কেউ কেউ মনে করছেন, ঈদকেন্দ্রিক এই ব্যবসার চিন্তা চলচ্চিত্রশিল্পের জন্যও ভালো না।
Published : 11 Apr 2024, 10:57 AM
প্রতিবছর দুই ঈদকে কেন্দ্র করে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার একটা হিড়িক পড়ে; গত কয়েকবছর ধরেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে চলচ্চিত্র জগতে। সেই ধারাবাহিকতায় এবারও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে মুক্তি পাচ্ছে ১১টি সিনেমা।
তবে দেশে প্রেক্ষাগৃহ সংকটের মধ্যে একসঙ্গে এত বেশি সিনেমা মুক্তির বিষয়টি ব্যবসায়িক ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ কেউ মনে করছেন, ঈদকেন্দ্রিক এই ব্যবসার চিন্তা চলচ্চিত্রশিল্পের জন্যও ভালো না।
এবারের ঈদে মুক্তির তালিকায় থাকা সিনেমাগুলো হল- ‘রাজকুমার’, ‘ওমর’, ‘কাজল রেখা’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘মায়া-দ্য লাভ’, ‘মেঘনা কন্যা’,‘আহারে জীবন’, ‘মোনা: জ্বীন-২’, ‘সোনার চর’, ‘লিপস্টিক’ এবং ‘গ্রিনকার্ড’।
চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতির অফিস সচিব সৌমেন রায় বাবু গ্লিটজকে জানান, মুক্তি থেকে পিছিয়ে গেছে মোহাম্মদ ইকবালের সিনেমা ‘ডেডবডি’, আহমেদ হুমায়ূনের ‘পটু’।
এবার সবচেয়ে বেশি ১২০টির অধিক প্রেক্ষাগৃহ পেয়েছে শাকিব খানের সিনেমা ‘রাজকুমার’। এরপরই রয়েছে ‘ওমর’। ২৩টি প্রেক্ষাগৃহে চলবে এই সিনেমাটি।
প্রদর্শক সমিতির হিসাব অনুযায়ী দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা ১৫৩টি। দেশে প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা কম হলেও সিনেমার মুক্তির সংখ্যা কম নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই, সিনেমাগুলোর হল বুকিংয়ে কিছুটা চাপ পড়ছে পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। এই ১১টি সিনেমার হল বুকিং দিচ্ছে চারটি পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান।
‘রাজকুমার’র পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান ভার্সেটাইল মিডিয়া।
এর কর্ণধার ও প্রযোজক আরশাদ আদনান গ্লিটজকে আগেই বলেছিলেন, “সর্বোচ্চ সংখ্যক হলে সিনেমাটি বুকিং দিচ্ছেন। সমস্ত বড় বড় হলগুলোতে ভালো দামে আগেই বুকিং করে ফেলেছেন তিনি।”
‘ওমর’ ও ‘আহারে জীবন’সিনেমা দুটি পরিবেশন করছে কিবরিয়া ফিল্মস।
কিবরিয়া ফিল্মসের কর্ণধার গোলাম কিবরিয়া লিপু গ্লিটজকে বলেন, “‘আহারে জীবন’ শুধু মাল্টিপ্লেক্সে রিলিজ পাচ্ছে, আর সিঙ্গেল হলগুলোতে ঈদের পরে মুক্তি পাবে। ‘ওমর’ এর জন্য আমরা ২৩টা হল পেয়েছি। সিনেপ্লেক্সসহ চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বগুড়া, শেরপুর মোটামুটি সব ভালো হলগুলোতে এটি মুক্তি পাচ্ছে।”
তবে ঈদের সময় এতোগুলা একসঙ্গে মুক্তি দেওয়াটা ব্যবসায়িক ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন কিবরিয়া লিপু।
তিনি বলেন, “সিনেমা হচ্ছে স্বাধীন ব্যবসা। যার যার সিনেমার উপর তার আত্নবিশ্বাস আছে। তবে এত সিনেমা মুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু এখন হল পাচ্ছে না। তাদের ধারণা পরে হয়ত হল বাড়বে। কিন্তু যারা একদমই আশানুরূপ পাচ্ছে না তাদের এই ঈদে আসাটা ব্যবসায়িক ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।”
এক্ষেত্রে আবেগে লাগাম পরাতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “হল না থাকলে মানুষ সিনেমা দেখবে কোথায়? শত ইচ্ছে থাকলেও আবেগ দেখিয়ে মুক্তি দিয়ে তো লাভ নেই। সিঙ্গেল স্ক্রিন তো নেই। সিনেপ্লেক্সগুলোও অনেকে পাচ্ছে না। একটা দুইটা হল দিয়ে কীভাবে ব্যবসা করবে? ঈদে একটা জটিল অবস্থা তৈরি করে রেখেছে। শুধু প্রতিযোগিতার জন্য এত কষ্টের একটা সিনেমা ঈদে মুক্তি দেওয়া একদমই ঠিক না। এতে ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে।”
দ্য অভি কথাচিত্র থেকে সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে চারটি। এগুলো হল- ‘লিপস্টিক’, ‘দেয়ালের দেশ’, ‘সোনার চর’ ও ‘মেঘনা কন্যা’।
অভি কথাচিত্রের কর্ণধার জাহিদ হাসান অভি বলেন, “রাজকুমার সিনেমা তো সব থেকে বেশি সিনেমা হল নিয়ে নিয়েছে। যেসব হলের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে, সেসব হলেই চারটা সিনেমা আমরা ভাগ করে দিয়েছি। এর মধ্যে, দেয়ালের দেশ ১৪টি হল পেয়েছে, লিপস্টিক ৯টি, সোনার চর ৬টি, মেঘনা কন্যা ৫টি।”
‘মায়া- দ্য লাভ’ প্রযোজক আলীনুর আশিক ভূঁইয়া নিজেই সিনেমাটির পরিবেশন করছেন। অল্প কয়েকটি একক হলসহ মাল্টিপ্লেক্সে চলবে ছবিটি।
জাজ মাল্টিমিডিয়ার পরিবেশনার ঘরে রয়েছে ‘মোনা: জ্বীন-২’ ও ‘পটু’। তবে পটু সিনেমার মুক্তি পিছিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজ।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “এবার শুধু জ্বীন-২ মুক্তি দিচ্ছি। হল লিস্ট পরে জানাতে পারব।”
‘কাজল রেখা’ সিনেমাটি পরিবেশন করছে আশীর্বাদ চলচ্চিত্র।
এর নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম বলেন, “স্টার সিনেপ্লেক্সের সবগুলো শাখা, যমুনা ব্লকবাস্টার, নারায়ণগঞ্জের সিনেস্কোপে, লায়ন সিনেমা হল, চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন, রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক আর বালি আর্কেডে মুক্তি দিচ্ছি। এখন শুধু মাল্টিপ্লেক্সগুলো; ঈদের পরে সিঙ্গেল স্ক্রিনগুলো টার্গেট করব।”
‘গ্রিনকার্ড’ সিনেমাটি পরিবেশন করছে কাজী হায়াৎ ফিল্মস। সিনেমাটি কতগুলো হলে মুক্তি পাচ্ছে তা জানা যায়নি।
মাল্টিপ্লেক্সগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাখা রয়েছে স্টার সিনেপ্লেক্সে। এর সাতটি শাখায় ১৯টি পর্দা। সব মিলিয়ে প্রতিদিনের শো সংখ্যা প্রায় ৭৬টি। ঈদে মুক্তির তালিকায় সিনেমাগুলোর মধ্যে আটটি সিনেমা চলবে স্টার সিনেপ্লেক্সে।
গ্লিটজকে স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “এতোগুলো সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে, আমরা তো সব চালাতে পারব না। আটটি চালাচ্ছি। ঈদের জন্য সব সিনেমা রেখে না দিয়ে সারাবছর মুক্তি দিলেই হল মালিক, প্রযোজক সবারই লাভ হবে।”
একসঙ্গে এত সিনেমা মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আওলাদ হোসেন উজ্জ্বল বলেন, “১১টা সিনেমার মধ্যে শাকিবের শতাধিক হল। বাকি গুলো সিঙ্গেল, মাল্টিপ্লেক্স মিলে হল পাচ্ছে। আমি তো সবারই নেতা, আমি চাই সব সিনেমা ভালো চলুক।
“এখন বেশি হল পাচ্ছে না, এটা যার সিনেমা সে না বুঝলে আমাদের কিছু করার নেই। যে সিনেমার লগ্নিকারক তাকে বুঝতে হবে আমি কার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করলে লাভ করতে পারব।”
এদিকে প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা সুদীপ্ত কুমার দাস একসঙ্গে এত সিনেমা মুক্তির বিষয়টি ভালো মনে করছেন না।
তিনি গ্লিটজকে বলেন, “এত সিনেমার মধ্যে দুই-একটা ছাড়া কোনো সিনেমাই ভালোভাবে ব্যবসা করতে পারে না। সবাই ঈদে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছেন; কিন্তু আমাদের দেশে অন্য সময় হল চলে না।”
সিনেমা মুক্তির প্রক্রিয়ায় 'শৃঙ্খলা আনা প্রয়োজন' জানিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো রিলিজ কমিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। সব প্রযোজকেরই চিন্তা থাকে ঈদে সিনেমা মুক্তি দিবে। তাদের একটা শৃঙ্খলায় আসা দরকার বলে আমি মনে করি। আমি মিটিংয়ে বিষয়টি উপস্থাপনও করেছি। এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক মতামত এসেছে। তবে এটা হওয়া উচিত, নিয়ন্ত্রণ থাকা দরকার।”