সিঙ্গাপুরের চিঠি: মেয়েদের দেখে 'হিংসা' হয়

বর্তমানে পুরো বাংলাদেশেই বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে গেছে। আর বিচ্ছেদ চাইছেন বেশি নারীরাই, পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হারে নারীরা বিচ্ছেদ চাইছেন।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2016, 11:44 AM
Updated : 8 Dec 2016, 02:14 PM

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: এ যেন বাগানের ভেতরে কোনো শহর!

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: যৌনপল্লীতে বাঙালি স্বামী-স্ত্রীর সন্ধ্যা যাপন

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: স্মার্টকার্ডে বৈষম্য চাই !

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: উচ্চশিক্ষা, শিক্ষক ও গবেষণার গল্প

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: নারীবান্ধব হাসপাতালে একদিন

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: পথ হয়ে যাও চিত্রশালা

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: প্রতিমা বিসর্জনে মানা যেখানে!

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: চিকিৎসা ও ‘গলাকাটা’র গল্প

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: বাংলাদেশি ‘টয় বয়’

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: মেয়েদের পোশাক ও ব্যর্থ ‘পাকা কলা’ তত্ত্ব

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: এক নারী দোকানির কাহিনি

Also Read: সিঙ্গাপুরে বাস যাত্রীদের কিউ

Also Read: সিঙ্গাপুরের চিঠি: প্রবাসী শ্রমিক কিংবা কষ্টের ফেরিওয়ালা

তাহলে কী ধরে নেব, সব মেয়েই খারাপ, এজন্য তারা নিজেরাই নিজেদের সংসার ভাঙছেন! নাকি বিচ্ছেদ চাইতে বাধ্য হচ্ছেন তারা?

খুব ভালো করে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থাটাই এতো বেশি জটিল যে মেয়েরা সংসার করতে পারছে না। তার ওপর আবার স্বামীদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি তো আছেই।

মেয়েরা শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পরদিনই বাড়ির কাজ ভাগাভাগি শুরু হয়ে যায়। তখন অবস্থা দেখলে মনে হয়, তাদের ছেলেটি বিয়ে করে তার জীবনসঙ্গী নয়, এনেছে একজন কাজের বুয়া।

পেশা সচেতন মেয়েরা সন্তান হওয়ার আগ পর্যন্ত কষ্ট হলেও চাকরিটা চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সন্তান হওয়ার পর মেয়েরা আর পারছে না। আমার কয়েকজন চাকরিজীবী বান্ধবীকে দেখছি, সন্তান হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

চাকরি ছাড়ার পর এভাবেই মেয়েরা সন্তানের মা হবার পাশাপাশি পরিবারের একজন 'পূর্ণকালীন বুয়া' হয়ে যায়। একজন বুয়ারও নির্দিষ্ট একটা কর্মঘণ্টা থাকে, বেতন থাকে যা দিয়ে সে ইচ্ছেমত কেনাকাটা করতে পারে। কিন্তু স্ত্রী নামক 'বুয়া'টির আর সেই স্বাধীনতা থাকে না।

যে মেয়েটার হাতে এক সময় প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা আসতো, এখন তাকে একজোড়া জুতা কিনতে হলেও স্বামীর কাছে হাত পাততে হয়। স্বাভাবিকভাবেই চাকরিজীবী মেয়েরা এই অবস্থাটি মেনে নিতে পারে না। ফলে আবারও তারা কর্মজীবনে ফিরতে চায়। আর কর্মজীবনে ফেরা মাত্রই স্ত্রী নামক বুয়াটি স্বামী বা সংসার থেকে উধাও হয়ে যায়, যা পরবর্তীতে সংসারে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সিঙ্গাপুরে আসার পর এখানকার মেয়েদের জীবনযাত্রা দেখে ভীষণ ঈর্ষাবোধ করেছি। বাংলাদেশের মেয়েরা সংসার জীবনে কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে, সিঙ্গাপুরের মেয়েরা হয়তো সেটা ভাবতেই পারবে না।

আমার এক প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরের নাগরিক আর তার স্ত্রী চাইনিজ। আমি তাদের কখনও রান্না করতে দেখিনি। স্বামী প্রকৌশলী আর স্ত্রী লেখাপড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে। স্বামীটির বেশিরভাগ সময়ই রাতে অফিস থাকে। সে প্রতিদিনই অফিস শেষ করে সকালে বাসায় ফেরার সময় তার স্ত্রীর জন্য খাবার নিয়ে আসে। স্ত্রী খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, ফেরে রাতের খাবার খেয়ে।

এদিকে স্বামী সারাদিন ঘুমানোর পর বিকালবেলা উঠে বাইরে গিয়ে খেয়ে-দেয়ে আবার অফিসে চলে যায়। রান্নার ঝামেলা নেই।

ভাবছেন, কী যান্ত্রিক তাদের জীবন? একেবারেই নয়। পুরো সপ্তাহ কাজের পর দুটো ছুটির দিন তারা ইচ্ছেমত আনন্দ করে। কখনও কখনও দেশের বাইরে বেড়াতে যায়।

ভাবছেন, একটা সন্তান হলে ওই দম্পতির আর এতো সুখ থাকবে না, তাই না? আপনি ভাবতেই পারবেন না, এখানকার দিবাযত্নকেন্দ্রগুলো এতোটাই নিরাপদ যে ১৮ মাস বয়স হলেই অনেক মা তার সন্তানকে দিবাযত্নকেন্দ্রে রেখে যান। সারাদিন শিশুরা এখানে থাকছে,পাশাপাশি লেখাপড়াও করছে। মা-বাবা আফিস শেষ করে এসে সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমার আরেক চাইনিজ প্রতিবেশী এক নারীকে দেখি, প্রতিদিন তিনবার সে বাইরে গিয়ে হয় খেয়ে আসে, নয়তো খাবার কিনে নিয়ে আসে। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি রান্না কর না?

সে বলে, কীভাবে রান্না করতে হয় সে জানে না।

আসলে এখানে প্রতিটা আবাসিক এলাকায় এক বা একাধিক ফুডকোর্ট থাকে। প্রায় সব ধরনের খাবারের জন্য আলাদা আলাদা দোকান আছে। যার যা পছন্দ, সে সেটিই কিনে খাচ্ছে।

আপনি ভাবতেই পারেন, প্রতিদিন হোটেলের খাবার খেয়ে থাকা যায় না। সেই হোটেলের খাবার যদি হয় স্বাস্থ্যসম্মত, নিয়মিত সরকারের লোকজন এসে খাবারের মান যাচাই করে, তাহলে কি করবেন? আমার ধারণা, আপনিও বাসায় রান্না বন্ধ করে দেবেন।

পাশের বাসার দাদুর কথা তো আগেও লিখেছি। তার দুই ছেলে। দুজনেই তাদের স্ত্রী-সংসার নিয়ে অন্য জায়গায় থাকেন। এই ৮৭ বছর বয়স্ক বৃদ্ধকে দেখাশোনা করে একজন ইন্দোনেশিয়ান বুয়া। এই বৃদ্ধকে দেখলে, আমার সেই বান্ধবীটির কথা মনে পড়ে। স্বামী চাকরি করে চট্টগ্রামে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ির দেখাশোনা করতে হবে বলে বান্ধবীটি ঢাকায় পড়ে আছে। স্বামীর কাছে যেতে ইচ্ছে হলেও সংসার শেকল পড়িয়ে রেখেছে পায়ে।

এভাবেই বাংলাদেশের মেয়েরা ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে সব সখ-আহ্লাদ বিসর্জন দেয় কেবল সংসারের জন্য। কিন্তু হঠাৎ যদি সংসার ভেঙে যায়! আপনি তো অনেক কিছুই করেছেন সংসারের জন্য, কি পেলেন আপনি সংসার থেকে? কিছুই না।

বিচ্ছেদের পর ক্ষেত্র বিশেষে মোহরানা ছাড়া আর কিছুই জোটে না বাংলাদেশের মেয়েদের কপালে। অথচ সিঙ্গাপুরের আইন এতোটাই নারীবান্ধব যে স্বামী কোনও জমি, ফ্ল্যাট বা অন্য কোনও সম্পদ করলে স্ত্রী তার ভাগীদার হয়ে যায়। বিচ্ছেদ হলে স্বামী যা যা সম্পদ করেছে, তার সমান ভাগ দিতে হবে স্ত্রীকে।

এখন বলুন তো, সিঙ্গাপুরের মেয়েদের প্রতি হিংসে হচ্ছে না আপনার? ওদের দেখলে সত্যিই খুব হিংসে হয় আমার!

রোকেয়া লিটা

সাংবাদিক

rokeya.lita@hotmail.com

ছবি তুলেছেন জাকারিয়া রেহমান