এবারের বিপিএল খেলতে আসা সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন শেন ওয়াটসন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে জিতেছেন ২০০৭ ও ২০১৫ বিশ্বকাপ। ২০১৩-১৪ অ্যাশেজে দলের ৫-০ ব্যবধানে জয়ে তার ছিল বড় অবদান। ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছিলেন তিনি টুর্নামেন্ট সেরা। আরও অনেক দলীয় ও ব্যক্তিগত অর্জনে সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তুমুল চাহিদার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয় করা ক্রিকেটারদের একজন তিনি। সম্প্রতি হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার কথা বললেন তার ক্যারিয়ার, বাংলাদেশের ক্রিকেট ও সমসাময়িক অনেক কিছু নিয়ে….
Published : 10 Jan 2020, 07:51 AM
প্রথম বিপিএলের অনেক কিছুই হয়তো মনে থাকবে, ইবাদত হোসেনের ইয়র্কার দুটিও ভোলার কথা নয়!
শেন ওয়াটসন: দুটি ডেলিভারিই ভালো ছিল। দ্বিতীয় যে ইয়র্কারে বোল্ড হয়েছি, সোজা ডেলিভারি মিস করেছি। প্রথমটি অনেক পরে সুইং করেছিল। ইবাদতকে প্রথমবার দেখছি, মনে হয়েছে দারুণ স্কিলফুল ফাস্ট বোলার। গতি ভালো, দুই দিকে সুইং করাতে পারে, ছন্দে থাকলে খুব ভালো ইয়র্কার করতে পারে। দারুণ সম্ভাবনাময় বোলার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পর নিজেকে ফিট রাখার কাজটি কিভাবে করেন?
ওয়াটসন: সত্যি বলতে, শুরুতে ধুঁকেছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার পর জীবনের নতুন একটি পর্যায়ে প্রবেশ করলাম, কি করব না করব, একটা অনিশ্চয়তা ছিল, পরিবারকে সময় দেওয়াও জরুরি ছিল। আমি তখন অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত রাখিনি, স্কিলে চর্চা করিনি, ক্লাব ক্রিকেট খেলিনি। মনে হয়েছিল, এরকম টুর্নামেন্টের আগে দু-একটি প্র্যাকটিস ম্যাচ খেললেই ছন্দ ফিরে পাব। প্রায় ৯ মাস যাওয়ার পর বুঝলাম, ভুল করছি। এভাবে হয় না। স্কিল নিয়মিত ঝালাই করতে হয়। এরপর থেকে সেভাবেই চেষ্টা করেছি।
এই বিপিএল যদিও একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ আমি আগে জানতাম না যে এখানে আসব। মাঝপথে এসেছি। স্কিল ঝালিয়ে নিতে তাই সময় লেগেছে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মিস করেন না?
ওয়াটসন: নাহ, মিস করি না। কারণ আমি জানি, যতটা সময় খেলেছি, ততটা খেলতে পারা কতটা সৌভাগ্যের। দেশের হয়ে খেলতে পারার সম্মান, বড় ইভেন্টে নিজের সেরাটা ঢেলে দেওয়া, একজন পেশাদারের কাছে এসবই চূড়ান্ত কিছু। আমার যা স্বপ্ন ছিল, পূরণ করতে পেরেছি।
এখন ক্যারিয়ারের যে পর্যায়ে আছি, গত ৩-৪ বছরে যেসব ক্রিকেট খেলছি, এখানে দেশের হয়ে খেলার মতো সবসময় নজরদারিতে থাকতে হয় না। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে, জাতীয় দলে ভালো পারফর্ম করতে না পারা মানে অনেক সময়ই ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে পড়া। আমরা সবাই মাঠে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করি। ক্রিকেট ও জীবনে, সবকিছুই সবসময় ভাবনামতো হয় না। এমন কেউ নেই, যার সবকিছু সবসময় খুব ভালো যায়, যে সবকিছু নিখুঁতভাবে করে। ওঠা-নামা থাকেই। কিন্তু দেশের হয়ে আমরা যখন খেলি, লোকের সেটা মনে থাকে না। সবসময় সেরাটা চায়।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পেছন ফিরে তাকালে, কোনো আক্ষেপ হয়? আরও কিছু টেস্ট যদি খেলতে পারতেন, কিংবা আরও কিছু রান বা কয়েকটি বেশি সেঞ্চুরি করা!
ওয়াটসন: নাহ, একদমই না। কোনো আক্ষেপ নেই আমার। আমার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, তার সর্বোচ্চটাই আমি করেছি। যত সম্ভব ট্রেনিং করা, নিজের সামর্থ্যের সেরাটা বের করে আনতে যা করা উচিত, সবই করেছি আমি। আক্ষেপের কারণ নেই।
হ্যাঁ, ছোটখাটো আরও অনেক কিছু হয়তো করতে পারতাম। কিছু জায়গায় আরও ভালো করতে পারতাম। তবে সেসব আক্ষেপ নয়। কোথায় কোথায় ভালো করতে পারতাম, এটি জানি বলেই আমি পরের প্রজন্মদের সাহায্য করতে চাই। মূলত এই কারণেই খেলা পুরোপুরি ছাড়ার পর আমি কোচিংয়ে আসতে চাই। পরের প্রজন্মকে আমি বলতে পারব, কোন কাজগুলি আমার চেয়ে ভিন্নভাবে করা উচিত, কোনগুলি আমার মতো করে এবং কেন করা উচিত। ব্যাখ্যা ভালো দিতে পারব।
ভবিষ্যতে তাহলে কোচ ওয়াটসনকে দেখা যাবে?
ওয়াটসন: আশা তো করি। আমি ক্রিকেট ভালোবাসি, আর যে কোনো কিছুর চেয়ে ক্রিকেট ভালো বুঝি। মানুষকে সাহায্য করতে পছন্দ করি। জীবন ও ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যা শিখেছি, অন্যদের তা শেখাতে চাই। ২০ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়া দলে এসেছিলাম, বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক গ্রেটের সঙ্গে খেলেছি। তাদের কাছ থেকে যা শিখেছি, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে যতকিছু বুঝেছি, পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে তা ছড়িয়ে দিতে চাই।
ব্যক্তিগত অর্জনের কথা বললে, ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টানা চার ম্যাচে ম্যান অব দা ম্যাচ, পরে ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট হওয়া নিশ্চয়ই ছিল বিশেষ কিছু?
ওয়াটসন: স্পেশাল তো বটেই। তবে আমি সৌভাগ্যবান যে আরও অনেক স্পেশাল মুহূর্ত আমার ক্যারিয়ারে এসেছে। সত্যি বলতে, মাঝেমধ্যে নিজের ক্যারিয়ারকে আমার স্বপ্নময় মনে হয়!
আপনি যে টুর্নামেন্টের কথা বললেন, বিশ্বকাপের মতো আসরে বিশ্বমানের দলগুলির বিপক্ষে টানা চার ম্যাচে ম্যান অব দা ম্যাচ, অবশ্যই আমার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। বিশ্বকাপটা জিততে পারলে আরও বড় প্রাপ্তি হতো, অস্ট্রেলিয়া এখনও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিততে পারেনি।
তবে সব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আমার যা প্রাপ্তি, অন্যান্য টুর্নামেন্ট ও দলের হয়ে যা করেছি, স্মরণীয় স্মৃতির অভাব নেই।
সৌভাগ্যের কথা আপনি বারবার বলছেন, পরিশ্রম করেই তো সেই সৌভাগ্য অর্জন করে নিতে হয়েছে!
ওয়াটসন: কঠোর পরিশ্রম ও সৌভাগ্য, দুটি মিলিয়েই সাফল্য এসেছে। অবশ্যই পরিশ্রম করে যেতে হবে, হাল ছাড়া যাবে না, পাশাপাশি ভাগ্যও লাগবে। আমি যে পরিবারে বড় হয়েছি, যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, জীবন গড়ে তুলতে তা খুবই সহায়ক হয়েছে।
এজন্যই আমি কোন প্রজন্মের ক্রিকেটার এবং কখন আমার জন্য সুযোগের দুয়ার খুলছে-এসব ক্ষেত্রে ভাগ্য খুব ভূমিকা রাখে। পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে তৈরি করা ও স্কিল বাড়ানোর কাজ করতে হয় নিজের, যেন ভাগ্য সুযোগ দিলে প্রস্তুত থাকি।
দুটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ জিতেছেন (২০০৭ ও ২০১৫), দেশের মাটিতে অ্যাশেজ জয়ী দলে ছিলেন, ৫-০তে অ্যাশেজ জয়ে ভূমিকা রেখেছেন। কোনটির সাফল্য আপনার মনকে বেশি দোলা দিয়েছিল বা দেয় এখনও?
ওয়াটসন: দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জয় আমার কাছে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে (২০১৫)। সেটিই সাফল্যের চূড়ান্ত, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মুহূর্ত। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ জয় শুধু আমার নয়, আমাদের অনেকেরই অনেক বছরের স্বপ্ন ছিল।
বেশ কয়েক বছর আগেই আমরা জানতাম যে ২০১৫ বিশ্বকাপ অস্ট্রেলিয়ায় হবে। দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন ছিল অনেকের। সেই দলে থাকতে পারা এবং জিততে পারার অনুভূতি অতুলনীয়।
টেস্ট ক্রিকেটের কথা বললে তো অবশ্যই দেশের মাটিতে অ্যাশেজ জয়। ৫-০তে জিততে পারা তো বটেই, আরেকটি কারণেও ওই জয় ছিল বিশেষ কিছু। ক্যারিয়ারে সেবারই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ার সব মানুষ আছে দলের পাশে। ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারে যেমন ওঠা-নামা থাকে, দলেরও ভালো সময়, বাজে সময় আসে। সব সময় সমান সমর্থন মেলে না। ওই সিরিজের সময় অস্ট্রেলিয়ার সবাই চেয়েছে, আমরা যেন ভালো করি। যেখানে গিয়েছি, সবাই প্রেরণা জুগিয়েছে। অবিশ্বাস্য অনুভূতি ছিল।
আপনি দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন দুই অধিনায়কের নেতৃত্বে। রিকি পন্টিং (২০০৭) ও মাইকেল ক্লার্ক (২০১৫), দুজনই দারুণ অধিনায়ক ছিলেন, নিজেদের ছাপ রাখতে পেরেছেন। যদিও দুজনের ধরণ আলাদা ছিল, তবু একজনকে এগিয়ে রাখতে বললে কাকে রাখবেন?
ওয়াটসন: আমার কাছে রিকি পন্টিংই অধিনায়কত্বের শেষ কথা। নেতৃত্বগুণ তার ছিল দারুণ। খুব ভালোভাবে জানতো, দলের প্রতিটি সদস্যের সঙ্গে কিভাবে মিশে যেতে হয়। জানতো, কিভাবে কোন ক্রিকেটারের সেরাটা বের করে আনতে হয়, কে কোন ধাতুতে গড়া। আমার কথাই বলি, রিকি আমার সেরাটা বের করে আনতো। জানতো, কখন কোন কথাটা বললে কাজ হবে।
আমার মতে, রিকির সেরা গুণ এটিই। সবার সঙ্গে সম্পর্ক শুধু গড়তই না, ধরে রাখত। এসবের সঙ্গে ক্রিকেটিং স্কিল, টেকনিক্যাল স্কিল তো ছিলই। সবকিছুর সমন্বয় দারুণভাবে করতে পারত বলেই তার সময়ে দল এত সফল ছিল।
আর শেন ওয়ার্ন? বোদ্ধা থেকে শুরু করে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকেই ওয়ার্নকে বলেন, ‘দা বেস্ট ক্যাপ্টেন অস্ট্রেলিয়া নেভার হ্যাড।’ প্রথম আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসে ওয়ার্নের নেতৃত্বে খেলার পরই আপনার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে গিয়েছিল…
ওয়াটসন: ওয়ার্নি…অবিশ্বাস্য এক নেতা। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তার নেতৃত্বগুণ সে খুব একটা দেখানোর সুযোগ পায়নি। ট্যাকটিক্যালি সে জিনিয়াস। খেলাটা অবিশ্বাস্যরকম ভালো বোঝে বলেই ক্যারিয়ারে এত সফল হয়েছে। পাশাপাশি, রিকির মতো তারও ক্ষমতা ছিল সবার সেরাটা বের করে আনার। যার সঙ্গে যা দরকার, সে নিখুঁতভাবে তাই করত।
প্রথম আইপিএলেই আমি সেটি খুব ভালোভাবে দেখেছি। রাজস্থান রয়্যালসের অধিনায়ক কাম কোচ ছিল সে। দলে যোগ দেওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেখা গেল, দলের সবার সঙ্গে তার দারুণ সম্পর্ক। সবাই যে দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এই বোধ সবাইকে দিতে পেরেছিল। সবাই মরিয়া ছিল সেরাটা করতে। একজন নেতার জন্য এর চেয়ে বড় স্কিল আর কী থাকতে পারে!
আমার ক্যারিয়ারে ওয়ার্নির প্রভাব অনেক। শুধু রাজস্থানের অধিনায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার ঘুরিয়ে দেওয়াই নয়, তার সঙ্গে হ্যাম্পশায়ারে খেলেও অনেক শিখেছি। এর বাইরেও সবসময় আমার খোঁজ রাখত, স্কিলের উন্নতিতে বছরের পর বছর নানাভাবে সাহায্য করত। আমার কাছে সে সত্যিকারের মেন্টর।
আইপিএল অধিনায়কত্বের প্রসঙ্গ যখন এলো, চেন্নাই সুপার কিংসে মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
ওয়াটসন: চেন্নাই সুপার কিংস অসাধারণ একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি। কারণ, দারুণ দুজন নেতা দলটি পরিচালনা করে। আমি যাদের দেখেছি, স্টিভেন ফ্লেমিং অনায়াসে তাদের মধ্যে সেরা কোচ। তিনি নিজেও দুর্দান্ত অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান ছিলেন। ট্যাকটিক্যালি ভালো। খেলাটা তিনি খুব ভালো বোঝেন। পাশাপাশি, তার ‘ম্যান ম্যানেজমেন্ট’ অসাধারণ। অনেক কোচই আছেন, ট্যাকটিক্যালি ভালো কিন্তু ম্যান ম্যানেজমেন্ট ততটা নয়। ফ্লেমিংয়ের কোনোটিতে কমতি নেই।
এরপর অধিনায়ক ধোনি, অবিশ্বাস্য রকমের শান্ত, ধীরস্থির। খেলাটার প্রতি তার আবেগ তীব্র। সেও সবার সেরাটা বের করে আনতে পারে। এই দুজনের ইতিবাচক প্রভাবই গোটা ফ্র্যাঞ্চাইজিতে দেখা যায়। এ কারণেই দলটি এত সফল।
অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ক্রিকেট একাডেমি, সেন্টার অব এক্সিলেন্স থেকে উঠে এসেছেন আপনি। আরও অনেক ক্রিকেটার এসেছে সেখান থেকে, যারা পরে হয়ে উঠেছেন গ্রেট। ওই একাডেমি কেন এত ভালো?
ওয়াটসন: মূল কারণ, তারা ক্রিকেটার তৈরির সঠিক সিস্টেম ধরতে পেরেছিল। রডনি মার্শ যেভাবে একাডেমি গড়ে তুলেছিলেন, ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং আর ফিটনেস, সবদিকেই সঠিক পদ্ধতি আর লোক ছিল সেখানে। আমার মনে আছে, রড মার্শ যখন আমাকে বললেন যে একাডেমিতে সুযোগ পেয়েছি, আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিলাম। গ্রেট ক্রিকেটার তৈরির সবচেয়ে বড় কারখানা সেটি। ভেবেছিলাম, “গ্রেট হতে পারি আর না পারি, ওখানে গিয়ে শিখতে চাই।”
দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেই সিস্টেম আর নেই। বলা হয় যে ভালো কিছু বদলাতে হয় না। তারা বদলাতে গিয়ে নষ্ট করেছে। একটা সময় অস্ট্রেলিয়ায় যারা জাতীয় দলে খেলেছে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছে, প্রায় সবাই ছিল ওই একাডেমি থেকে উঠে আসা। সেটি আর আগের মতো নেই।
এই একাডেমির সেরা গ্র্যাজুয়েট কে?
ওয়াটসন: হাহাহাহা…এটা বলা সম্ভব নয়। এত এত গ্রেট…গিলক্রিস্ট, ম্যাকগ্রা, ক্লার্ক, পন্টিং, লি, গিলেস্পি, হাসি, জনসন, ম্যাকগিল, বেভান, মার্টিন, স্ল্যাটার, ওয়ার্ন ছিলেন (শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েট হতে পারেননি), ল্যাঙ্গার, সাইমন্ডস…একটি-দুটি প্রজন্মের সবাই ওই একাডেমির। ম্যাথু হেইডেন ছাড়া সবাই। আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল ওই একাডেমি। ফাস্ট বোলাদের তো সবাই ছিল সেখানে, ডেনিস লিলি সবাইকে তৈরি করার চেষ্টা করেছেন।
জ্যাক ক্যালিসের কথা বলছিলেন একটু আগে উদাহরণ হিসেবে। আপনার চোখে ক্যালিসই কি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার?
ওয়াটসন: অবশ্যই ক্যালিস। টেস্ট ক্রিকেটে সে যা করেছে, পাগলাটে ব্যাপার-স্যাপার। ভেবে দেখুন, ক্যারিয়ার শেষে তার ব্যাটিং রেকর্ড রিকি পন্টিংয়ের চেয়ে ভালো। তার বোলিং পরিসংখ্যান অনেকটাই ব্রেট লির মতো। ভেবে দেখুন, একজনের মধ্যেই পন্টিং ও লি! সঙ্গে দুর্দান্ত ক্যাচিং তো আছেই (২০০ ক্যাচ নিয়েছেন টেস্টে)। আমি তো বুঝে উঠতে পারি না, একজন কিভাবে এত কিছু করতে পারে!
আশির দশকের চার বিখ্যাত অলরাউন্ডার, বোথাম-কপিল-ইমরান-হ্যাডলির সঙ্গে তুলনায় ক্যালিসকে কোথায় রাখবেন? চাইলে নিজেকেও যোগ করে নিতে পারেন তুলনায়…
ওয়াটসন: এই তালিকায় তো আমার নিজেকে যোগ করার প্রশ্নই আসে না। অন্যদের কথা বললে, ইমরান বা তারা সবাই কিন্তু মূলত বোলিং প্রধান অলরাউন্ডার। সবারই বোলিং রেকর্ড দুর্দান্ত। সঙ্গে ব্যাটিংয়েও ভালো করেছে। ক্যালিসের ক্ষেত্রে উল্টো। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সে, এখানেই সে আলাদা। ব্যাটসম্যানদের কাজটা কঠিন, আউট হতে এক বলই যথেষ্ট। বোলারদের জন্য বাজে বোলিং করেও পরে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভালো করার সুযোগ আছে। ব্যাটসম্যানদের সেই সুযোগ থাকে না। ব্যাটসম্যান হিসেবে এত উজ্জ্বল রেকর্ড ক্যালিসের, সঙ্গে ক্যারিয়ার জুড়ে নানা সময়ে বোলিং করেছে, এটাই তাকে সবার ওপরে রাখবে।
ওই চার অলরাউন্ডারও অসাধারণ ছিলেন। তবে আমার কাছে, জ্যাক ক্যালিস…সুপারম্যান।
আপনার খেলা সেরা বোলার?
ওয়াটসন: শেফিল্ড শিল্ডে শেন ওয়ার্নকে খেলেছি। অসাধারণ অভিজ্ঞতা ছিল সেটি। নেটে তো খেলেছিই। গ্লেন ম্যাকগ্রা আরেকজন, শেফিল্ড শিল্ডে খেলেছি, নেটেও। তার বিশেষত্ব ছিল, যা কিছু করতে পারত, সবকিছুর ওপর অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ। ব্যাটসম্যানের নাভিশ্বাস তোলা লাইন-লেংথ, নিখুঁত নিশানা, সুইং আর অতি অবশ্যই, বাড়তি বাউন্স। মনে হতো, যে কোনো ব্যাটসম্যানকে আউট করা তার জন্য কেবল সময়ের ব্যাপার।
যাদের বিপক্ষে বল করেছেন, তাদের মধ্যে সেরা ব্যাটসম্যান?
ওয়াটসন: এমন একজন যাকে শুধু নেটেই বোলিং করেছি। রিকি পন্টিং। একই বলে যে চার ধরনের শট খেলতে পারত। একই বল মাঠের যে কোনো জায়গায় খেলতে পারত এবং সবই আগ্রাসী শট। পুরোই পাগলাটে ব্যাপার-স্যাপার।
আগ্রাসী ব্যাটিং করতে পছন্দ করেন, আপনার চোখে সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান কে?
ওয়াটসন: একজনের নাম তো বলা কঠিন…অবশ্যই বিরেন্দর শেবাগের কথা বলতে হবে। টেস্টেও সে যেভাবে ব্যাট করেছে, অন্যদের কাছে সেটি স্বপ্ন। প্রথম বল থেকেই যেভাবে বোলারদের গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছে, কতবার যে টেস্ট ম্যাচের প্রথম বলে চার মারল…টেস্টে ওপেনিংয়ে নেমে এমন ব্যাটিং আসলেই স্বপ্নের মতো।
টি-টোয়েন্টিতে ক্রিস গেইল যেভাবে ব্যাট করেন, কত কত রান করছে সে, কত সেঞ্চুরি, হিসাব রাখাই কঠিন। যে দাপটে ব্যাটিং করেন, কখনও কখনও মনে হয় তিনি ভিন্ন মাপের উইকেটে ব্যাট করছেন। অন্যদের জন্য যা ৭০ মিটার, তার জন্য ৫০ মিটার! তার শক্তি তেমনই।
শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, রিকি পন্টিং…সেরা কে?
ওয়াটসন: আমি বলব পন্টিং। ব্যাটসম্যান হিসেবে সে বাকি দুজনের সমমানের বা কাছাকাছি। কিন্তু পান্টার বেশি ম্যাচ ও ট্রফি জিতেছে। সেই জয়গুলিতে গুরুত্বপূর্ণ রান করেছে। বিশেষ করে বিশ্বকাপ ও বড় বড় ম্যাচে সে সবসময়ই রান করেছে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেভাবে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে, আপনার কি মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকবে?
ওয়াটসন: টি-টোয়েন্টি কখনোই টেস্ট ক্রিকেটের জায়গা নিতে পারবে না। টেস্ট ক্রিকেটই থাকবে ক্রিকেটের চূড়ান্ত। তবে ১০ বছর পরে টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা কেমন হবে, আমি ঠিক নিশ্চিত নই। লড়াই কতটা অর্থপূর্ণ করা যায়, সেটির ওপরে নির্ভর করবে টেস্ট ম্যাচের ভবিষ্যৎ। এখন আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে যেমন হচ্ছে। আইসিসি যখন ৫ বছর বা ৮ বছর আগে এটির আলোচনা শুরু করেছিল, তখনই চালু করা উচিত ছিল।
টেস্ট ম্যাচকে রোমাঞ্চকর করতে হলে প্রতিটি ম্যাচকেই অর্থপূর্ণ করতে হবে। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ যেমন, যারা খেলে, যারা দেখে, সবারই ভালো লাগে। কারণ প্রতিটি ম্যাচেরই এখানে ওজন আছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচেরই আলাদা মাহাত্ম আছে। কিন্তু এমনিতে টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলি-দেশের হয়ে খেলার গর্ব আছে বটে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে হারলেও জানা থাকে যে এরকম আরেকটি ম্যাচ আসছে। কিন্তু বিশ্বকাপে খারাপ করা মানে আবার দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা।
টেস্ট ক্রিকেটেও আশা করি এমন কিছু হবে। কারণ দিন শেষে, টেস্ট ম্যাচই শীর্ষ ক্রিকেট থেকে যাবে। তবে অবশ্যই, ৫ দিনের টেস্ট ম্যাচ!
৫ দিনের টেস্ট বললেন, ৪ দিনের টেস্টের বিতর্কে আপনার অবস্থান তাহলে বোঝাই যাচ্ছে!
ওয়াটসন: অবশ্যই। ৪ দিনের ম্যাচের ভাবনা হাস্যকর। টেস্টের পঞ্চম দিনের উত্তেজনা…আহ, এটির চেয়ে রোমাঞ্চকর কিছু আছে!
টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে সেরা সৌন্দর্যই তো পঞ্চম দিনের ক্রিকেট! এমন কতবার হয়েছে যে চার দিনেও মনে হয়েছে ম্যাচ নিশ্চিত ড্র, কিন্তু পঞ্চম দিনে খেলা তুমুল জমে গেছে! কারণ কন্ডিশন বদলাতে থাকে, উইকেট বদলায়, চাপ চলে আসে, তখনই তো আসল পরীক্ষা! দর্শকের জন্যও সেটি উত্তেজনাপূর্ণ।
চার দিনের টেস্ট যারা করতে চাচ্ছে, ব্যক্তি হোক বা একত্রে, তারা টেস্ট ক্রিকেটের সত্যিকারের অর্থ বোঝে না।
২০১১ সালে মিরপুরে ছক্কার বৃষ্টিতে সেই ১৮৫ রানের ইনিংস কতটা মনে পড়ে?
ওয়াটসন: আমার ক্যারিয়ারে দারুণ স্পেশাল এক দিন ছিল সেটি। সেই ইনিংসের কারণেই বাংলাদেশ সবসময় আমার হৃদয়ে বিশেষ এক জায়গা নিয়ে থাকবে। আমার পুরো ক্যারিয়ারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অংশ সেটি। এজন্যই বাংলাদেশে আসার যে কোনো সুযোগ পেলে হাতছাড়া করতে চাইব না। এই মাঠে নামা, সেই স্মৃতি রোমন্থন করা, সুযোগ পেলেই নিতে চাই।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এসিএ) প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আপনাকে। এই দায়িত্বে আপনার চাওয়া কি থাকবে?
ওয়াটসন: প্রথমত, এসিএ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পাওয়াটিই দারুণ সম্মানের। এর আগে যারা এই দায়িত্বে ছিলেন, তাদের দেখলেই ওজনটা বোঝা যায়।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের কিছু জায়গা আছে, যেখানে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমি চেষ্টা করব সেটি করতে। পাশাপাশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে থাকা, ভালোমন্দ দেখভাল করা, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সঙ্গে থাকা, এখনকার ক্রিকেটারদের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে হলে সেসব বলা। ক্রিকেটাররা নিজেদের সেরাটা বের করে আনার সেরা সুযোগ যেন পায়, মাঠের ভেতরে ও বাইরে, সেটি নিশ্চিত করতে চাই।
খুব নাকি ভালো রান্না করেন!
ওয়াটসন: রাঁধতে আমার ভালো লাগে। আমেরিকান বারবিকিউ পছন্দ করি আমি, এজন্যই স্মোকিং কিছু করতে ভালো লাগে। লম্বা সময় ধরে যেগুলো রান্না করতে হয়।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছাড়ার চার বছর হতে চলেছে, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে আর কতদিন খেলা চালিয়ে যাবেন?
ওয়াটসন: নিশ্চিত নই, খেলতে তো ভালোবাসি। ৩-৪ বছর তো নয়ই। জীবনের এই পর্যায়ে পরিবারের থেকে দূরে লম্বা সময় থাকা কঠিন। আমার ছেলে এখন স্কুলে যাচ্ছে পুরোদমে, কাজেই দেশের বাইরে বেশি যেতে পারবে না। আমিও ওদের থেকে বেশি সময় দূরে থাকতে চাই না। কাজেই কতদিন খেলব, সেই সিদ্ধান্তে খেলার চেয়ে জীবনের এই ব্যাপারগুলির ভূমিকা বেশি থাকবে।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, একসময় টানা পাঁচ বছর সবচেয়ে বেশি আয় করা নন-ভারতীয় ক্রিকেটার ছিলেন আপনি। আপনার এত এত রান, সেঞ্চুরি, উইকেট, ক্রিকেটীয় অর্জনের পাশে এটিকে কোথায় রাখবেন?
ওয়াটসন: একটা ব্যাপার আমার সবসময়ই ছিল, কখনোই কোনো কিছু সহজ ধরে নেইনি। এত পথ পেরিয়ে আসা, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে জায়গা করে নেওয়া, আমি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারি, আমি কতটা সৌভাগ্যবান। আমি তাই কোনো অবস্থাতেই এটিকে সহজ ধরে নেই না। যাদের সঙ্গে খেলে বেড়ে উঠেছি, আরও যারা খেলেছেন, অসাধারণ সব ক্রিকেটার, তাদের বেশির ভাগেরই হয়তো আমার মতো জীবন কাটানোর সুযোগ হয়নি। আমি তাই অবিশ্বাস্যরকমের ভাগ্যবান।
ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান হিসেবেও আমি একটি ব্যাপার নিশ্চিত করার চেষ্টা করব, উঠতি ক্রিকেটাররা যেন সবকিছুকে সহজপ্রাপ্য মনে না করে। বিশ্ব ক্রিকেটের বর্তমান বাস্তবতায় অনেক তরুণই অনেক ভালো আর্থিক অবস্থায় চলে আসতে পারে। কিন্তু তারা যেন সেটিকে খুব সহজ না ধরে নেয়, সেটি বোঝানোর চেষ্টা করব।