এ বছরের মার্চ মাসে সিঙ্গাপুরে এক গৃহবধু সপরিবারে বাসায় ফিরছিলেন। এ সময় ট্রেনের ভেতরেই তার কন্যা শিশুটিকে কোনো আবরণ ছাড়াই বুকের দুধ পান করাচ্ছিলেন তিনি।
Published : 14 May 2017, 07:20 PM
ওই নারী তার স্বামীর মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর শিশুকে দুধ পান করাচ্ছিলেন। ফলে তিনি খেয়ালই করেননি যে, ট্রেনের একজন যাত্রী তার ছবি তুলে নিয়েছে।
ওই যাত্রী ছবিটি ফেইসবুকের একটি গ্রুপে পোস্ট করার পর ভদ্রমহিলা তার এক বন্ধুর মাধ্যমে ছবিটি সম্পর্কে জানতে পারেন। ছবিটি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়ে গেলে ভদ্রমহিলার বন্ধু-বান্ধব তাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। ছবিটির কারণে তিনি বিব্রত বোধ করতে পারেন ভেবে বন্ধু-বান্ধবরা তার কাছে অসংখ্য বার্তা পাঠাতে থাকেন।
এক পর্যায়ে ভদ্র্রমহিলা নিজেই ফেইসবুকে জানিয়ে দেন যে, ছবিটি নিয়ে তিনি ততটা মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, উন্মুক্ত স্থানে শিশুকে দুধ পান করানো ভুল নয়। তার কাছে নার্সিং কাভার ছিল, কিন্তু সেটি ব্যবহার করলেই তার কন্যা শিশুটি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
ওই নারী বলেন, “যারা নার্সিং কাভার ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তাদের উচিত খাওয়ার সময় বা কোনো কিছু পান করার সময় মুখের ওপর একটি আবরণ দিয়ে ঢেকে নেওয়া এবং এভাবে খেতে তাদের ভালো লাগে কিনা তা খেয়াল করা।”
তিনি বলেন, “আমার কাছে আমার সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্য সবার আগে, সে কীভাবে খেতে পছন্দ করে সেটিই আমার কাছে মূখ্য, অন্য কেউ কী মনে করল তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
তবে অনেকেই বলছিলেন, শিশুকে দুধ পান করানোর সময় একটা আবরণ দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেওয়া উচিত ছিল তার। এর উত্তরে ভদ্রমহিলা জানান, তার বড় ছেলে হওয়ার পর থেকেই তিনি উন্মুক্ত স্থানে সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো শুরু করেন। বড় ছেলের বয়স এখন সাত। তবে ছেলেটির জন্য তিনি নার্সিং কাভার ব্যবহার করতেন।
কিন্তু তারপরের দু’টি সন্তান হবার পর, গত চার বছর ধরে তিনি নার্সিং কাভার ব্যবহার করেন না। কারণ তার এই দুই সন্তান কাভার দিয়ে ঢাকলেই রেগে যায় এবং খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
তিনি বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে আগে কখনও কোনো সমস্যাও হয়নি। সত্যি বলতে কি, আমি কখনও খেয়ালই করি না কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে কিনা। তবে আমি বুঝি এটি উন্মুক্ত স্থান। তাই কারো যদি ইচ্ছে হয়, তারও অধিকার আছে আমার দিকে তাকানোর।
ফেইসবুকে শিশুটির মায়ের এই কথাগুলো শেয়ার হয়েছে প্রায় ৭৫০ বার এবং বেশিরভাগ মানুষই শিশুটির মাকে সমর্থন করে মন্তব্য করেছেন। সত্যিই অসাধারণ একজন মা, যিনি তার সন্তানের মঙ্গলের জন্য সবকিছুই করতে পারেন।
তবে সব দেশেই কিছু নিচু মানসিকতার পুরুষ থাকে, যারা নারীর শরীর দিয়ে নারীকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। এমন সাহসী একজন মায়ের মতোই এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে আমাদের।
বাংলাদেশের মানুষ এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত বনানীর একটি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে বন্দি করে ধর্ষণ করার ঘটনাটি নিয়ে। পত্রিকায় পড়লাম, মেয়ে দুটি অভিযোগ করেছে যে ধর্ষকরা মেয়ে দুটিকে ধর্ষণ করার সময় ভিডিও করে রাখে।
পরবর্তীতে মেয়ে দু’টিকে আবারও ব্যবহার করার আশায় ওই ভিডিওটি দিয়ে মেয়ে দুটোকে ব্ল্যাকমেইল করেছে ওই ধর্ষকরা। আমি সত্যিই খুশি হয়েছি যে মেয়ে দুটি এর প্রতিবাদ করেছে। থানায় মামলা নিতে চাইছিল না বলে অভিযোগ আছে। কিন্তু ওরা শেষ পর্যন্ত মামলা করেই ছেড়েছে।
ঘটনাগুলো এমন নাও হতে পারতো। দেখা গেল, সিঙ্গাপুরের ওই শিশুটির মা তার ছবিটি নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে সবার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দিলেন। বনানীর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী দুটি দিনের পর দিন ধর্ষকদের দ্বারা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়ে এক পর্যয়ে আত্মহত্যা করার পথ বেছে নিলেন। এমনই তো হয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
মেয়েদেরকে শরীর দিয়ে ঘায়েল করে পুরুষরা। এটি পুরুষতন্ত্রের পুরনো রাজনীতি। ওরা আরও বেশি সুযোগ নেয়, কারণ এই বিষয়গুলোতে মেয়েরা খুব সহজেই কাবু হয়ে যায়। অথচ দেখেন, ওই ধর্ষণের ভিডিওতে কিন্তু ধর্ষকের শরীরও দেখা যায়। কিন্তু পুরুষ তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। মেয়েরা শরীর নিয়ে বেশি মাথা ঘামায় বলেই ছেলেরা এত সাহস পায়।
মেয়েদেরকে শরীর দিয়ে ঘায়েল করার দিন আর নেই। মেয়েরা এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছে। কেউ কারো শরীর দেখে ফেললে, তার আর আত্মহত্যা ছাড়া উপায় নেই এমনটি ভাবার দিন আর নেই। শরীরী লজ্জা একেক দেশে একেক রকম।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে শরীর কেউ দেখে ফেললে মেয়েরা লজ্জায়-অপমানে আত্মহত্যার কথা ভেবে বসে, আর যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে মেয়েরা ‘ফ্রি দি নিপল’ নামে ক্যাম্পেইন করে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন করে। এসব দেশে মেয়েরা পুরুষের মতো ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত রাখার অধিকার চায়।
কাজেই শরীরী লজ্জা একেবারে আপেক্ষিক একটি বিষয়। একেক দেশে একেক রকম। ঠিক যেমন আমরা বলি, এক দেশের গালি আরেক দেশের বুলি, সেই রকম ব্যাপার এটি।
তবে পাঠক, ভেবে বসবেন না যে আমি বাংলাদেশের মেয়েদেরও খোলামেলা পোশাকে চলার জন্য উৎসাহিত করছি। কে, কীভাবে চলবে সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি শুধু বলতে চাইছি, কেউ ধর্ষণের ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইলে, কেউ শিশুকে দুধ পান করানো ছবি তুলে কোনো মাকে বিব্রত করতে চাইলে, মেয়েরা যেন বিব্রত না হয়ে এর প্রতিবাদ করে।
বাংলাদেশের মেয়েরা আরও প্রতিবাদী হয়ে উঠুক, এই কামনায় আজ ইতি টানছি।
লেখক: রোকেয়া লিটা, লেখক ও সাংবাদিক
ই-মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা [email protected]। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |