সিঙ্গাপুরের চিঠি: গৃহকর্মী সমাচার

সিঙ্গাপুরে আসার পর যে মেয়েটির সাথে আমার সবচেয়ে বেশি সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার নাম পারভিন (ছদ্মনাম)। সে ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2017, 12:45 PM
Updated : 30 April 2017, 12:45 PM

আমাদের এক বাঙালি প্রতিবেশির বাসায় কাজ করতো মেয়েটি। আমাদের ওই প্রতিবেশি প্রায় আশি বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। আমি তাকে দাদু বলে ডাকতাম। দাদুর স্ত্রী গত হয়েছেন বছর খানেক আগে। দুই ছেলে থাকে দুই জায়গায়। পারভিনই মূলত ওই বৃদ্ধের দেখাশোনা করে এবং পুরো সংসার সামলায়।

ওই বাঙালি দাদুর সাথে আমাদের বেশ ভালোই ওঠাবসা ছিল। ও বাসায় গেলেই পারভিন এসে জিজ্ঞেস করতো চা বা কফি কিছু খাবো কি না। আবার কখনও যদি লাঞ্চ বা ডিনারের আগে যেতাম, তখন পারভিন খেয়ে যাওয়ার জন্য জোর করতো।

আমাদের দিক থেকেও কোনো কমতি রাখতাম না। বাসায় ভালো কিছু রান্না হলেই, আমরা ওই প্রতিবেশির বাসায় দিয়ে আসতাম। বাসায় সারাদিন আমি একা থাকতাম বলে, ওরা কখনও বাইরে গেলেও আমাকে নিয়ে যেত। এভাবেই ওই প্রতিবেশির সাথে, বিশেষ করে পারভিনের সাথে আমার সখ্যতা তৈরি হয়।

পারভিন শিক্ষিত মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরপরই তার বাবা মারা যায়। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় পারভিনের। পরিবারের চাপের মুখে মালয়েশিয়ায় কর্মরত এক শ্রমিককে বিয়ে করতে বাধ্য হয় সে।

ছবি রয়টার্স

বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তান পেটে আসে তার। কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পরপরই সে জানতে পারল, তার স্বামী মালয়েশিয়ান এক নারীকে বিয়ে করেছে।

স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে সে স্বনির্ভর হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। বিদেশে গৃহপরিচারিকা পাঠায় এমন একটি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করল পারভিন। প্রশিক্ষণ শেষে নিজের ছেলেকে মায়ের কাছে রেখে, সিঙ্গাপুরে এসে কাজ করা শুরু করল সে। পারভিন এখন অনেকটাই সাবলম্বী। কয়েক বছর ধরে সিঙ্গাপুরে কাজ করে বেশ ভালো জমিয়েছে সে। ইন্দোনেশিয়ায় নিজের টাকায় একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছে সে। ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছে সে। পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়ায় নতুন একটা ব্যবসাও শুরু করেছে পারভিন।

পারভিনের মতো এমন হাজার হাজার গৃহপরিচারিকা কাজ করছে সিঙ্গাপুরে। এদের বেশিভাগই আসে ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার থেকে।

বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকারা মধ্যপ্রাচ্য কাজ করতে গিয়ে নানা সময় নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অথচ সিঙ্গাপুরের মতো একটা নিরাপদ দেশে বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকা খুব একটা দেখা যায় না। ইংরেজি বলতে না পারা এর সবচে বড় কারন কি না জানি না, তবে বাংলাদেশিরাও দেখি বাংলাদেশি গৃহপরিচারিকা খুব একটা রাখে না।

এখানে বসবাসরত এক বাংলাদেশি নারী আমাকে একদিন জানালেন, বিদেশি গৃহপরিচারিকাই তার বেশি পছন্দ। কারণ, এদেরকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠানো হয় যে, এদের পেছন সময় অপচয় করতে হয় না। সব কাজই এরা ঠিকমতো করে ফেলে। আমি অনেকের কাছে শুনেছি, একেকজন গৃহপরিচারিকা একেকটি বাসায় আট বছর বা দশ বছরও বা তারও বেশি সময় ধরে কাজ করছে।

তবে, পারভিনকে দেখে বুঝলাম, অনেক শিক্ষিত মেয়েও সিঙ্গাপুরে এসে গৃহপরিচারিকার কাজ করছে, ঠিক যেমন বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষিত যুবক সিঙ্গাপুরে এসে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। তবে, এমনিতেই কিন্তু এটি সম্ভব হয়নি। উন্নত কর্মপরিবেশই শিক্ষিত মেয়েদের এই পেশায় আসতে উৎসাহ যুগিয়েছে।

এখানে গৃহপরিচারিকা নিয়োগের ব্যাপারটা বাংলাদেশের মতো নয়। বাংলাদেশে আমরা দেখি, শহরের অবস্থাসম্পন্ন পরিবারগুলো গ্রাম থেকে বা পাশের কোনো বস্তি থেকে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সীদের দিয়ে চুক্তিপত্র বা কোনো নিয়োগপত্র ছাড়াই কাজ করিয়ে নিচ্ছে।

কোনো কোনো বাড়ির কাজের বুয়ার নির্ধারিত কোনো কর্মঘণ্টা নেই, তারা ওইসব বাড়িতেই থাকেন এবং দিন-রাত চব্বিশঘণ্টাই সেবা দিয়ে থাকেন, অথচ ওভারটাইম কাজ করার জন্য এদের কোনো বাড়তি মজুরি দেয়া হয় না।

কোনো কোনো বাসায় আবার ছুটা-বুয়া কাজ করেন। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে সংসারের কাজ-কর্ম করে দিয়ে যান। ব্যতিক্রম থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশে গৃহপরিচারিকাদের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয় বলে দেখিনি আমি।

সিঙ্গাপুরে এসব অরাজকতা একেবারেই সম্ভব নয়। গৃহপরিচারিকারা এখানে আর দশটা চাকরিজীবীর মতোই সুবিধা পেয়ে থাকেন। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মেইড সার্ভিস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সিঙ্গাপুরে গৃহপরিচারিকা নিয়োগ দেয়া হয়।

এসব এজেন্সি যেমন চাকরিদাতার সমস্যা দেখে, তেমনি গৃহপরিচারিকাদের সুযোগ-সুবিধাও দেখে তারা। সুনির্দিষ্ট নিয়োগপত্র বা চুক্তিপত্র দেয়া হয় গৃহপরিচারিকাদের। অন্যসব চাকরির মতোই গৃহপরিচারিকারা সাপ্তাহিক ছুটি, সরকারি ছুটি এবং কর্মঘন্টার বাইরে কাজ করলে ওভারটাইমের মজুরি পেয়ে থাকে। প্রতিবার চাকরির চুক্তিপত্র নবায়নকালে আবার ইনক্রিমেন্টও দেয়া হয়ে থাকে তাদের।

দুদিন আগে, আমাদের সেই প্রতিবেশির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনলাম, পারভিন ইন্দোনেশিয়ায় গিয়েছিলো ছুটি কাটতে।

ও হ্যা, বছরের এখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ে গৃহপরিচারিকাকে ছুটি কাটাতে তার দেশে যেতে দেয়া এবং তার যাতায়াত ব্যয় নির্বাহ করাও চাকরিদাতার দায়িত্ব। আর বাংলাদেশে আমরা গৃহপরিচারিকাদের ছুটিই কাটাতে দিতে চাই না, তারা যাতায়াত ব্যায় নির্বাহ করা তো পরের কথা!

গৃহপরিচারিকাদের সাথে এই অন্যায়গুলো করছি কিন্তু আমি, আপনি অর্থাৎ আমরাই। বাসায় কাজের লোক ছাড়া একটা দিনের কথাও আমরা ভাবতে পারি না। একদিন বুয়া না আসলে কোনো কোনো বাসায় খাওয়াদাওয়াই বন্ধ হয়ে যায়।

অথচ, এই বুয়াদেরও যে জরুরি কাজ থাকতে পারে, তাদেরও যে সাপ্তাহিক ছুটি লাগতে পারে, তারাও যে সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্তি অনুভব করতে পারে, তা আমরা কয়জন মাথায় রাখি?

আমরা শুধু গার্মেন্টস মালিকদের দোষ দেই যে, তারা ঠিক মতো শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয় না। শ্রমিককে ঠিক মতো বেতন-ভাতা না দেয়ার প্রাকটিস তো প্রতিটা বাড়িতে বাড়িতে, শুধু গার্মেন্টস মালিকদের দোষ দিয়ে লাভ কী?

গৃহপরিচারিকাদের কি আমরা ওভারটাইম কাজ করার জন্য মজুরি দেই? কয়জন দেই? দিনের পর দিন কী এক অন্যায় আচরণ করে যাচ্ছি আমরা তাদের সাথে!

লেখক: রোকেয়া লিটা, লেখক ও সাংবাদিক

ই-মেইল: rokeya.lita@hotmail.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!