সিঙ্গাপুরের চিঠি: ভাষা যখন চিকিৎসার অন্তরায়!

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আমার বর ধ্রুবর একজন গবেষণা পরামর্শক ফ্রান্তিশেক ক্র্যাটোচভিল আমাকে ইমেইল পাঠালেন। বাংলা ভাষা বিষয়ক তার একটি প্রজেক্টে আমি কাজ করতে আগ্রহী কিনা জানতে চাইলেন।

রোকেয়া লিটা,সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Jan 2017, 07:07 AM
Updated : 12 Jan 2017, 11:46 AM

সিঙ্গাপুরে আমার কাজ করার অনুমতি নেই। তাই, লেখালেখির পাশাপাশি এসব ফ্রিল্যান্স কাজই ভরসা।আমি ওই প্রজেক্টে কাজ করার ব্যাপারে আমার আগ্রহের কথা জানালাম।

বিষয়টি কিন্তু এমন নয় যে, এখানে আমার কাজ করার অনুমতি নেই বলেই আমি এই প্রজেক্টে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিলাম। আমার আগ্রহের সবচেয়ে বড় কারণটি হলো, এই প্রজেক্টের মাধ্যমে আমি এমন কিছু কাজ করে যেতে পারবো, যার সুফল ভোগ করবে সিঙ্গাপুরে কর্মরত আমার দেশের অভিবাসী শ্রমিকরা।

এখানে ‘হেল্থসার্ভ’ নামে স্থানীয় এনজিও অভিবাসী শ্রমিকদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য ও আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকে। এসব অভিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই চীন, বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে এসেছেন।

সমস্যা হলো, বাংলাদেশ থেকে যেসব শ্রমিক সিঙ্গাপুরে কাজ করতে এসেছেন, তাদের বেশিরভাগই ইংরেজি বোঝে না। কাজেই যখন ওই এনজিওর সেবাদানকারিরা রোগীর সাথে কথা বলে উপসর্গ জানার এবং রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন, তখন বেশ সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। কারণ সেবাদানকারিরা বাংলা বোঝেন না, ওদিকে বাংলাদেশি শ্রমিকরা ইংরেজি বোঝেন না। ফলে যে ভাষাগত সমস্যাটা হয়, তা সমাধানই এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য।

ধ্রুব নানইয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা নিয়ে গবেষণা করছে, তার গবেষণা পরামর্শকরাও একেকজন নামকরা ভাষাবিদ। সেজন্যই হয়তো ‘হেল্থসার্ভ’ ধ্রুবর গবেষণা পরামর্শক ফ্রান্তিশেকের শরণাপন্ন হয়।

এনজিওটির সাথে আলাপ করে ফ্রান্তিশেক একটি বুকলেট বানানোর পরিকল্পনা করলো। রোগীর রোগ নির্ণয়ের সময় চিকিৎসকদের যেসব শব্দ এবং বাক্য ব্যবহার করতে হয়, সেগুলোই বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে এবং ট্রান্সলিটারেশন করতে হবে যেন সেবাদানকারিরাও এই বাংলা শব্দ ও বাক্যগুলো ব্যবহার করতে পারে। আমার কাজটা খুব সহজ- অনুবাদ এবং ট্রান্সলিটারেশন করা।

মূল কাজটি করেছে মূলত ফ্রান্তিশেকের শিক্ষার্থীরাই। এরা হলেন- জাইনাব, ক্রিস্টি, জোয়ি এবং লিন।এরা সবাই নানইয়াং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা নিয়ে অনার্স পড়ছে।‘পৃথিবীর ভাষাসমূহ’ নামক একটি কোর্সের অংশ হিসেবে তারা এই প্রজেক্টে কাজ করেছে। এরা প্রত্যেকেই দুরন্ত, পরিশ্রমী এবং কাজের ব্যাপারে ভীষণ মনোযোগী। চারজন মিলে যার যার কাজ ভাগ করে নিয়েছে তারা।

বেশ কয়েকদিন পুরো দল মিলে তারা হেল্থসার্ভের চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে গিয়েছে। হাসপাতালের কর্মীদের সাথে কথা বলে তারা জানার চেষ্টা করেছে সচরাচর কোন শব্দ ও বাক্যগুলো তাদের ব্যবহার করতে হয় সেবাদান করার সময়। এসব তথ্য সংগ্রহ করে তারা একটি শব্দের তালিকা করেছে। আমি সেই শব্দগুলো উচ্চারণ করি এবং তারা সেগুলো রেকর্ড করে নেয়। আবার অনেকগুলো বাক্যের তালিকা করেছে, আমি সেগুলোর অনুবাদ এবং  ট্রান্সলিটারেশন করে দেই।

শুধু রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ক তথ্যই নয়, হাসপাতালে গিয়ে সেবা নেওয়ার আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহও লিপিবদ্ধ করা হলো এই বুকলেটে। এমনকি হেল্থসার্ভের ক্লিনিকগুলোতে যেতে হলে কোন বাসে উঠতে হবে, কোন স্টপেজে নামতে হবে-সবই রয়েছে এখানে।

বেশ কিছুদিন এভাবে কাজ করার পর বুকলেটের কাজ শেষ হয়ে গেল। বিদেশি শ্রমিকদের সেবার মান নিশ্চিত করার এই উদ্যোগ সত্যিই খুব প্রশংসনীয়। প্রত্যেকেই নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ শ্রম দেওয়ার চেষ্টা করেছে। শুনেছি বুকলেটটি এখন ব্যবহার করছে হেল্থসার্ভ।

সিঙ্গাপুরের মত একটি দেশে যেখানে চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল একটি বিষয়, সেখানে বিনামূল্যে সেবা দেওয়ার জন্য এতো সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ! এই প্রজেক্টের একজন হতে পেরে গর্ববোধ করি।

আমি হয়তো একদিন এখানে আর থাকবো না, কিন্তু যে কাজটি করে গেলাম তার সুফল ভোগ করবে বাংলাদেশ থেকে আসা শ্রমিকরা। ভাবতেই ভীষণ ভালো লাগছে।

লেখক: সাংবাদিক

ই মেইল: rokeya.lita@hotmail.com

রোকেয়া লিটার আরও লেখা