হলি আর্টিজান হামলা: পেপারবুক পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্টে

ঢাকার কূটনীতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে চার বছর আগে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত করা পেপারবুক হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা পড়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2020, 06:19 PM
Updated : 17 August 2020, 06:19 PM

রোববার বিজি প্রেস থেকে তা হাই কোর্টে পৌঁছানো হয়েছে বলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান জানিয়েছেন।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার পেপারবুকও রোববার সুপ্রিম কোর্টে এসে পৌঁছায়। 

নিয়ম অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় বিচারিক আদালত যখন আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন সে দণ্ড কার্যকরের জন্য হাই কোর্টের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।

এজন্য বিচারিক আদালত ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী মামলার যাবতীয় নথি হাই কোর্টে পাঠিয়ে দেন, যা ডেথ রেফারেন্স নামে পরিচিত।

পরে হাই কোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করে। এরপর তা বিজি প্রেস থেকে প্রস্তুত হয়ে আবার হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এলে সেটি যাচাই-বাছাই (স্ক্রটিনি) করে চূড়ান্ত করা হয়।

পেপারবুক চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রধান বিচারপতি তা শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন।

গত বছর ২৭ নভেম্বর এ মামলায় রায় ঘোষণার পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য মামলার নথি ৫ ডিসেম্বর ডেথ রেফারেন্স আকারে বিচারিক আদালত থেকে হাই কোর্টে আসে।

হাই কোর্টের ডেসপাস (আদান-প্রদান) শাখা সেগুলো গ্রহণ করার পর তা ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠায়।

পেপারবুক শাখা সেসব নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে ডেথ রেফারেন্স, রায়ের অনুলিপি ও আনুসঙ্গিক নথিপত্র পেপারবুক তৈরির জন্য ফেব্রুয়ারিতে বিজি প্রেসে পাঠিয়ে দেয়। পাঁচ মাসের মাথায় সে পেপারবুক হাই কোর্টে এসে পৌঁছাল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম  বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পেপারবুকের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এখন প্রধান বিচারপতি মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলে আমরা মামলা দ্রুত শুনানির জন্য উদ্যোগ নিব।”

এর আগে মাহবুবে আলম বলেছিলেন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যে ভাবমূর্তি রয়েছে তার মূল ভিত্তির উপর আঘাত করেছে হলি আর্টিজান হামলা।

তিনি বলেছিলেন, “ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্টরা এদেশে আছে, ইসলামিক স্টেটের অস্তিত্ব এখানে (বাংলাদেশে) আছে এটা প্রমাণ করার জন্যই বিদেশিসহ দেশি লোকদের মারা হয়েছে। সুতরাং এই মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির উপর দেশের ভাবমূর্তিও নির্ভর করছে।”

বিচারিক আদালতের রায় যাতে উচ্চ আদালতে বহাল থাকে সেজন্য রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

বিচারিক আদালতের রায়ে খালাস পাওয়া আসামির বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেছিলেন, “নথিপত্র দেখে যদি মনে করি যে, একজনের ব্যাপারে আপিল ফাইল করা দরকার তাহলে সেটা করব। আর যদি দেখি ফাইল করে কোনো লাভ হবে না সেক্ষেত্রে করব না।”

ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান গত বছর ২৭ নভেম্বর আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।

নব্য জেএমবির সাত সদস্যকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয় রায়ে। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।

মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র‌্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।

মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে।

বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিদেশিদের নিয়মিত আনাগোনা এবং শিথিল নিরাপত্তার কারণেই ওই রেস্তোরাঁকে জঙ্গিরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা।

রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যেদিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা।

জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে তারা। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযানের সময় ও পরে হাসপাতালে মারা যায় হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন।

রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়ে। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় মোট ১৩ জনকে।

এরপর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।

দুই বছরের বেশি সময় ধরে তদন্তের পর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেন।

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য শুনে বিচারক ২৭ নভেম্বর রায় দেন।