বিশেষ করে আমার বর ধ্রুবর কাজের ব্যস্ততা বড় একটা বাঁধা হয়ে ছিল। ধ্রুব যেমন কাজ পাগল মানুষ, তেমনি আবার ঘুরতেও ভীষণ পছন্দ করে সে।
তাই ঠিকই সবদিক সামলে বেড়াতে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেললো। সে হোটেল বুকিং দিয়েছে, ফ্লাইটের টিকেটও কেটে ফেলেছে, যার কিছুই আমি জানতাম না। হঠাৎ একদিন বলে- অমুক তারিখে আমরা লাংকাওয়ি যাবো।
এবারও তাই করেছিলাম। গুগল করে আগেই জানতে পেরেছিলাম, এ শহরে কোনো গণপরিবহন নেই। বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পথে একটি কাউন্টারে জানতে চাইলো- কোথায় যাবো?
ধ্রব বললো, কুয়াহ যাবো।
কাউন্টারে ক্যাবের ভাড়াটা রেখে দিয়ে একটা টিকেট দিলো। আমরা টিকেট নিয়ে বিমানবন্দর থেকে বের হতেই দেরি লাইন ধরে ট্যাক্সি ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে।
টিকেটে ট্যাক্সি ক্যাবের নম্বর দেয়া ছিল, ওই নম্বরের একটি ক্যাব এসে আমাদের কুয়াহ-এর দিকে নিয়ে গেল।
ক্যাবে করে কিছুদূর পথ যেতেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি লাংকাওয়িতে আমাদের স্বাগত জানালো। পুরোটা পথ চারপাশ দেখতে দেখতে কুয়াহ পর্যন্ত গেলাম। সত্যি বলতে কি, লাংকাওয়ি শহরটা আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। এখানে চোখ জুড়িয়ে যাওয়ার মত আহামরি কোনো সৌন্দর্য নেই।
বরং মনে হচ্ছিলো, পুরোনো একটি জীর্ণশীর্ণ শহরে এসেছি। গত বছর পেনাং-এ গিয়ে আমি বেশ অভিভুত হয়েছিলাম। শহরটির একদিকে তাকালে উঁচু পাহাড় আর অন্যদিকে সমুদ্র।
লাংকাওয়িতেও ছোট ছোট অনেক পাহাড় রয়েছে, কিন্তু পেনাং- এর মত সুন্দর নয়। পেনাং-এর পাহাড়গুলোতো ধাপে ধাপে চমৎকার করে ঘরবাড়ি তুলে অন্য রকম এক আবেদন তৈরি হয়েছে, দেখলে মনে হয় ছবির মত একটি শহর।
পেনাং এর মত অত সুন্দর না হলেও, লাংকাওয়িতে ঘুরতে যাওয়ার জন্য অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে।
আমরা মাত্র দুদিনের জন্য লাংকাওয়িতে গিয়েছিলাম। কাজেই, হোটেলে বসে বসে আরাম আয়েশ করার সময় নেই।
বিমানবন্দর থেকে হোটেলে পৌঁছেই ফ্রেশ হয়ে আমরা খেতে বের হলাম। হোটেলের পাশেই রয়েছে থাই হোটেল, চায়নিজ হোটেল, কিন্তু কী অদ্ভুত হাতের কাছে কোনো মালয় হোটেল পেলাম না!
যা বুঝতে পারলাম, এখানে চায়নিজদের উপস্থিতি বেশ ভালোই। আমরা চায়নিজ একটি হোটেলে খেয়ে আমরা 'আন্ডার ওয়াটার সি ওয়ার্ল্ড'-এর দিকে রওয়ানা দিলাম।
যেতে যেতে আমি ধ্রুবকে ঠাট্টা করে বলছিলাম, 'কই যে যাচ্ছো, গিয়ে দেখবা কয়েকটা ফিশ অ্যাকোয়ারিয়াম'।
কিন্তু না, 'আন্ডার ওয়াটার সি ওয়ার্ল্ড' আমাদের হতাশ করেনি অতটা। ভেতরে ঢুকে দেখি নানান প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক শৈবাল ও অন্যান্য প্রাণি।
এমনভাবে কাঁচ দিয়ে এটি বানানো হয়েছে যে মাথার ওপরে পানি, চারপাশে পানি, মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলাম আর কাঁচের ভেতরে রাখা মাছ ও শৈবাল দেখছিলাম।
'আন্ডার ওয়াটার সি ওয়ার্ল্ড' এর পাশেই পান্তাই চেনাং সমুদ্র সৈকত। আমরা সমুদ্রের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অন্য কোনও সমুদ্রে এলেই আমার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা খুব মনে পড়ে।
পেনাং এবং লাংকাওয়ির সৈকত দেখলাম, কিন্তু কক্সবাজারের সৈকতের মত বিশালতা পাইনি আমি। পেনাং, লাংকাওয়ির সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ, সাগরের গর্জন নেই, নেই কোনও তেজ।
তবে, লাংকাওয়ির সমুদ্রকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, এটি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য।
আমরা সাগরের পাশেই একটি ক্যাফেতে বসে পানীয় নিলাম। আমি আইস লেমন টি পান করছিলাম আর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ক্যাফেতে একজন শিল্পী গিটার বাজিয়ে একের পর এক ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ গান গেয়েই চলেছেন। সেটি ছিল কী অসাধারণ এক নৈসর্গিক সন্ধ্যা বলে বোঝাতে পারবো না! ক্যাফের টেবিলে টেবিলে চলছে বিয়ার বা মদের আড্ডা।
এই সৈকতটি পর্যটকদের বেশ পছন্দ, সেটি দেখেই বোঝা যায়। নারী পর্যটকরা এখানে অনায়াসে সংক্ষিপ্ত পোশাক পড়ে ঘোরাফেরা করছে, সৈকতে ব্যাডমিন্টন খেলছে, কোনো অস্বস্তি নেই।
পান্তাই চেনাং সমুদ্র সৈকতের খুব কাছেই বেশ কিছু একতলা হোটেল রয়েছে। আসলে সমুদ্র উপভোগ করতে চাইলে এসব হোটেলেই থাকা উচিৎ। ঘর থেকে বের হলেই সমুদ্র!
ধ্রুব খুব আক্ষেপ করে বললো, আহা, আগে জানলে তো কুয়াহতে না গিয়ে এখানেই উঠতাম!
রাতে খাওয়ার সময় হয়েছে। দশটা বাজতে না বাজতেই আশেপাশে সব হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে, দোকানপাটও বন্ধ প্রায়। আমরা কোনো উপায় না দেখে আমাদের হোটেলের সামনেই একটা নাইট মার্কেটের ফুড কোর্টে খেলাম।
কিন্তু অদ্ভুত! এসব দোকানের খাবার যেমন সুস্বাদু, তেমনি দামও কম। দুপুরে চায়নিজ রেস্তোরাঁয় শুধুশুধু একগাদা রিংগিত (মালয়েশিয়ার মুদ্রা) খরচ করে খেয়েছিলাম, ওদের খাবার আমাদের স্বাদমত নয়!
লাংকাওয়ির দুটো বৈশিষ্ট্য আমার চোখে পড়লো। প্রথমত, এখানে ডিউটি ফ্রি কেনাকাটার সুবিধা রয়েছে, বিশেষ করে অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়। আমার ধারণা, এটাই সবচেয়ে বেশি পর্যটকদের টানে।
দ্বিতীয়ত, এ শহরের লোকজন, বিশেষ করে ট্যাক্সিক্যাব চালকরা মনে করে লাংকাওয়িতে আসা মানে কিছু একটা করতেই হবে। আপনি শুধু সাগর দেখে বেড়াবেন, যেন এটাতে তাদের প্রাণ জুড়ায় না!
তারা আপনাকে পরামর্শ দিবে এখানকার প্রবাল দ্বীপ পুলাও পায়ার বা অন্যান্য দ্বীপে যেতে, তাহলে আপনি স্কুবা-ডাইভিং, প্যারা সেইলিংসহ অনেক কিছু করতে পারবেন।
কিন্তু পুলাও পায়ার যেতে হলে একদিন আগেই বুকিং দিয়ে রাখতে হয় যা আমাদের জানা ছিল না। ফলে পুলাও পায়ার যাওয়া হলো না আমাদের।
আমরা পরদিন ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা সেরে বের হলাম ঈগল স্কয়ার আর ল্যাজেন্ডা পার্কের উদ্দেশ্যে।
আমার হোটেল থেকেই হেঁটে যাওয়ার পথ। জেটি বা ফেরিঘাটের পাশেই ঈগল স্কয়ার আর তার পাশেই ল্যাজেন্ডা পার্ক। এখানেও ছোট একটি সৈকত রয়েছে। পার্কে বসেই সমুদ্র দেখা যায়। বেশ সুন্দর দুটো জায়গাই।
পার্কে হাঁটতে হাঁটতে দেখি কাছেই একটা বোটে করে পর্যটকদের বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। চার ঘণ্টার একটা প্যাকেজ কিনলাম।
ঠিক দুপুর আড়াইটায় আমাদের বোট যাত্রা শুরু করলো। এই প্রথম আমি সাগরের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। স্রোতের বিপরীতে হওয়ায় বড় বড় একেকটা ঢেউ এসে বোটের ওপর আছড়ে পড়ছে। মনে হলো খুব তাড়াতাড়িই বোধহয় তিনটা দ্বীপ দেখে ফেললাম।
শেষের দ্বীপটিতে রয়েছে 'জিওফরেস্ট পার্ক'। দ্বীপে নেমে বেশ উঁচু একটি পাহাড়ে উঠে আবার কিছুটা নিচে নামলেই একটি মিঠা পানির সুগভীর পুকুর। এটি অনেকটা বান্দরবানের বগা লেকের মতই। কিন্তু বগা লেকে কোনো সিঁড়ি নেই, ওঠাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে বেশ নিরাপদ। খুব সুন্দর করে সিঁড়ি তৈরি করে দেয়া আছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বেশ কিছু বানরেরও দেখা মিললো।
চার ঘণ্টা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। সারাদিন বেশ দৌড়ঝাপ দিয়ে বেশ ক্লান্ত আমরা। কোনোমতে রাতের খাবারটা সেরেই ঘুম। সকালে ফ্লাইট ধরার তাড়া ছিল। আমাদের পরের গন্তব্য কুয়ালালামপুর। পরের চিঠিতে কুয়ালালামপুর নিয়ে লিখবো, সে পর্যন্ত ভালো থাকুন সবাই।
লেখক: সাংবাদিক
ই মেইল: rokeya.lita@hotmail.com
ছবি কৃতজ্ঞতা: জাকারিয়া রেহমান ও রোকেয়া লিটা
রোকেয়া লিটার আরও লেখা