সিঙ্গাপুরের চিঠি: স্মার্টকার্ডে বৈষম্য চাই !

বাংলাদেশ থেকে প্রথম যখন সিঙ্গাপুরে আসি, তখন আমার ভিসার মেয়াদ ছিলো মাত্র এক মাস। এখানে আসার পর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে সিঙ্গাপুরের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড চেক পয়েন্টস অথরিটিতে জমা দেয়ার পর আমি এখানে দীর্ঘদিন বসবাসের অনুমতি পেলাম।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2016, 01:45 PM
Updated : 10 Nov 2016, 01:45 PM

সে সময় আমাকে একটি পরিচয়পত্র বা আইসি দেয়া হয়েছিল। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের বর্তমান স্মার্ট কার্ডের মত।

প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি এই কার্ড কী কাজে লাগবে। কারণ আমার সাথে তো পাসপোর্ট আছেই। বেশ কিছুদিন পরে বুঝলাম চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থানসহ প্রায় সব ধরনের সেবা নিতে গেলেই এই পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হয়।

এই কার্ডে একটি নম্বর দেয়া থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এই নম্বরটিও জানতে চাওয়া হয়। আমাদের বাসা ভাড়া নেয়ার সময় বাসার কন্ট্রাক্ট পেপারে আমার বরের এবং বাড়িওয়ালার আইসি নম্বর দিতে হয়েছিল। প্রথম যেদিন হাসপাতালে গেলাম, সেদিনও হাসপাতালের কর্মীরা আমার পরিচয়পত্র দেখতে চেয়েছিল।

শুরুতে আমি ভেবেছিলাম, যারা সিঙ্গাপুরের নাগরিক নয়, শুধু তাদেরকেই হয়তো এই পরিচয়পত্রটি সাথে নিয়ে ঘুরতে হয়। কিন্তু আমার ধারণাটি ভুল ছিল।

এই তো সেদিনই আমাদের পাশের বাড়ির দাদুকে নিয়ে একটি সরকারি হাসপাতালে গেলাম। তিনি ওই হাসপাতালের পুরনো রোগী। তারপরও হাসপাতালে যাওয়ার পর একটি নির্দিষ্ট স্থানে তার পরিচয়পত্রটি পাঞ্চ করতে হল। তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক। বুঝলাম বিদেশি, স্থায়ী বাসিন্দা (পিআর) বা নাগরিক যারা বেশি সময় এখানে বাস করবেন, সবাইকেই জরুরি সেবাগুলো নেওয়ার সময় এই পরিচয়পত্র বহন করতে হয়। এমনকি ওষুধ কেনার সময়ও পরিচয়পত্রটি দোকানে দেখাতে হয়, জানাতে হয় কার জন্য কেনা হচ্ছে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই আমার একটু কৌতুহল হল। এসব জরুরি সেবা নেয়ার জন্য দেশি-বিদেশি সবার কাছ থেকে এই পরিচয়পত্র দেখতে চায় কেন এখানে ? কেন সবখানে এত তথ্য দরকার হচ্ছে ?

আমি ঠিক নিশ্চিত নই, ঠিক কী কারণে সব জায়গায় এই পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। তবে পরিচয়পত্রটি দেখালে একজন মানুষ সিঙ্গাপুরে কী ধরনের অনুমতি নিয়ে বাস করছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

সিঙ্গাপুরে বিভিন্ন মেয়াদে এবং বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে বিদেশিরা বসবাস করে। যারা এদেশের নাগরিক, তাদের পরিচয়পত্র দেখলেই বোঝা যায়। এছাড়া অনেক বিদেশিই এদেশে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি, ওর্য়াক পারমিট, স্টুডেন্ট পাস, লং টার্ম ভিজিট পাস নিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে বসবাস করছেন। আর বসবাসের যোগ্যতার উপরে নির্ভর করে বিভিন্ন ধরনের সেবার দাম।

যেমন ধরুন, সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের সন্তানরা স্কুলে পড়তে গেলে প্রাথমিক পর্যন্ত কোনো বেতন দিতে হয় না। আর যেসব বিদেশিদের সন্তানরা সিঙ্গাপুরের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট, প্রাথমিক পর্যন্ত তাদের স্কুলের মাসিক বেতন ৯০ সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার। আবার যেসব বিদেশিদের সন্তান সিঙ্গাপুরের পারমানেন্ট রেসিডেন্ট নয়, প্রাথমিক পর্যন্ত তাদের স্কুলের মাসিক বেতন সাড়ে তিনশ থেকে পাঁচশ সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

সিঙ্গাপুরে পারমানেন্ট রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস নিয়ে বসবাস করছেন এমন অনেক বাবা-মায়ের সন্তানেরই পারমানেন্ট রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস নেই। ফলে সন্তানের লেখাপড়ার জন্য তাদের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

কয়েকদিন আগে কথা হচ্ছিলো এক বাংলাদেশি নারীর সাথে। তার চার সন্তানের মধ্যে তিনজনেরই পারমানেন্ট রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস আছে, শুধু একটি সন্তানের পারমান্যান্ট রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস নেই। ফলে তিন সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি আর একটি সন্তানের লেখাপড়ার জন্য পুরোপুরি বিদেশিদের মত খরচ করতে গিয়ে তিনি রীতিমত হিমশিম খাচ্ছেন।

তিনি জানালেন, এসব ক্ষেত্রে অনেক পরিবারই পার্শ্ববর্তী দেশ মালয়েশিয়ায় সন্তানকে বোর্ডিং-এ রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তিনি তার পারমানেন্ট রেসিডেন্সি স্ট্যাটাস না পাওয়া সন্তানটির জন্য কী করবেন- এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।

চিকিৎসার ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। পাশের বাসার দাদুকে নিয়ে যে সরকারি হাসপাতালটিতে গিয়েছিলাম, সেটির নাম ‘এনজি টেং ফং জেনারেল হাসপাতাল’। এর আগে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়েছি, সেগুলো বেশ ব্যয়বহুল। ভাবলাম, এনজি টেং ফং তো সরকারি হাসপাতাল। দেখি এখানে চিকিৎসার কেমন ব্যয়।

হাসপাতালটির ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখলাম, এখানেও বিদেশিদের জন্য চিকিৎসা ব্যয় কয়েকগুণ বেশি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের বিট-টু ক্লাস ওয়ার্ডের জন্য একজন সিঙ্গাপোরিয় নাগরিককে গুণতে হবে মাত্র ২৫৭ সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার। আর পারমানেন্ট রেসিডেন্টদের ৪৫৭ সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার এবং বিদেশিদের ৮৫৭ সিঙ্গাপোরিয়ান ডলার খরচ করতে হবে।

প্রথম প্রথম মনে হত, এমন ব্যয়বহুল দেশে মানুষজন আছে কীভাবে ! ধীরে ধীরে বুঝলাম, এ দেশটি ব্যয়বহুল কেবল বিদেশিদের জন্য। এদেশের নাগরিকদের জন্য এটি একটি স্বর্গরাজ্য। একই সেবা নিচ্ছি, অথচ বিদেশি হওয়ায় আমাকে এখানকার নাগরিকদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটি একটি বৈষম্য। কিন্তু আবার ভেবে দেখুন, আমার শিক্ষা-স্বাস্থ্যের দেখ-ভাল করা বা সহজলভ্য করে দেওয়া কিন্তু এদেশের সরকারের দায়িত্ব নয়। কাজেই এদেশের একজন নাগরিকের মত সুবিধা আমি আশা করতে পারি না।

এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশেও সম্প্রতি শুরু হয়েছে স্মার্ট কার্ড বিতরণ। শুনতে পাচ্ছি, ২২ ধরনের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এই স্মার্টকার্ড কাজে লাগবে।

এখন সময় এসেছে শিক্ষা, চিকিৎসার মত মৌলিক সেবাগুলো নেয়ার ক্ষেত্রেও এই স্মার্টকার্ডের ব্যবহার বাড়ানো। তবে শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যই এই কার্ড দিলে চলবে না। বাংলাদেশে যেসব বিদেশিরা বাস করছেন, তাদের বসবাসের ধরন ও কারণের ওপর নির্ভর করে তাদেরকেও স্মার্ট কার্ডের আওতায় আনা হোক।

দেশি-বিদেশি সবাই স্মার্টকার্ড ব্যবহার করে মৌলিক সেবাগুলো নিতে গেলে সেবাদাতারা সহজেই বুঝতে পারবেন, সেবাগ্রহিতা দেশি নাকি বিদেশি। আর বিদেশি হলে তাদের কাছে থেকে সিঙ্গাপুরের মতই কয়েকগুণ দাম আদায় করা হোক। এই বাড়তি টাকা দিয়ে দেশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা উন্নত করা হোক। কেননা, সরকারের দায়িত্ব আগে দেশের জনগণের জন্য মৌলিক সেবাগুলো সহজলভ্য করা।

জানা যায়, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন রপ্তানীমুখী শিল্প এবং অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা চার লাখের মতো। এরাও নিশ্চয়ই পরিবার নিয়ে বাস করছে বাংলাদেশে এবং নানারকম মৌলিক সেবা নিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে।

বিদেশিদের সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরকে অনুসরণ করতে পারে। বাড়তি অর্থ আদায় করে তা দিয়ে দেশের জনগণের জন্য সেবার মান উন্নত করতে পারে। তেমনি অবৈধভাবে ঢুকে পড়া বিদেশিদেরও মৌলিক সেবাগুলোর বাইরে রাখা হোক স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে। কারণ আগে দেশ ও দেশের মানুষ, তারপরেই না বিদেশি।

লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক,

ইমেইল: rokeya.lita@hotmail.com