প্রায় এক বছর আগে পেপারবুক প্রস্তুত হলেও গুলশান হামলার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে শুনানি তো দূরে, আনুষঙ্গিক কাজ শেষ না হওয়ায় এখনও হাই কোর্টের বেঞ্চও নির্ধারণ হয়নি।
Published : 30 Jun 2021, 11:22 PM
এর জন্য করোনাভাইরাস মহামারীকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এ বছরই শুনানির জন্য ‘সর্বোচ্চ’ চেষ্টা চালাবেন তিনি।
দেশে নজিরবিহীন ওই হামলার পঞ্চম বার্ষিকীর আগের দিন বুধবার তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “মামলাটি সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগে আছে। মামলার পেপারবুক রেডি হয়ে গেছে। যেহেতু এটি ডেথ রেফারেন্সের মামলা। ডেথ রেফারেন্সের মামলাগুলো তালিকা অনুযায়ী শুনানির জন্য আসে।
“আপনারা জানেন কোভিডের কারণে গত বছর মার্চের পর থেকে স্বাভাবিক আদালত হচ্ছে না। সেই কারণে মামলাগুলো শুনানির জন্য উঠতে দেরি হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমি মামলাটি মেনশন করব। এ বছরের মধ্যে মামলাটি শুনানি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
তবে বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া একজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করবে কি না, সে বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
মামলাটির গুরুত্ব তুলে ধরে আমিন উদ্দিন বলেন, ঘটনাটি ছিল ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং মর্মান্তিক’। কতিপয় বিপথগামী মানুষ কতিপয় তরুণকে বিপথে নিয়ে এ ধরনের কাজ করিয়েছিল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম জঙ্গি হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে।
পাঁচ তরুণ জঙ্গি রোজার ঈদের এক সপ্তাহ আগে পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়েছিল সেই রেস্তোরাঁয়।
তারা জবাই ও গুলি চালিয়ে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরে কমান্ডো অভিযানে ওই জঙ্গিদের হত্যা করা হয়।
গুলশান হামলার পর জঙ্গি দমন অভিযান গতি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানে অনেক জঙ্গি গ্রেপ্তার হওয়ার পাশাপাশি শীর্ষনেতাদের প্রায় সবাই মারা যান।
ওই হামলার ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় রায়ে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর আদালত সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তবে একজন খালাস পান রায়ে।
রায় ঘোষণার পর নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার ডেথ রেফারেন্স ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর বিচারিক আদালত থেকে হাই কোর্টে আসে। হাই কোর্টের ডেসপাস (আদান-প্রদান) শাখা সেগুলো গ্রহণ করে পাঠায় ডেথ রেফারেন্স শাখায়।
পেপারবুক শাখা সেসব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে নথিসহ রায়ের অনুলিপি ও আনুসঙ্গিক নথিপত্র পেপারবুক তৈরির জন্য ফেব্রুয়ারিতে বিজি প্রেসে পাঠিয়ে দেয়।
পাঁচ মাসের মাথায় গত বছরের ১৮ অগাস্ট সে পেপারবুক বিজি প্রেস থেকে হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা পড়ে। ততদিনে দেশ করোনাভাইরাস মহামারীর কবলে পড়ে।
নিয়ম অনুযায়ী, পেপারবুক চূড়ান্ত হওয়ার পর শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন।
পেপারবুকের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও হাই কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পেপারবুক প্রস্তুত আছে। কিছু আনুষাঙ্গিক কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ হলে ডেথ রেফারেন্সটি শুনানির জন্য বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান রায়ে নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড করেছিলেন। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমানকে খালাস দেওয়া হয় রায়ে।
হলি আর্টিজান মামলায় ৭ জঙ্গির ফাঁসির রায়, একজন খালাস ফাঁসির রায়ের পরও উদ্ধত জঙ্গিদের মুখে আস্ফালন, মাথায় আইএস টুপি |
হামলা থেকে মামলা
বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন কিছু হামলা ঘটলেও জঙ্গিরা তাদের সামর্থ্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটিয়েছিল হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে। তার আগ পর্যন্ত অন্য দেশে এই ধরনের হামলার দৃশ্য কেবল টেলিভিশনেই দেখে আসছিল বাংলাদেশের মানুষ।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে জঙ্গিদের ওই হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।
গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিদেশিদের নিয়মিত আনাগোনা এবং শিথিল নিরাপত্তার কারণেই ওই রেস্তোরাঁকে জঙ্গিরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যেদিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা।
জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে তারা। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযানের সময় ও পরে হাসপাতালে মারা যায় হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন।
রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়েন। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় মোট ১৩ জনকে।
ফিরে দেখা: হলি আর্টিজানে হামলা গুলশান হামলা: ১২ ঘণ্টার বিভীষিকা গুলশান হামলা: প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্ণনায় সেই রাত |
এরপর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।
হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত পাঁচ তরুণ রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাজ ইসলাম, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম পায়েল মারা যাওয়ায় তাদের আসামির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
নব্য জেএমবির প্রধান সমন্বয়কারী তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, জাহিদুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান, রায়হানুল কবির ও মিজানুর রহমান (ছোট মিজান) হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তে পাওয়া গেলেও জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হওয়ায় তারাও বাদ পড়েন বিচার থেকে।
দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন।
২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য শুনে বিচারক রায় দেন।