সেই রাতের ঘটনা সাড়ে তিন বছর পরও তাদের মনে নাড়া দেয়, কেউ ঘটনাটি মনে পড়তেই স্তব্ধ হয়ে যান।
সেই রাতে জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রাণহানি ছাড়াও আহত হন ৩২ জন।
বর্তমানে কদমতলী থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মাহবুব আলম প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে গুলশান হামলার সময় ছিলেন মহাখালী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই।
১ জুলাই সন্ধ্যায় ইফতারের পরপরই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে হামলার খবর পেয়ে ফাঁড়ির কনস্টেবল কবিরকে নিয়ে মোটর সাইকেলে করে ১৫ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাষ্তলে হাজির হন মাহবুব।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সেদিনের ভয়াবহতার বর্ণনা দেন তিনি।
“ডিসি, এডিসি, ওসি স্যাররা থাকলেও তখনও পুলিশ কমিশনার, র্যাবের মহাপরিচালক ঘটনাস্থলে আসেননি। আমরা ভেতরে ঢোকার পরিকল্পনা করি। কিন্তু ক্লিনিকের ওপরে কিছু মুভমেন্ট দেখে ফিরে আসি। ইতিমধ্যে কমিশনার স্যার, র্যাবের ডিজি স্যারসহ ঊর্ধ্বতন স্যাররা আসেন।
পরিদর্শক মাহবুব বলেন, “আমি একটু পিছু হটে গিয়ে পাশের ভবনের গ্যারেজে অবস্থান নিই। একটু পর দেখতে পাই বানানী থানার ওসি সালাউদ্দিন স্যার আহত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। কাছেই দেখা গেল গুলশান থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম স্যার খোঁড়াচ্ছেন এবং তার পায়ে রক্ত ঝরছিল।”
“আমার গায়ের শার্ট দিয়ে ওসি সালাউদ্দিন স্যার ও গেঞ্জি দিয়ে সিরাজ স্যারের রক্ত ঝরা বন্ধ করতে পেঁচিয়ে দেই। তখন আমার শরিরে শুধু বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটি ছিল। দ্রুত সালাউদ্দিন ও সিরাজ স্যারকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক সালাউদ্দিন স্যারকে মৃত ঘোষণা করেন।”
মাহবুব জানান, ঘটনার ভয়বহতা এবং আশপাশে সহকর্মীদের আহত দেখে নিজেই যে আহত হয়েছেন তা খেয়ালই করতে পারেননি।
“পরে কেউ একজন আমাকে বলল আপনার বাম হাতে ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। তারপর হাসপাতালে ব্যান্ডেজ করা হয়।”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, “এমন ভায়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বাকি চাকরি জীবনে আর হতে চাই না।”
মাহবুবের মতো সে রাতে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়েছিলেন গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সালাহউদ্দীন মিয়া, যিনি এখন শাহআলী থানার ওসি।
“রিপনের টিম যাওয়ার আগেই ফারুক ঘটনাস্থলে হাজির হয় এবং সেখানে যেতেই ভেতর থেকে তাদের লক্ষ্য করে বোমা ও গুলি ছোঁড়া হয়, এতে একজন কনস্টেবল আহত হয়।”
তিনি বলেন, “বোমা মারার বিষয়টি ওয়্যারলেসে ফারুক জানানোর সঙ্গে সঙ্গে গুলশান এক নম্বর থেকে দ্রুত মোটরসাইকেল নিয়ে থানায় চলে আসি। সব ফোর্স এবং বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট নিয়ে ঘটনাস্থলে রওয়ানা দেই। ডিসি স্যারকে জানালে স্যার বিভাগের সব পুলিশকে ৭৯ নম্বর রোডে যেতে বললেন ।”
সালাহউদ্দীন বলেন, “ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিকল্পনা করি। তখন ডিসি মোস্তাক স্যার, এডিসি আব্দুল আহাদ স্যার, সাহেদ স্যার, এসি রফিকুল ইসলাম স্যার, ওসি সিরাজুল ইসলাম ও বনানীর ওসি সালাহ উদ্দিন খান স্যার ছিল।
তিনি বলেন, “বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন স্যার পড়ে রয়েছেন। আমি স্যারকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। পরে পাশের ভবনের গ্যারেজে গিয়ে ডিসি স্যারকে বললে ওয়াহিদ ও মাবুবুবসহ স্যারকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাই।”
নিজের পায়ে ও বুকে স্প্লিন্টারের আঘাত লেগেছে জানিয়ে সালাহউদ্দীন বলেন, “তখন বুঝতে পারিনি যে আমিও আঘাত পেয়েছি। বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট না থাকলে বুকের আঘাতটি মৃত্যুর কারণ হয়ে যেত।”
তিনি বলেন, “সেই রাতে মারা যান বনানী থানার ওসি সালাহ উদ্দিন স্যার। কিন্তু গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের স্বজন, এমনকি আমার স্ত্রীও জেনেছে আমি মারা গেছি।
সেদিনের ঘটনার কথা জানতে চাইলে তখনকার বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “সেই রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বাকি চাকরি জীবনে দেখতে চাই না।”
বর্তমানে নারায়ণঞ্জে কর্মরত তিনি।
সে সময় গুলশান থানার ওসি ছিলেন সিরাজুল ইসলাম (বর্তমানে চকবাজার জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার) বলেন, “১ জুলাই এলেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যায়। মুখ দিয়ে কথা আসতে চায় না।”
“এসআই খালিদ ও নিজের দেহরক্ষী মানিককে নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে হলি আর্টিজানের গেইটের দিকে এগিয়ে যাই। এসময় এসআই রাকিব ও ব্যাটালিয়নের একজন কনস্টেবল যোগ দেয়।”
তিনি বলেন, “পাশের ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে গুলি করি এবং ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানাই। কিছুক্ষণ পর কমিশনার স্যার, ডিসি স্যারসহ অন্যান্য স্যারেরা আসে এবং পরিকল্পনা করে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢোকার পর পেছন দুই থেকে তিনটি বিকট শব্দ হয়।”
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “এখন প্রায়ই একা বসে বসে ভাবি- মাহবুব যদি সেই রাতে গেঞ্জি দিয়ে পা বেঁধে না দিত তাহলে তো সেখানেই রক্তশূণ্য হয়ে মারা যেতাম।”
আঘাত পাওয়া দুই পায়ে মাঝে মাঝেই যন্ত্রণা করে বলে জানান তিনি।