কাঁধে যে ব্যাগ, সেটা পরনের পোশাকটির কাপড়েই তৈরি । দেখে মনে হতো, সারাদিন পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘরে ফিরছে সেনা সদস্যরা। শুধু পোশাকটাই বুঝিয়ে দেয়, তারা সামরিক বাহিনীতে আছে। বাকি সবকিছুই মায়া ভরা। এই তরুণদের দেখেই বোঝা যায়, বয়স খুব বেশি নয়। কারো কারো চোখে চশমা। আবার কারো কারো চাহনিতে ভীষণ কোমলতা।
বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সামরিক পোশাক পড়ে সাধারণ মানুষের সাথে এভাবে গণপরিবহনে চলাফেরা করতে দেখা যায় না। ফলে, সিঙ্গাপুরে আসার পর শুরুর দিকে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম এদের দেখে। পরে অবশ্য জানতে পারলাম, এরা ন্যাশনাল সার্ভিসের সদস্য।
সিঙ্গাপুরের সকল পুরুষ নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের (পিআর) দ্বিতীয় প্রজন্মের পুরুষদের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস বাধ্যতামূলক। শারিরীক এবং মেডিকেল ফিটনেসের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক পুরুষ নাগরিক ও দ্বিতীয় প্রজন্মের স্থায়ী পুরুষ বাসিন্দাদের দু'বছর পূর্ণকালীন সেবা দিতে হয় ন্যাশনাল সার্ভিসে।
ন্যাশনাল সার্ভিসের আংশ হিসেবে তারা সিঙ্গাপুর আর্মড ফোর্সেস, সিঙ্গাপুর পুলিশ ফোর্স অথবা সিঙ্গাপুর সিভিল ডিফেন্স ফোর্সে সেবা দিয়ে থাকে।
১৯৬৫ সালে যখন দেশটি স্বাধীন হয়, তখনই সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর তাই তো স্বাধীনতার পরপরই, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে এই ন্যাশনাল সার্ভিস এর সূচনা হয় দেশটিতে।
ভেবে দেখলাম, প্রায় ৪৯ বছর আগে এই ন্যাশনাল সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার মানে আমার আশেপাশে যেসব পুরুষ সিঙ্গাপোরিয়ান বা স্থায়ী বাসিন্দা দেখছি, তারা সবাই এক সময় ন্যাশনাল সার্ভিসের সদস্য ছিলো। অর্থাৎ আলাদা করে সিঙ্গাপুরের সামরিক বাহিনী খোঁজার দরকার নেই। সিঙ্গাপুর দেশটিই তো সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেশ। দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনে যে কোনো সময় শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।
সিঙ্গাপুরে ন্যাশনাল সার্ভিসে অংশগ্রহণ না করাটা এক ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর এ কারণেই বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে ন্যাশনাল সার্ভিসের পক্ষে ও বিপক্ষে বিভিন্ন ধরনের মতামত দেখতে পাওয়া যায়।
তবে অনেকেই মনে করেন সিঙ্গাপুরে যে এতো বেশি শৃঙ্খলা এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছে এই ন্যাশনাল সার্ভিসের কল্যাণে।
ছেলেদের যে সময়টায় সবচেয়ে বেশি বখে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেই সময়টাতেই যদি ন্যাশনাল সার্ভিসের মত কোনো নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকে, তবে তা সমাজের জন্যই মঙ্গল।
শুক্রবার বাংলাদেশের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে অনেক ত্যাগ করতে হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে যোদ্ধারা প্রস্তুত ছিল না। প্রশিক্ষণের জন্য তাদের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল।
আবার ভেবে দেখুন, সিঙ্গাপুরের মত বাংলাদেশও কিন্তু খুব ছোট্ট একটি দেশ, ভারতের তুলনায় অতিশয় ক্ষুদ্র। বাংলাদেশে ছেলেরা আসলে কতটা প্রস্তুত দেশ রক্ষার জন্য? হঠাৎ যদি যুদ্ধে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তখন কী ছেলেদের প্রশিক্ষণ দেয়ার সময় থাকবে?
হ্যা, আমাদের একটি প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনী আছে বটে, কিন্তু তারা তো সংখ্যায় কম, সাধারণ মানুষকে প্রয়োজন হবেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি, কিন্তু দেশের জন্য যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ আছে কয়জনের?
তাই দেরি না করে, বাংলাদেশ সরকারও ন্যাশনাল সার্ভিসের মত কিছু ভাবতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল: rokeya.lita@hotmail.com
রোকেয়া লিটার আরও লেখা
প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ, আড্ডা, আনন্দ বেদনার গল্প, ছোট ছোট অনুভূতি, দেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন! |