গুলশান লেকের তীরে সেই দোতলা বাড়িটি সাজিয়ে তোলা হয়েছে নতুন করে, সামনের লন এখন আগের মতই সবুজ।
Published : 01 Jul 2021, 02:29 PM
তবু পাঁচ বছর আগের ভয়ঙ্কর এক রাতের স্মৃতি ঘিরে রেখেছে বাড়িটা; রক্তের দাগ আর বুলেটের ক্ষত রয়ে গেছে স্মৃতিপটে।
গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের এই বাড়িতেই ছিল হলি আর্টিজান বেকারি। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে সেখানেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল।
পাঁচ তরুণ জঙ্গি রোজার ঈদের এক সপ্তাহ আগে পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছিল সেই ক্যাফেতে।
তারা জবাই ও গুলি চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
ভয়ঙ্কর সেই রাতের শেষে কমান্ডো অভিযানে জঙ্গিদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে হলি আর্টিজান সংকটের অবসান হয়।
ওই হামলা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে অনেকখানি। বহু মানুষের হৃদয়ে রেখে গেছে গভীর ক্ষতচিহ্ন।
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরের বছরগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী জঙ্গি ও উগ্রবাদ দমনে তৎপর হয়। জঙ্গি হামলা প্রতিরোধে পুলিশে গঠিত নয় নতুন নতুন বিশেষায়িত ইউনিট।
নিরাপত্তা বাহিনীর একের পর এক জঙ্গিবিরোধী অভিযানে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী অন্তত ৮০ জন নিহত হয়েছে গত পাঁচ বছরে, গ্রেপ্তার হয়েছে কয়েক হাজার।
আর র্যাবের তথ্যে, গুলশান হামলার পর শুধু তাদের হাতেই গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ৪৬০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি।
পুলিশের কর্মককর্তাদের দাবি, ব্যাপক তৎপরতায় জঙ্গিদের ‘কোমর ভেঙে দেওয়া হয়েছে’। তবে উগ্র মতদর্শ ছড়ানোর চেষ্টা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। বিশেষ করে অনলাইনে জঙ্গিরা এখনও তৎপর।
ছানোয়ার বলেন, “পুলিশসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতার কারণে উগ্রবাদীরা কোণঠাসা। জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষক, নেতা নির্বাচন, অর্থায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে নতুন স্বঘোষিত নেতাদের নিয়ে একটা সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে। এটা সামগ্রিক পরিস্থিতির জন্য সুবিধাজনক।
“এখন উগ্রবাদ ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তাই এখন পুলিশকেও ‘সাইবার পেট্রলিং’ বাড়াতে হয়েছে। ফেইসবুক থেকে শুরু করে ডার্কনেট পর্যন্ত নজরদারি করা হচ্ছে। শুধু এটিইউর পাঁচটি পৃথক দল এই সাইবার নজরদারিতে যুক্ত।”
তবে অনলাইনে জঙ্গিদের যে হাঁকডাক, সেটা তাদের ‘প্রকৃত অবস্থা নয়’ বলে মনে করেন পুলিশ সুপার ছানোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, “যে ব্যক্তির প্রকৃত সক্ষমতা নেই, তিনিও অনলাইনে এমন বুলি দেন যে মনে হয় বিশাল সক্ষমতা অর্জন করেছেন তারা। গ্রেপ্তারের পর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুরোটাই ছিল মিথ্যাচার।”
হলি আর্টিজানের ঘটনার পর জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে উগ্রবাদীদের বিষয়ে প্রচুর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
“উগ্রবাদীদের মতাদর্শগত সংগ্রামের (কাউন্টার ন্যারেটিভ) মধ্য দিয়ে মূলধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা এখনও সেভাবে নেই। পুনর্বাসনের পদক্ষেপও যথেষ্ট নয়। কারাগারে যারা বন্দি, তাদের মূল স্রোতধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য যে কাউন্সেলিং দরকার, সেটা অনুপস্থিত। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উগ্র মতাদর্শের মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি দেখতে হচ্ছে আমাদের।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) ইনস্টিটিউট অব টেরোরিজম রিসার্চের প্রধান শাফকাত মুনীর অনলাইনে উগ্রবাদ ছড়ানো বন্ধের ওপর জোর দিলেন।
তিনি বলেন, “হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার সেই রাতে এত অনিশ্চয়তায় পড়েছিলাম আমরা যে মনে হচ্ছিল এরকম হামলা বুঝি আবার হতে পারে। কিন্তু সেখান থেকে আমরা একটি পরিস্থিতিতে এসেছি, যখন সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলার সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে।
“কিন্তু তাই বলে কী আমরা বলতে পারি যে সন্ত্রাসী বা জঙ্গিবাদের হুমকি কমে গেছে? অবশ্যই না।”
ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তরুণ সমাজকে বিপথে নেওয়ার চেষ্টা এখনো চলছে জানিয়ে শাফকাত মুনীর বলেন, “পুরো পৃথিবী যখন কোভিড মহামারী নিয়ে যুদ্ধ করছে, তখনো কিন্তু উগ্রবাদীরা থেমে নেই। অবশ্যই আমাদের আইনশৃঙ্খলা ও নিরপত্তা বাহিনী এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার চেষ্টার ফলে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি কমেছে, তবে সামনে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।”
ইন্টারনেটে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিস্তার রোধে সবাইকে আরও সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি জঙ্গি ও সহিংস উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।