সিঙ্গাপুরের চিঠি: যে উপায়ে সবাই ফ্ল্যাট বা বাড়ির মালিক

ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকাগুলোয় গেলে নানান নকশার বাড়ি-ঘর চোখে পড়ে। বিশেষ করে ধানমণ্ডি, গুলশান ও বনানীর আবাসিক এলাকার বাড়ি-ঘরগুলো বেশ দৃষ্টিনন্দন।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Dec 2016, 12:12 PM
Updated : 25 Dec 2016, 10:23 AM

একেকটা বাড়ির সৌন্দর্য একেক রকম এবং একটার সাথে আরেকটার মিল নেই বললেই চলে। কিন্তু ঢাকার দৃষ্টিকটু দিকটি হলো কারও খুব সুবিশাল কারুকার্যখচিত অট্টালিকা, কারও আবার থাকারই জায়গা নেই।

সিঙ্গাপুরে এসে আবাসিক এলাকা মন দিয়ে দেখলে আপনার মধ্যে এক ধরণের একঘেঁয়েমি ভাব আপনাকে পেয়ে বসবে।

ঢাকার মতো অত বৈচিত্র্যময় নকশার ভবন দেখতে পাবেন না। আশপাশে যেদিকে তাকাবেন, মনে হবে সবগুলো বাড়িই যেন একই রকম।

বিশাল বিশাল একেকটি ভবন। আর সবগুলো ভবনই দেখতে একই রকম। একটি ভবনের সাথে আরেকটি ভবনের পার্থক্য হলো কেবল একটি ব্লক নম্বর। অর্থাৎ প্রতিটি ভবনের জন্য একটি করে ব্লক নম্বর দেওয়া আছে।

আমি প্রথম যখন সিঙ্গাপুরে এসেছিলাম, তখন এই বিষয়টি আমাকে বেশ পীড়া দিয়েছে। মনে হয়েছিল, বাড়িগুলো তো বটেই, এমনকি রাস্তায় লাগানো গাছগুলোও যেন একই রকম। এই একঘেঁয়েমি ব্যাপারটার মধ্যে স্বস্তির ব্যাপারটি হলো- এইখানে কোনো বস্তি নেই, কেউ গৃহহীন নয়, কেউ রাস্তায় ঘুমায় না।

সিঙ্গাপুরের হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ সিঙ্গাপুরের নাগরিকই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক, যার ৮০ ভাগই 'এইচডিবি' ফ্ল্যাটের মালিক।

নিশ্চয়ই ভাবছেন, এইচডিবি ফ্ল্যাট আবার কী জিনিস? সিঙ্গাপুরের হাউজিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ড সিঙ্গাপুরের জনগণের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে সহজ শর্তে বিক্রি করে। আর এগুলোকেই হলো, 'এইচডিবি ফ্ল্যাট'।

সহজ শর্ত আসলে কতটা সহজ? আমি বলবো খুবই সহজ।

আমার পরিচিত এক বাংলাদেশি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি একটি এইচডিবি ফ্ল্যাট কিনেছেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ফ্ল্যাট কেনার এতো টাকা কোথায় পেলেন?

তিনি জানান, বাংলাদেশে থাকা তার জায়গা-জমি বিক্রি করে দিয়ে, সিঙ্গাপুরের ফ্ল্যাটের জন্য কেবল 'ডাউন পেমেন্ট' (এককালীন প্রথম কিস্তি) পরিশোধ করেছেন তিনি। এরপরেই তিনি ফ্ল্যাটে উঠে গেছেন। এখন মাসে মাসে ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ করছেন। খেয়াল করে দেখুন, এখন কিন্তু তাকে আর অন্য কোথাও বাসা ভাড়া দিতে হচ্ছে না, কারন তিনি ফ্ল্যাটে উঠে গেছেন।

অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হলে যে বাসা ভাড়া দিতে হত, তা দিয়ে তিনি নিজের ফ্ল্যাটেরই কিস্তি পরিশোধ করছেন, পাশাপাশি একটি ঘর ভাড়াও দিয়েছেন। ঘর ভাড়া থেকেও আয় হচ্ছে প্রতিমাসে।

বাংলাদেশে যারা ফ্ল্যাট কেনেন, তাদেরকে সব টাকা পরিশোধ করতে হয়। একদিকে ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়, অন্যদিকে নিজের বাসা ভাড়াও দিতে হয়। সিঙ্গাপুরের মত এতো সহজ শর্তে ফ্ল্যাট কেনা গেলে, বাংলাদেশেও সবাই একটি করে ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যেত।

আর তাছাড়া সিঙ্গাপুরে তো সরকার উদ্যোগী হয়ে জনগণের এই বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশে সরকার পারছে না এভাবে জনগণের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে, কিন্তু দু/একদিন পরপরই ঠিকই বস্তি উচ্ছেদ করছে তারা।

আর যারা বস্তিতে বাস করছে, তার দায় কার? নিঃসন্দেহে সরকারের, সরকার জনগণের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেনি তাই, জনগণ বস্তিতে বাস করছে।

সিঙ্গাপুরে সরকার যে শুধু জনগণের বসবাসের জন্য বড় বড় ভবন বানিয়ে দিয়ে বসে আছে, তা কিন্তু নয়। এসব ভবনের রক্ষণাবেক্ষণ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা, সবকিছুতেই রয়েছে সহজ হিসেব-নিকেশ। এতো উঁচু ভবন থেকে নিচে নেমে গিয়ে প্রতিদিন ডাস্টবিনে বাসার আবর্জনা ফেলে আসা তো নিঃসন্দেহে কষ্টকর।

আমরা এখন যে ভবনটিতে বাস করি, সেটি ১৫ তলা। আমরা থাকি ৯ তলায়। আর এই ৯ তলায় রয়েছে ৮টি ইউনিট।

এই আটটি ফ্ল্যাটের জন্য ৯ তলার এক কোনায় একটি রাবিশ শ্যুট (ময়লা ফেলার জন্য নির্ধারিত স্থান) রয়েছে। আমরা ৯ তলা থেকেই এই রাবিশ শ্যুটে ময়লা ফেলি, ময়লা নিচতলায় জায়গামত গিয়ে পড়ে।

প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসে এই ময়লা নিয়ে যায়। প্রতিটি ভবনে দুটো করে লিফট, আর এই লিফটগুলোতে প্রত্যেকটিতে দুটো করে পুলিশ ক্যামেরা বসানো। ১৫ তলা পর্যন্ত লিফটে করে যেতেও অনেক সময়ের ব্যাপার। এই সময়ের মধ্যে লিফটে যে কোনো ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু পুলিশ ক্যামেরা বসানো থাকায় কোনো সমস্যাই হয় না।

কারণ সবার মনেই ভয় আছে, উল্টোপাল্টা কিছু করলেই ধরা পড়ে যাবে। ভবনের নিচে খোলামেলা, সবাই যে যার মত সাইকেল ফেলে রেখেছে, সারাদিন পড়ে থাকে এসব সাইকেল, কেউ হাত দেয় না। এখানেও একই ব্যবস্থা, চারপাশে পুলিশ ক্যামেরা বসানো।

ঢাকায় আমি দীর্ঘদিন বাসা ভাড়া নিয়ে থেকেছি। কখনও রান্না করেছি, কখনও করিনি। একটা মানুষ আর কতটুকুই বা পানি খরচ করতাম! কিন্তু মাস শেষে পানির বিল, গ্যাস বিলটা কিন্তু ঠিকই অন্য বাসাগুলোর মতই দিতে হতো। এখানে আমরা পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ যতটুকু ব্যবহার করবো, ঠিক ততটুকুই বিল হবে।

পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা মিটার। আমাদের প্রতিবেশিদের চেয়ে আমাদের গ্যাস বিল কয়েকগুণ বেশি দিতে হয়, কারণ আমরা বাসায় রান্না করে খাই আর আমাদের প্রতিবেশিরা বাইরে খাবার খায়।

বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা নেই, এতে করে দেশের যে কি পরিমাণ সম্পদ নষ্ট হয় তা আমরা হয়তো চিন্তাও করতে পারবো না।

শীতের দিনে ঢাকার অনেক বাসাতেই আমি দেখেছি সারাদিন গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে। কোনো সমস্যা তো নেই, কারণ মাস শেষে তো ওই নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসবিলই দিতে হয়। তো জনগণ অপচয় করবে না কেন বলুন?

সিঙ্গাপুরের আবাসিক এলাকাগুলোতে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মত বিষয় হলো গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন। রাস্তায় বা বাড়ির আশেপাশে কোথাও কেউ গাড়ি ফেলে রাখতে পারে না। প্রতিটি ব্লকের পাশেই রয়েছে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন।

ভাবতে পারেন, সিঙ্গাপুর আমাদের চেয়ে কত এগিয়ে? অথচ, এই সিঙ্গাপুরকেই ১৯৪৭ সালে 'ব্রিটিশ কলোনিয়াল গভর্মেন্ট হাউজিং কমিটি রিপোর্টে' পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বস্তিগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

সেই সিঙ্গাপুর আজ এতো উন্নতি করেছে। জনগণের প্রতি রাষ্ট্রনায়কেরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে সবই সম্ভব। ২০০১ সালে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় দিবসের র‍্যালিতে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, “যত গরীবই হোক না কেন, কোনো সিঙ্গাপোরিয়ানই মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হবে না”।

প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রতির প্রতিফলন দেখা যায় সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসায়। 

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: rokeya.lita@hotmail.com

ছবি কৃতজ্ঞতা: জাকারিয়া রেহমান

রোকেয়া লিটার আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি,  দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!