ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন।
সর্বোচ্চ সাজার আদেশ পাওয়া জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন এ সময় কাঠগড়াতেই উপস্থিত ছিলেন।
রায় শুনে তাদের কারও চেহারাতেই অনুশোচনার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। তাদের একজন উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, “আল্লাহু আকবর, আমরা কোনো অন্যায় করিনি।”
একটি ধারায় মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি তাদের ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। আরও দুটি ধারায় তাদের কয়েকজনে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড।
বিচারক তার রায়ে বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে আসামিরা ‘জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ’ ঘটিয়েছে। সাজার ক্ষেত্রে তারা কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি পেতে পারে না।
মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সাত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রেখে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয় রায়ে।
অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলায় বিচারের মুখোমুখি করা আরেক আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়েছে রায়ে। তাকে রায় শুনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়।
বিশ্বজুড়ে উগ্রপন্থার প্রসারের মধ্যে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল তরুণের ওই আত্মঘাতী হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।
জানা যায়, কেবল মাদ্রাসাপড়ুয়া গরিব ঘরের ছেলেরা নয়, নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া ধনী পরিবারের সন্তানরাও বাড়ি পালিয়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে; জড়াচ্ছে জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, বাংলাদেশ তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে জননিরাপত্তা বিপন্ন করার এবং আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএস এর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
“নিরপরাধ দেশি-বিদেশি মানুষ যখন রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যায়, তখনই আকস্মিকভাবে তাদের ওপর নেমে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। জঙ্গি সন্ত্রাসীরা শিশুদের সামনে এ হতাকাণ্ড চালায়। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য জঙ্গিরা নিথর দেহগুলোকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপায়। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় হলি আর্টিজান বেকারি।
“কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর ফলে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য পরিচিত বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়। ”
সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ৬(২)(অ) ধারায় সাত আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিচারক রায়ে বলেন, তাতে “ভাগ্যহত মানুষের স্বজনেরা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।”
কার কেমন সাজা
ধারা | দণ্ডিত আসামি | দণ্ড |
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এর ৬(২)(অ) ধারা | জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন | মৃত্যুদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড |
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৭ ধারা | জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ | ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড. ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও দুই বছরের সাজা |
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮ ধারা | জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন | ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড |
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৮/৯ ধারা | জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন | ৫ বছরের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ১ বছরের সাজা |
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের এর ৬(২)(অ) ধারার অভিযোগ থেকে আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, ৭ ধারার অভিযোগ থেকে মামুনুর রশিদ রিপন এবং সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১০, ১১, ১২, ১৩ ধারার অভিযোগ থেকে আসামিদের সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।
রায়ে বিচারক দণ্ডিত আসামিদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমতির জন্য রায় ও মামলার নথি হাই কোর্ট বিভাগে পাঠাতে বলেন।
প্রতিক্রিয়া
আসামি পক্ষের অন্যতম আইনজীবী দেলোয়ার হোসেন রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “আমরা মনে করি সাক্ষ্যগুলো ডাউটলেস না। অনেক কন্ট্রাডিকশন আছে, অনেক ইনকসিসটেন্সি আছে, লেক অব কোলাবেরশন আছে। আমরা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করব।”
নিয়ম অনুযায়ী ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের এই রায় প্রকাশের সাত দিনের মধ্যে হাই কোর্টে আপিল করতে পারবেন দণ্ডিত আসামিরা। এক আসামির খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষও আপিল করার সুযোগ পাবে।
সাত জঙ্গির ফাঁসির রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবদুল্লাহ আবু সাংবাদিকদের বলেন, “এই রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। একজনের খালাসের বিষয়ে আমরা পর্যালোচনা করে যদি মনে করি, আপিল করা যাবে।”
হলি অর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে সেদিন দুই পুলিশ সদস্য নিহত হন, যাদের একজন বনানী থানার তৎকালীন ওসি সালাহউদ্দিন খান।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তার ভাই রাজিউদ্দিন খান রাজু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সব জঙ্গির ফাঁসি চেয়েছিলাম, তাই হয়েছে। একজন খালাস পেয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপিল করবে।”
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন সেই জঙ্গি হামলায় দেশের ভাবমূর্তি যতটুকু ম্লান হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে তা পুনরুদ্ধার হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “সারা বিশ্বকে প্রমাণ করতে পেরেছি যে, বাংলাদেশ এ রকম হত্যাকাণ্ড হলে তার বিচার অত্যন্ত দ্রুত হয় ও সঠিক বিচার আইনি সকল সব প্রক্রিয়া ফলো করে বিচার সম্পন্ন করা হয়।
টুপিতে ‘আইএস’
গুলশানে হামলার রাতে হলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে কী ঘটেছে সে বিষয়ে দেশের মানুষ যখন নিশ্চিত হতে পারছিল না, আইএস এর মুখপত্র আমাক প্রথমে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি এবং পরে নিহত কয়েকজনের রক্তাক্ত ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে।
আইএস গুলশান হামলার দায় স্বীকার করেছে বলেও সেদিন খবর আসে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা তা নাকচ করে বলেন, বাংলাদেশি জঙ্গিদের একটি সংগঠিত ধারাই এই হামলা চালিয়েছে, যার নাম দেওয়া হয় ‘নব্য জেএমবি’।
সেই আইএস প্রসঙ্গ বুধবার রায়ের দিন আবার সামনে চলে আসে দণ্ডিত আসামিদের কর্মকাণ্ডে।
রায়ের পর আদালত কক্ষেই এক আসামির মাথায় একটি কালো টুপি দেখা যায়। সেই টুপিতে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি দল আইএস এর পতাকার চিহ্ন। পরে আসামিদের কারাগারে নেওয়ার সময় প্রিজন ভ্যানের ভেতরে আরেক জঙ্গির মাথায় একই ধরনের টুপি দেখা যায়।
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামিদের কাছে কী করে ওই টুপি গেল, সেই প্রশ্ন উঠলে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুসি আব্দুল্লাহ আবুসহ অনেকিই এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিষয়টি খতিয়ে দেখার দাবি জানান। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেন, বিষয়টির ’তদন্ত হওয়া উচিত।’
জেলার মাহবুব আলম বলেছেন, রায়ের আগে কারাগার থেকে যাওয়ার সময় আসামিদের কারও মাথায় ওইরকম কালো টুপি ছিল না। রায়ের পর তারা ফিরলে তল্লাশি করা হয়েছিল, তখনও ওইরকম কালো টুপি পাওয়া যায়নি।
বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একজন অতিরিক্ত আইজিকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার কথা জানান আইজি প্রিজনস ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোস্তফা কামাল।
আর প্রসিকিউশন পুলিশের উপ কমিশনার জাফর হোসেন বলেন, তারা ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছেন। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই টুপি আসামিরা সঙ্গে করে এনেছেন না আদালত চত্বরে কেউ তাকে দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে এ মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএস কখনো টুপি ব্যবহার করত না। আইএসের কোনো টুপি নেই। যতটুকু জানা গেছে টুপিটিতে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু লেখা ছিল। এটা অনেকেই ব্যবহার করে। এটা নব্য জেএমবির টুপি হতে পারে।”
হামলা: এক নজরে হামলা: ১ জুলাই, ২০১৬ , রাত পৌনে ৯টা। হামলাস্থল: গুলশান দুই নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হলি আর্টিজান বেকারি। হামলাকারী: মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল। (সবাই অভিযানে নিহত)। হামলায় নিহত: বিদেশিদের মধ্যে ৯ জন ইতালীয়, ৭ জন জাপানি, একজন ভারতীয় নিহত হন। নিহত বাংলাদেশিরা হলেন ইশরাত আকন্দ, ফারাজ আইয়াজ হোসেন ও অবিন্তা কবীর। নিহত পুলিশ কর্মকর্তা: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম এবং বনানী থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন খান। জীবিত উদ্ধার: ভোরে কমান্ডো অভিযান শেষে জীবিত উদ্ধার করা হয় নারী-শিশুসহ ১৩ জনকে। বিচার: এক নজরে মামলা দায়ের: ২০১৬ সালের ২ জুলাই, সন্ত্রাস দমন আইনে, গুলশান থানায়। মামলাকারী: গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস। তদন্তকারী: কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। জিজ্ঞাসাবাদ: জিম্মি অবস্থা থেকে উদ্ধার হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও পরে আসামি করা হয়নি। অভিযোগপত্র দাখিল: ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই। হামলায় জড়িত মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকেই কেবল আসামি করা হয়। হামলায় জড়িত, অভিযানে নিহত: তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সরোয়ার জাহান, তানভীর কাদেরী, বাশারুজ্জামান চকলেট, মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ছোট মিজান ও রায়হানুল কবির রায়হান। স্বীকারোক্তি: ৬ আসামি দিয়েছেন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। দেননি শরিফুল ও মামুনুর। অভিযোগ গঠন: ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর, ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু: ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর। প্রথম সাক্ষ্য দেন বাদী এসআই রিপন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ: ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর। যুক্তিতর্ক শেষ: ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর। |
গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। বিদেশিদের নিয়মিত আনাগোনা এবং শিথিল নিরাপত্তার কারণেই ওই রেস্তোরাঁকে জঙ্গিরা হামলার জন্য বেছে নিয়েছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা।
রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যেদিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা।
জবাই ও গুলি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে তারা। হামলা ঠেকাতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযানের সময় ও পরে হাসপাতালে মারা যায় হলি আর্টিজান বেকারির দুই কর্মচারী।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন।
রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়ে। ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় মোট ১৩ জনকে।
এরপর দুই বছরে হামলায় জড়িত আরও অনেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হন। গুলশান হামলার তদন্তে মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও তাদের মধ্যে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার আটজনকেই কেবল বিচারের মুখোমুখি করা সম্ভব হয়।
সেখানে বলা হয়, হলি আর্টিজানে হামলার পেছনে মূলত তিনটি উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের। ১. কূটনৈতিক এলাকায় হামলা করে নিজেদের সামর্থ্যের জানান দেওয়া; ২. বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করে নৃশংসতার প্রকাশ ঘটানো এবং ৩. দেশে বিদেশে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পাওয়া এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা।
২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর ৩ ডিসেম্বর মামলার বাদী এসআই রিপন কুমার দাসের জবানবন্দি নেওয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষে সবশেষ সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
সাক্ষ্যে তিনি বলেন, “হলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিরা বাংলাদেশে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা করে। এর অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধার বোনারপাড়া বাজার এলাকার কলেজ মোড়ে একটি বাসায় মিটিং করে প্রথমে তারা হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করে।
নব্য জেএমবির জঙ্গিরা ছয় মাস ধরে ওই হামলার পরিকল্পনা করে জানিয়ে পরিদর্শক হুমায়ুন বলেন, “তাদের উদ্দেশ্য ছিল, দেশকে অস্থিতিশীল করা এবং বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো।”
রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্য এবং আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য শোনার পর উভয় পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শুনানি হয়। সব বিচারিক কার্যক্রম শেষে গত ১৭ নভেম্বর রায়ের দিন ধার্য করে দেন বিচারক মজিবুর রহমান।
রায়কে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার রাত থেকেই আদালতপাড়াসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা বাড়ানো হয়। সকালে আট আসামিকে কারাগার থেকে নিয়ে আসা হয় আদালতে।
বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মী সকাল থেকেই উপস্থিত ছিলেন আদালত প্রাঙ্গণে। গুলশান হামলায় যেসব দেশের নাগরিকরা নিহত হয়েছিলেন, সেসব দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও রায় শুনতে আদালতে এসেছিলেন।
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে আদালতের ভেতরে ও বাইরে থেকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন প্রকাশ বিশ্বাস, সুলাইমান নিলয়, লিটন হায়দার, তাবারুল হক ও জয়ন্ত সাহা।]