সিঙ্গাপুরে আসার প্রায় আট মাস হয়ে গেল। অথচ এখানকার বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে আমার তেমন একটা পরিচয় নেই। মাঝে মাঝে যা দু-এক জনের সঙ্গে কথা হয়েছে,তা ওই লেখালেখির সুবাদেই।
Published : 03 Nov 2016, 04:34 PM
সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত ‘বাংলার কন্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক একেএম মোহসীন ভাইয়ের কথা বলছি। তার পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখছি,ফলে তার সাথে আলাপ হয় মাঝে মধ্যে। পত্রিকার পাশাপাশি প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ‘দিবাশ্রম’ নামে একটি সংগঠন চালান তিনি। সেরাঙ্গুন এলাকার রাওয়েল রোডে একটি অফিস ভাড়া নিয়ে বাংলার কন্ঠ,দিবাশ্রম পরিচালনা করছেন তিনি।
শ্রমিকদের মাঝে বিনোদন আর সাংস্কৃতিক আবহ ধরে রাখার জন্য তিনি নিজের উদ্যোগে একটি পাঠাগার গড়ে তুলেছেন। সেখানে রয়েছে পরিচিত প্রায় সব লেখকের বই। আছে গান-বাজনার জন্য তবলা আর হারমোনিয়ামেরও ব্যবস্থা।
তিনি যে পত্রিকা প্রকাশ করছেন,প্রবাসী শ্রমিকরাই মূলত সেই পত্রিকার পাঠক ও লেখক। শুনেছি, শ্রমিকদের নিয়ে তিনি মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুরের মূলধারার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। তেমনি একটি অনুষ্ঠান সিঙ্গাপুর বিনিয়াল ২০১৬।
মোহসীন সাহেব প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমাকে জানিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানের কথা। ২৭ অক্টোবর থেকে ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনব্যাপি সিঙ্গাপুর আর্ট মিউজিয়ামে চলে এই অনুষ্ঠান। আমাদের যেতে বলা হলো ২৯ অক্টোবর,শনিবার। শনিবারে অনুষ্ঠানটির একটি বিশেষ চমক ছিল। ওই দিন প্রবাসী বাংলাদেশি কবিরা সিঙ্গাপুর আর্ট মিউজিয়ামে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেছেন।
ছুটির দিন হওয়ায় সুবিধে হলো আমাদের। আমি আর আমার বর দু'জন চললাম 'বাংলার কণ্ঠ' অফিসে। আয়োজকরা আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি পাঠাবে 'বাংলার কণ্ঠ' অফিসে।
মোহসীন সাহেব তখনও অফিসে এসে পৌঁছাননি। আমরা অফিসে ঢুকেই দেখতে পেলাম 'বাংলার কণ্ঠে'র লেখকরা গোল হয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখা মাত্রই তারা চিনতে পারলেন,কারণ 'বাংলার কণ্ঠ' পত্রিকায় তারা আমার লেখা পড়েন। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সাথে আমার বেশ আলাপ জমে উঠল।
আমি তাদের কবিতা শুনতে চাইলাম। সবাই নিজের কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। শুধু যে কবিতার ভাষাই সুন্দর তা কিন্তু নয়,অসাধারণ তাদের আবৃত্তিও।
বেশ কয়েকজনের কবিতা শুনলাম,কিছুক্ষণ পর আবার সেগুলো ভুলেও গেলাম। একজনের কবিতা এখনও মাথায় গুনগুন করছে। তিনি হলেন অসিত কুমার বাড়ৈ (বাঙালি)। তার 'ফেরিওয়ালা' কবিতাটি আপনাদের জন্য উদ্ধৃত করছি এখানে-
“আমি ফেরিওয়ালা হতে চেয়েছিলাম,
প্রেমের ফেরিওয়ালা, ভালোবাসার ফেরিওয়ালা,
হৃদয়ের ক্যানভাসে আঁকতে চেয়েছিলাম ভালোবাসার ছবি।
মাঝপথে এসে আচমকা এক ঝড়ো হাওয়ায়
ছিঁড়ে গেছে আমার অন্তর আকাশে টাঙানো রঙিন ক্যানভাস,
তাই আজ আমি কষ্টের ফেরিওয়ালা সেজে সুদূর
প্রবাসে কাউকে না বলা কষ্টগুলো ফেরি করে বেড়াচ্ছি।
তোমার গোলাপী উষ্ণ ঠোঁটে
আলতো করে একটা চুমু দিয়ে, খোঁপায় গুঁজে দিতে
চেয়েছিলাম সদ্যফোটা রজনীগন্ধার কলি।
দেখো, দেখো আজ সেই রজনীগন্ধা
প্রবাসের অট্টালিকার প্রস্তরের নিচে চাপা পড়ে আছে,
জানি কংক্রিটের তৈরি পুরু দেয়াল ভেদ করে তার সুবাস
তোমার কাছে এখন আর পৌঁছায় না।
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে নিয়ে স্মৃতিসৌধে যাবো,
বোটানিক্যালের বেঞ্চে তোমার কোলে মাথা রেখে স্বপ্ন তৈরি করবো।
সারা দিনের ঘর্মাক্ত ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরে তোমার উচ্ছ্বলতা জড়ানো
শ্যামল হাতের কোমল স্পর্শে আমি রিক্ত হয়ে তোমাকে সিক্ত করবো।
এবারেও দেখতে দেখতে কেটে গেল তেরশত বিরানব্বইটি দিন,
জানো তুমি বিহীন একেকটি দিন যেন একেকটি শতাব্দী মনে হয় আমার কাছে।
প্রতিটা মুহূর্ত যে যন্ত্রণা যে কষ্ট বয়ে বেড়ায় আমার এ হৃদয়,
তা প্রবাসের সুরম্য অট্টালিকার নিচে চাপা পড়ার চেয়েও যে অনেক কষ্টের।
একটু অপেক্ষা করো আরতো মাত্র ক’টা দিন;
আমি আমার ফেরি করা সমস্ত কষ্টগুলোর নির্যাসে তৈরি একটু সুখ
একটু ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে ফিরে আসবো,
তখন সত্যিই আমি হবো- সুখের ফেরিওয়ালা,আনন্দের ফেরিওয়ালা
প্রেমের ফেরিওয়ালা,ভালোবাসার ফেরিওয়ালা !"
ঠিক সময়ে গাড়ি এসে গেল। আমরা সবাই সিঙ্গাপুর আর্ট মিউজিয়ামে পৌঁছে গেলাম। বিশাল একটি মিউজিয়াম। অনেকগুলো ভবন ভেতরে। আমরা যে ভবনটিতে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম,সেখানে বিনিয়ালের মূল আয়োজন।
আয়োজনের অন্যতম একটি দিক হলো,একটি গ্যালারিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভাস্কর্যশিল্পী রাথিন বর্মন তার চিত্রকর্মে তুলে ধরেন অভিবাসী শ্রমিকদের লিটল ইন্ডিয়ার বাসস্থান,জীবন ব্যবস্থা,নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং অভিবাসীদের স্বদেশ স্মৃতি। আর সেখানে আয়োজন করা হয়েছিল বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের এই কবিতা পাঠের আয়োজন,যেন শিল্পের বিষয়বস্তু জীবন ফিরে পেয়েছে এই অভিবাসী কবিদের পদচারণায়।
যখন থেকে সিঙ্গাপুরের চিঠি লিখছি, আমার প্রায় প্রতিটা চিঠিতে উঠে এসেছে নিজেদের সমালোচনা আর সিঙ্গাপুরের প্রশংসা। আমার চিঠিগুলোর উত্তরে অনেকে আমার কাছে ইমেইল করেন। কেউ কেউ অভিযোগের সুরে আমাকে লেখেন,আমি কেন সবসময় আমাদের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরি? বিশ্বাস করুন,এটি নিয়ে আমার মাঝেও এক ধরনের অস্বস্তি ছিল। সিঙ্গাপুরে এই বাংলাদেশি কবিদের সাথে পরিচয় না হলে, অস্বস্তিটা হয়তো থেকেই যেত। জানাই হতো না,এনারা একেকজন কত বড় মাপের লেখক !বাংলাদেশের মানুষ হয়তো এনাদের খুব একটা চেনেন না। কিন্তু সিঙ্গাপুরে প্রবাসী বাংলাদেশি কবিদের ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে। সিঙ্গাপুরের মূল ধারার নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রয়েছে এনাদের সরব উপস্থিতি।
হয়তো ভাবছেন,দু-চারটি কবিতা লিখে কবি হয়ে গেছেন এনারা। মোটেই না। এদের একেকজন রীতিমত বই রচনা করেছেন। এই অসিত কুমার বাড়ৈ এর কথাই ধরুন। তিনি অভিবাসী শ্রমিক ও গৃহকর্মীদের নিয়ে শিক্ষামূলক নাটক ‘গার্লফ্রেন্ড’ রচনা করেন। নাটকটি সিঙ্গাপুরে মঞ্চায়িত হয় এবং শ্রমজীবী অভিবাসীদের মাঝে বেশ প্রশংসিত হয়। অসিত কুমার একটি উপন্যাসও রচনা করেন। তার উপন্যাসের নাম 'অনেক দিনের ফুল'। 'ফেরিওয়ালা' নামে একটি কাব্যগ্রন্থও লিখছেন তিনি,আগামী বই মেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
পরিচিত হলাম প্রবাসী লেখক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বাবুর সাথেও। তারও বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৫ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় 'প্রবাস থেকে বলছি' নামে তার একটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এ বছর একুশে বই মেলায় 'কষ্ট বিলাস','একশ আশি ডিগ্রি' নামে দুটি কবিতার বই এবং 'বন্ধু তুমি সায়াহ্নে' নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন তিনি। আর এই সবগুলো বইয়েরই প্রকাশক ছিল 'বাংলার কণ্ঠ'।
আরও ছিলেন প্রবাসী লেখক রাশিদুল ইসলাম জুয়েল,মহসিন আকবর,মো.শহিদুল ইসলাম,নীলিমা নুপুর,হাসনাত মিলন,কনক বেলালসহ অনেকে। এনারা নিয়মিত 'বাংলার কণ্ঠে' লেখেন। পাশাপাশি সবাই কম-বেশি উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন এবং করছেন। আর এই সবকিছুর পেছনের কারিগর হলেন একজন, একেএম মোহসীন।
হ্যা, 'বাংলার কণ্ঠ' ও 'দিবাশ্রমে'র প্রতিষ্ঠাতা একেএম মোহসীনের কথাই বলছি। প্রায় ছাব্বিশ বছর আগে তিনি পাড়ি জমান সিঙ্গাপুরে। শুরুতে কম্পিউটার শেখার জন্য সিঙ্গাপুরে আসলেও কাজ পেয়ে যান একটি প্রিন্টিং প্রেসে। একে একে অন্য বাংলাদেশিরাও আসতে শুরু করেন সিঙ্গাপুরে। একটা পর্যায়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশিদের জন্য একটি পত্রিকা প্রকাশের। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ২০০৬ সালে প্রকাশ করেন এই 'বাংলার কণ্ঠ'। সেই থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে আজকের এই 'বাংলার কণ্ঠ',যার আবিষ্কার এইসব গুণী প্রবাসী সাহিত্যিক।
মোহসীন জানান,'বাংলার কণ্ঠে'র অনেক লেখক এখন সিঙ্গাপুরে প্রতিষ্ঠিত কবি। কেউ কেউ সিঙ্গাপুরের খ্যাতনামা প্রকাশনী থেকে বইও প্রকাশ করেছেন। তবে তিনি কষ্ট পান তখনি,যখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর তারা আর 'বাংলার কণ্ঠ'কে মনে রাখেন না। তারপরও থেমে নেই 'বাংলার কণ্ঠে'র কর্মতৎপরতা। নতুন নতুন প্রতিভা বের করে আনছেন তিনি।
এ বছরের শুরু থেকেই সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা খবরের শিরোনাম হয়ে আসছেন। কারণ বেশ কিছু বাংলাদেশি শ্রমিকের বিরুদ্ধে মৌলবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পরার অভিযোগ পাওয়া যায় এবং কারো কারো বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুর এবং বাংলাদেশের গণমাধ্যমে উঠে আসে সেসব খবর। এতো এতো খারাপ খবরের মধ্যে লুকিয়ে ছিলো এই সুখবরগুলো। আমার বিশ্বাস,খবরগুলো নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক।
মোহসীন বলেন, "এইসব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই পারে প্রবাসী শ্রমিকদের মৌলবাদী কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। আর তাই আরও ব্যাপক আকারে সিঙ্গাপুরে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাঝে এই সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আবহ ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। আর এজন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সহযোগীতা।"
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক, মেইল: [email protected]
এই লেখকের আরও: