না। সামনের সপ্তাহ থেকে নতুন কিছু চালাব, না হয় এটাই থাকবে। আগে অনেক হিট সিনেমা আসত। এখন সিনেমা শুধু হাইপই তুলে দর্শক আর আনতে পারে না।”
শ্যামলী সিনেমা হলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হাসান গ্লিটজকে বলেন, “অন্যান্য ঈদের তুলনায় এবার ঈদ আমাদের জন্য খারাপ ছিল। হল হাউজফুল এবার দেখিনি। ‘প্রিয়তমা’ সিনেমা যেমন একচেটিয়া ব্যবসা করেছে, ‘রাজকুমার’ সেটা করতে পারেনি। এই সিনেমা মানুষ কম দেখছে। এই সপ্তাহে 'কাজলরেখা' চালাব।”
ঈদে একসঙ্গে এত বেশি সিনেমা মুক্তির বিষয়টি প্রথম থেকেই ব্যবসায়িক ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছিলেন সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। যার প্রমাণ মেলে ঈদ যেতে না যেতেই।
ঈদের প্রথম সপ্তাহেই দর্শক না থাকায় স্টার সিনেপ্লেক্স, ব্লকবাস্টার ও লায়ন সিনেমাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় চারটি সিনেমা। সিনেমাগুলো হল কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘গ্রিনকার্ড’, ছটকু আহমেদ পরিচালিত ‘আহারে জীবন’, জসিম উদ্দিন জাকির পরিচালিত ‘মায়া: দ্য লাভ’ ও ফুয়াদ চৌধুরী পরিচালিত ‘মেঘনা কন্যা’।
আর চতুর্থ সপ্তাহে ঈদের একটি সিনেমাও চলছে না স্টার সিনেপ্লেক্সে। এর পরিবর্তে মুক্তি পেয়েছে হলিউডের একাধিক এবং বাংলা দুটি সিনেমা। দেশের সিনেমাগুলো নামিয়ে বিদেশি সিনেমা চালানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন হিমেল আশরাফ, গিয়াস উদ্দিন সেলিমের মত নির্মাতারা।
‘আশানুরূপ দর্শক পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ বিপণন ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের এখানে সব মিলিয়ে আশানুরূপ হয়নি। যদি তুলনা করি তাহলে গত বছরের তুলনায় কম দর্শক ছিল, এভারেজ বলা যায়। উপচে পড়া দর্শক যেটাকে বলে এই ঈদে আমরা পাইনি।
“দুই তিন দিন আগেই হাউজফুল শো, টিকিট বিক্রি হয়ে যাওয়ার যে দৃশ্য, তা এই ঈদে আমরা পাইনি। ২০২২, ২০২৩ সালে ঈদের সময় যে দর্শক পেয়েছি এই ঈদে আমরা সেটা খুব মিস করেছি।”
একই সুর লায়ন সিনেমা হলের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেকের।
তিনি বলেন, “এক কথায় সব সিনেমাই আমাদের আশাহত করেছে। আমরা হল মালিকরা হতাশ হয়ে গেছি। আমার এখানে দশটা সিনেমার শিডিউল ছিল। কোনোটাই বলার মতো ব্যবসা করতে পারেনি। এমনকি ‘রাজকুমার’ যা আশা করেছিলাম তার ১০ শতাংশও আয় করতে পারেনি। ‘প্রিয়তমার’ এক ভাগও আয় হয়নি রাজকুমারের। বাকি সব সিনেমা থেকে রাজকুমারের বিক্রিই একটু ভালো ছিল। কিন্তু যা আশা করেছিলাম তার ১০ শতাংশ দর্শকও আমরা পাইনি।”
একই খবর পাওয়া গেছে ঢাকার বাইরের প্রেক্ষাগৃহগুলো থেকেও।
ঈদের সিনেমা কেমন চলল জানতে কথা হয় গ্র্যান্ড সিলেট সিনেপ্লেক্সের আইটি ম্যানেজার মেহেদী হাসানের সঙ্গে।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “গত তিন দিন ধরে আমাদের কোনো সিনেমার শো চলছে না। একদমই দর্শক নেই। গত সপ্তাহে আমরা ‘দেয়ালের দেশ’ ও ‘কাজলরেখা’ চালিয়েছিলাম। দর্শক না থাকায় শো একদম বন্ধ। ঈদের সময় ‘রাজকুমার’ চালিয়েছিলাম। ঈদের দুই তিন দিনই সিনেমাটি একটু ভালো চলেছিল। এরপর থেকে ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ টিকেট বিক্রি করছি। যেটা আমাদের জন্য হতাশাজনক।
“‘রাজকুমার’ নিয়ে যেরকম হাইপ ছিল, সব জায়গায় যেরকম আলোচনা হয়েছিল, সিনেমা কিন্তু তেমন ভালো চলেনি। রমজান মাসে আমরা সিনেমা হল বন্ধ রাখি। ঈদের জন্য খোলার পর আমরা যেরকমভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম, একদমই প্রত্যাশিত সাড়া পাইনি। তিনদিন ধরে দর্শক একদমই নেই। এমন অবস্থা চললে হল বন্ধ রাখাই ভালো হবে।”
তবে কোরবানি ঈদের আশার আলো দেখা যাবে বলে মনে করছেন তিনি।
সেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন জানিয়ে মেহেদী বলেন, “গতবছর কোরবানি ঈদে যেমন ভালো ব্যবসা হয়েছিল এবারও সেই প্রস্তুতি নিব। সিনেমা ভালো চলবে আশা করছি।”
ঈদের সিনেমা দিয়ে খুব একটা ব্যবসা করতে পারেনি দেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল যশোরের মণিহার। ঈদের দিন থেকে সেখানে প্রদর্শিত হয়েছে শাকিব খান অভিনীত হিমেল আশরাফ পরিচালিত ‘রাজকুমার’ সিনেমাটি।
চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট দর্শক হয়নি জানিয়ে এই হলের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জিয়াউল ইসলাম গ্লিটজকে বলেন, “গতবারের মত এবার এত ভালো ব্যবসা হয়নি। আমাদের চাহিদা অনুযায়ী যথেষ্ট দর্শক হয়নি। খরচ মিটিয়ে কিছুটা লাভ হয়েছে। কিন্তু যতটা আমরা আশা করেছি ততটা হয়নি। ‘রাজকুমার’ নামিয়ে ফেলেছি।”
এখন মণিহারে ‘মায়া দ্য লাভ’ সিনেমা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটাও খুব একটা ভালো চলছে না কারণ আমাদের হল তো অনেক বড়, লোক অত হয়নি। নতুন সপ্তাহ শুরু হবে যেটা ভালো মনে হবে সেটাই চালাব। তাছাড়া গরমটাও বেশি মানুষ বাইরে কম বের হচ্ছে।”
তবে ভিন্ন কথা বলছেন সিরাজগঞ্জের সিনেমা হল ‘রুটস সিনেক্লাব’ এর কর্ণধার সামিনা ইসলাম। তিনি জানান এই সিনেপ্লেক্সের আসন সংখ্যা ২২টি। এই ঈদে সিনেমা চালিয়ে অনেকটাই সন্তুষ্ট বলে জানান তিনি।
“মোটামুটি আয় করেছে, খুব বেশি লাভও হয়নি, আবার ক্ষতিও হয়নি। আমাদের খরচ উঠেছে। আমরা আসলে সন্তুষ্ট। আমরা যে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ছিলাম অনেক টাকা দিয়ে সিনেমা এনেছি তেমনটা নয়। আমরা খুশি। আমরা মুক্তির আগে টাকা লগ্নি করে সিনেমা আনিনি, বক্স অফিসের নিয়ম অনুযায়ী সিনেমা এনেছি।”
রোজগারের টাকার ভাগাভাগির বিষয়টা নিয়ে সামিনা বলেন, “প্রথম সপ্তাহে আমরা যেটা বিক্রি করি নেট সেলস হিসেবে সেটার ৫০ শতাংশ হল মালিক নিই, ৫০ শতাংশ প্রযোজক নেয়। দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেটা ৬০ শতাংশ, ৪০ শতাংশ হয়ে যায়। রাজকুমার আমাদের এখানে ১৪ দিন চলেছে। সেক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ গিয়েছে। আর তাতে আমরা সন্তুষ্ট। রাজকুমার আরও চালাতে পারতাম, দর্শকের একটা চাহিদা ছিল।
“তবে এই ঈদে যেহেতু ১১টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, সবই চালাতে হবে। তাই আমরা রাজকুমার নামিয়ে অন্য সিনেমাকেও সুযোগ দিচ্ছি। ‘দেয়ালের দেশ’, ‘লিপস্টিক’ চলেছে এক সপ্তাহ। এখন ‘কাজলরেখা’ চলছে, এরপর ‘মোনা জ্বীন-২’, ‘ওমর’, ‘সোনার চর’ সবই আমরা চালাব।”
এর আগে একসঙ্গে এত সিনেমা মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস বলেছিলেন, একসঙ্গে এত সিনেমা মুক্তির বিষয়টি ভালো কিছু নিয়ে আসবে না।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “এত সিনেমার মধ্যে দুই-একটা ছাড়া কোনো সিনেমাই ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে না। সবাই ঈদে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন; কিন্তু আমাদের দেশে অন্য সময় হল চলে না।”
সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়ায় ‘শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন’' জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো রিলিজ কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সব প্রযোজকেরই চিন্তা থাকে ঈদে সিনেমা মুক্তি দিবে। তাদের একটা শৃঙ্খলায় আসা দরকার বলে আমি মনে করি। আমি মিটিংয়ে বিষয়টি উপস্থাপনও করেছি। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত এসেছে। তবে এটা হওয়া উচিত, নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার।”
ঈদে সিনেমা মুক্তির হিড়িক, পরিবেশকদের চোখে ব্যবসায়িক ঝুঁকি
ঈদের সিনেমা না রাখায় নির্মাতাদের ক্ষোভ, যা বলল সিনেপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ
দর্শকখরায় প্রেক্ষাগৃহ থেকে নেমে গেল ঈদের চার সিনেমা
ঈদকেন্দ্রিক ঢাকাই সিনেমার গল্প