সিঙ্গাপুরের চিঠি: শেষ হলো মালয়েশিয়া ভ্রমণ, দেখা হবে বইমেলায়

আকাশপথে লাংকাওয়ি থেকে কুয়ালালামপুর যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর পৌঁছালাম।

রোকেয়া লিটা, সিংগাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2017, 12:51 PM
Updated : 26 Jan 2017, 12:51 PM

বিমানবন্দরে নামার সময় আকাশ থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে শুধু সবুজ পাম ক্ষেত। হাসতে হাসতে আমার বর ধ্রুবকে বলছিলাম, বাংলাদেশ ধানের দেশ আর মালয়েশিয়া পামের দেশ।

বিমানবন্দর থেকে আমরা সোজা রওয়ানা দিলাম গোমবাক শহরের দিকে। সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া চাইলো ১০৫ রিংগিত। শুরুতেই কুয়ালালামপুরের যাতায়াত ব্যবস্থার খারাপ দিকটাই আমাদের চোখে পড়লো।

বিমানবন্দর থেকে গোমবাক যাওয়ার জন্য সরাসরি কোনো ট্রেন বা বাস নেই। ট্যাক্সি ক্যাবই ভরসা। সিঙ্গাপুর ছোট দেশ হলেও যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ উন্নত। বিমানবন্দরেই ট্রেনের একটি স্টেশন রয়েছে। ফলে চাংগি বিমানবন্দরে নেমেই বাস অথবা ট্রেনে করে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়।

কোনো উপায় না দেখে আমরা ট্যাক্সি ক্যাবে করেই গোমবাকের দিকে রওয়ানা হলাম এবং যথারীতি ১০৫ রিংগিত ট্যাক্সির ভাড়া দিলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম, 'গ্র্যাব' নামের একটি অ্যাপ ব্যবহার করে ট্যাক্সি ডাকলে নাকি ভাড়া অর্ধেকে নেমে যেত।

সেটাও ঝামেলার কাজ। একটি মালয়েশিয়ান ফোন কোম্পানির সিম কার্ড কিনতে হবে, নিবন্ধন করতে হবে, তারপর ওই অ্যাপ ব্যবহার করে ট্যাক্সি ডাকতে হবে।

গোমবাক পৌঁছাতে আমাদের ঘণ্টা খানেক সময় লেগে গেল। খুব চমৎকার পাহাড়ঘেরা একটি শহর। পাহাড়ের খোপে খোপে বহু লাল রঙের দোচালা ছাদের বাড়ি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছিল, ভবনগুলো সিঁড়ির মত করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে গেছে।

চারপাশের সবুজ গাছপালা আর পাহাড়ের মাঝে এই লাল রঙের ছাদওয়ালা বাড়িগুলো খুবই চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

সারাদিন আরাম-আয়েশ করে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন খুব সকালে উঠে আমরা কেএল সিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে বের হলাম। বাস কাউন্টারে বসে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হলো প্রায় ৪৫ মিনিট। অবস্থা বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ। এজন্যই হয়তো এখানে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির উপরে বেশি নির্ভরশীল।

রাস্তায় বের হলেই দেখি সারি সারি প্রাইভেট কার, বাসের সংখ্যা খুবই কম। বাসে করে আমরা 'তামান মেলাতি' নামের একটি স্টপেজে এসে দাঁড়ালাম। এখানে একটি মেট্রোরেলের স্টপেজ আছে। আমরা মেট্রোরেলে করে কেএল সিটি সেন্টারে যাবো। স্টেশনে মিনিট পাঁচেক দাঁড়াতেই ট্রেন পেয়ে গেলাম আমরা। বাসের জন্য লম্বা সময় দাঁড়িযে থাকার কষ্টটা ভুলে গেলাম।

কেএল সিটি সেন্টারে যাওয়ার কারণ একটাই- মালয়েশিয়ার বিখ্যাত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখা। এইসব উঁচু উঁচু দালানকোঠার ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তবে, পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখাটা অনেকটা ভাতের সাথে তরকারি খাওয়ার মতই।

কুয়ালালামপুরে গেলাম আর 'পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার' দেখলাম না, তা যেন হতেই পারে না। 'পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার'-এর পাশেই রয়েছে একটি পার্ক, সেখানে বসেও খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। পার্কে বসেই আমি মানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ আর ব্যবহার খেয়াল করছিলাম।

মালয়েশিয়াও একটি জাতি বৈচিত্র্যের দেশ। শুনেছি, মালয়রা এখানকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলোতে অগ্রাধিকার পায়। তবে, এখানে চায়নিজ বা ভারতীয়দের উপস্থিতিও বেশ চোখে পড়ার মত। এমনকি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ কয়জন বাংলাদেশিরও দেখা পেয়ে গেলাম।

গতবার পেনাং-এ এসে দেখেছি, এবার লাংকাওয়িতে এসেও দেখলাম, অফিস-দোকান-বাস কাউন্টার সবখানেই কাজ করছে মালয়েশিয়ান নারীরা। পেনাং-এর একটি বাস কাউন্টারে দেখেছিলাম সদ্য মা হওয়া এক নারী তার সন্তান নিয়ে এসে দিব্যি কাজ করছে বাস কাউন্টারে।

কুয়ালালামপুরেও দেখছি তেমন, নারী কর্মীবাহিনীর প্রাচুর্য বেশ চোখে পড়ার মত। মেয়েরা ট্যাক্সি চালাচ্ছে, বাসও চালাচ্ছে! বাংলাদেশে মেয়েরা শার্ট-প্য্যান্ট পড়ে বেড়ালেই উত্ত্যক্তকারিরা মেয়েদের নোংরা কথা বলে।

কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ মালয়েশিয়াতে দেখলাম, মেয়েদের পোশাকই হল শার্ট আর প্যান্ট। শার্ট-প্যান্টের সাথে কেউ কেউ মাথায় একটি স্কার্ফ পড়ে নেয়, কেউ পড়ে না। তেমনি আবার চায়নিজ মেয়েরা অনায়াসে হাঁটুর ওপরে তোলা ছোট প্যান্ট-টি শার্ট আর ভারতীয় মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরেও বেড়াচ্ছে। পোশাক যে কখনোই নারীর যৌন হয়রানির কারণ হতে পারে না, সেটি আরও একবার পরিস্কারভাবে চোখে পড়লো।

এখনও 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্' ও 'বাতু কেভস' দেখা বাকি। পরদিন খুব সকালে আমরা 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্' এর উদ্দেশ্যে বের হলাম। গোমবাক বাস স্টপেজ থেকে 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস' এর টিকেট কিনলাম। 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস'-এ সড়ক পথেই চলে যাওয়া যায়।

তবে, অর্ধেক পথ বাসে এবং বাকিটা পথ কেবল কার-এ যাওয়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা কেবল কার-এ যাওয়ার অপশনটাই বেছে নিলাম। টিকিট কাটার পর, প্রায় দেড়ঘণ্টা অপেক্ষার পর আমরা যাত্রা শুরু করলাম। কিছুটা পথ সমতলে যাওয়ার পরপরই আমাদের বাস পাহাড়ের দিকে উঠতে লাগলো। কান বন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝতে পারলাম, আমরা বেশ উঁচুতে উঠতে যাচ্ছি।

একটা সময় পর, আমাদের বাসটা মেঘের ভেতর দিয়ে যাওয়া শুরু করলো। রাস্তাটা বেশ প্যাঁচানো। কখনও কখনও ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরেও বাস চলছিল। মেঘের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে, বান্দরবানের নীলগিরিতে যাওয়ার মতই একটা অনুভূতি হলো। তবে নীলগিরির রাস্তা বেশ ঝূঁকিপূর্ণ। সেদিক থেকে 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্'-এ যাওয়ার রাস্তা বেশ প্রশস্ত এবং নিরাপদ। যাওয়া এবং আসার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দুটি রাস্তা। রাস্তাগুলো অনেকটা ফ্লাইওভারের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে।

বাস এসে থামলো কেবল কার স্টেশনে। এখান থেকে কেবল কার-এ করে আমরা 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্'-এ যাত্রা শুরু করলাম। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্'-এ পৌঁছালাম। ১৮০০ মিটার উঁচু একটি পর্বতের উপরে ক্যাসিনো, থিম পার্ক, শপিং কমপ্লেক্স, রেস্তোঁরা, বেশ কয়েকটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ করা হয়েছে।

এটাকে একটা 'মিনি লাস ভেগাস' বললে ভুল হবে না। 'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্' ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর আমার মনে একটাই প্রশ্ন বারবার উঁকি দিচ্ছিলো, “এই যে এতো বিশাল একেকটি স্থাপনা ! এমন উঁচু পর্বতের  উপরে এতো ইট-বালি, সিমেন্ট-রড আনা সম্ভব হয়েছে কিভাবে!”

'গেন্টিং হাইল্যান্ডস্' ঘুরে আমি বেশ ক্লান্ত। 'বাতু কেভস্‌' যাওয়ার আর ইচ্ছে নেই। কেবল ধ্রবর কারণেই বাতু কেভস্-এর দিকে রওয়ানা দিলাম। গোমবাক থেকে বেশ কাছেই বাতু কেভস্। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম।

কিন্তু কী অদ্ভুত, বাতু কেভস্‌-এ পৌঁছেই আমার ক্লান্তি চলে গেল। চুনাপাথরের এই পাহাড়ের গুহায় হিন্দুদের উপাসনালয়। নান্দনিকতায় ভরা এই উপাসনালয়। ২৭২টি ধাপের একটি উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় এই গুহায়। কষ্ট করে হলেও ২৭২ টি ধাপ পেরিয়ে গুহার ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। পুরোটা পথ আমাদের আনন্দ দিলো অনেকগুলো বানর। বানরগুলো লাফাচ্ছিল, আমাদের সাথে ছবি তুলছিল আর বেশ মজা করছিল।

তবে সাবধান, ওদেরকে বিরক্ত করলে ওরাও আপনাকে বিরক্ত করবে, হাতে থাকা ব্যাগ নিয়েও দৌড় দিতে পারে। অনেকেই এই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চায় না। তবে, একবার কষ্ট করে উঠে গেলে আর সমস্যা হয় না। কারণ, নামতে কোনও কষ্ট হয় না। গুহার ভেতরে প্রবেশ না করলে বাতু কেভস্-এর আসল সৌন্দর্য্যটাই অদেখা থেকে যায়। গুহার ভেতর থেকে মাথা উঁচু করে উপরে তাকালে আকাশ দেখা যায়। আর আকাশ দেখলেই মনটা এক বিশালতায় ভরে যায়।

মালয়েশিয়ার পাঁচটা দিন খুব তাড়াতাড়ি কেটে গেল। সচরাচর ভ্রমণ শেষ হয়ে গেলে মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়। তবে সিঙ্গাপুরে পৌঁছেই এক অন্য রকম ভালো লাগায় মনটা ভরে উঠলো। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য জুরং পয়েন্টের একটি রেস্তোঁরায় বসেছিলাম আমি আর ধ্রুব। হঠাৎ একজন বাংলাদেশি নারী এসে বললেন আমি রোকেয়া লিটা কি না!  ধ্রুবকেও চিনতে পারলেন তিনি।

বুঝলাম, আমার চিঠিগুলো আপনারা নিয়মিত পড়েছেন। তবে, এবার যাচ্ছি ঢাকায়। একুশে বই মেলায় 'শব্দশৈলী' প্রকাশনী থেকে বের হচ্ছে আমার তৃতীয় উপন্যাস “পুরুষ”। দেখা হবে নিশ্চয়ই, ভাল থাকুন সবাই।

রোকেয়া লিটা

সাংবাদিক

rokeya.lita@hotmail.com

ছবি তুলেছেন জাকারিয়া রেহমান

লেখক: সাংবাদিক

রোকেয়া লিটার আরও লেখা