সিঙ্গাপুরে বাস যাত্রীদের কিউ

সিঙ্গাপুরের কিছু কিছু শপিং মলে গেলে দেখা যায়, বাস যাত্রীদের কিউ’র জন্য অনেক বড় একটি অংশ ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তেমনই একটি শপিং মল জুরং পয়েন্ট। জুরং পয়েন্টের একদিকে রয়েছে মেট্রোরেলের স্টেশন আর অন্যদিকের বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন বাসের জন্য কিউ।

রোকেয়া লিটা, সিঙ্গাপুর থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Sept 2016, 03:27 PM
Updated : 7 Sept 2016, 03:46 PM

প্রায় ২০-২৫ টি রুটের বাস যাত্রী নেয় এসব স্টপেজ থেকে। বাসের অপেক্ষায় বিশাল একেকটা কিউতে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। প্রতিটি কিউতে থাকে ৪০-৫০ জন বা তারও বেশি মানুষ। এমন অনেকবারই হয়েছে, শপিং করে এসে বাসের লাইনে দাঁড়িয়েছি প্রায় পঞ্চাশ জনের পেছনে। শুরুর দিকে মনে হতো, প্রথম বাসটায় বোধ হয় আমার জায়গা হবে না। হয়তো কিউতেই অপেক্ষা করতে হবে দ্বিতীয় বাসের জন্য। কিন্তু প্রতিবারই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারন সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ বাসই দোতলা। ফলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সব যাত্রীকেই বহন করতে সক্ষম এসব বাস।

জুরং পয়েন্ট শপিং মলে বাসের জন্য কিউতে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের দেখে আমার মনে পড়ে কাজিপাড়া-শেওড়াপাড়ায় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের বিশাল বিশাল লাইনের কথা। শুধু কাজিপাড়া শেওড়াপাড়া নয়, ঢাকা শহরের বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় এ ধরণের লাইন দেখা যায়। কি যে অসহায় এই যাত্রীরা সেটি কর্তৃপক্ষ যদি জানতেন!

লোকাল বাসগুলোতে উঠার জন্য কোনো লাইনের দরকার হয় না। বাস থামার আগেই লোকজন হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠে পড়ে। যারা হুড়োহুড়ি করে বাসে উঠতে পারেন না, তাদের লাইনে গিয়ে পঞ্চাশজনের পেছনে দাঁড়াতে হয়। এরপর গেটলক বাসগুলো এসে একেকটি স্টপেজ থেকে কিছু যাত্রী নিয়ে চলে যায়। ফলে আপনি পঞ্চাশজনের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন আপনার অবস্থান তারও পেছনে।

একটা বাস এসে যাত্রী নিয়ে গেলো, কিন্তু লাইনে আপনার অবস্থানের খুব একটা উন্নতি হলো না। এই হচ্ছে ঢাকা শহরের গণপরিবহনের চিত্র। অর্থাৎ রাশ-আওয়ারে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আরও কয়েক ঘন্টা। যানজট ঠেলে অফিসে যেতে লাগবে আরও সময়। অফিস থেকে ফেরার সময় একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। আমাদের এই ব্যস্ত জীবনে প্রতিদিন যাতায়াতের পেছনে সময় ব্যয় করা কি অসহনীয় এক অপচয়!

এই বাস্তবতায় একতলা বাসগুলো আদৌ কি ঢাকা শহরের মতো একটি জনবসতিপূর্ণ শহরের জন্য উপযোগী? আমি বলবো, একতলা বাসগুলো আসলে ঢাকা শহরের বোঝা। এই বাসগুলো আমাদের গণপরিবহনের বিলাসিতা। এরই মধ্যে বেশকিছু নতুন বাস সার্ভিস চালু হয়েছে ঢাকায়। কিন্তু তার সবগুলোই একতলা। কেবল বিআরটিসির কিছু দোতলা বাসই দেখা যায় ঢাকায়। এছাড়া বেসরকারি সবগুলো গণপরিবহনই একতলা। লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ৭০-৮০ জন মানুষ, আর একটা বাস এসে যাত্রী নেবে মাত্র চার জন, এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কি হতে পারে!

কর্তৃপক্ষ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করার চেষ্টা করছে। রাস্তায় রাস্তায় এখন উড়াল সেতু। কিন্তু একজন চাকুরিজীবীর যানবাহনের জন্য প্রতিদিনের যুদ্ধটা কমেনি একটুও। ঠিকই তাকে প্রতিদিন বাসের জন্য  দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে, আর বাস কন্ডাকটরের দয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে যদি সে চারজনের জায়গায় একজন যাত্রী বেশি নেয়! গণপরিবহন সংকটের কারনে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন মানুষকে তৃপ্ত করতে পারছে না একটুও। বরং দিনে দিনে অভদ্র করে তুলছে দেশের মানুষকে।

আমি সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, লন্ডনের গণপরিবহনে চলাফেরা করেছি। মজার বিষয় হলো এসব বাসে নারীদের জন্য কোনো সংরক্ষিত আসন নেই। কেবল গর্ভবতী, শিশু সন্তানের মা, বৃদ্ধ এবং শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জড ব্যক্তিদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা থাকে। সচরাচর এই ক্যাটাগরির বাইরে কেউ এসব আসনে বসেও না। ফাঁকা থাকে, তারপরও মানুষ সেসব আসনে বসে না। প্রযোজনে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মানে এই নয় এসব দেশের মানুষ আমাদের চেয়ে সভ্য আর ভদ্র! বাংলাদেশে আসলে তারাও সংরক্ষিত আসনে বসার জন্য মেয়েদের সাথে ঝগড়া শুরু করবে। কারন, বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থাটাই মানুষকে অধৈর্য্য আর অভদ্র করে তুলেছে। বাসে বসার জায়গা তো দূরের কথা, দাঁড়ানোরই জায়গা থাকে না। মানুষ বাদুরের মত ঝুলে ঝুলে বাসে যাওয়া-আসা করছে। এই বাস্তবতায় ভদ্রতা বা সভ্যতা দেখানোর সুযোগ কই!

বাংলাদেশে যারা নিয়মিত বাসে চলাচল করেন, তারা নিশ্চয়ই বাস ভাড়া নিয়ে যাত্রী আর কন্ডাকটরের মধ্যে ঝগড়া প্রায়ই দেখেন। এখনও আমাদের গণবপরিবহনে ক্যাশ-কার্ড পুরোপুরি চালু হয়নি। কেবল বিআরটিসির বাসগুলোতেই ক্যাশ-কার্ড দেখা যায়, তাও আবার সবাই সেটি ব্যবহার করেন না। বিআরটিসি বাসে উঠলে দেখা যায় কেউ ক্যাশ-কার্ডে ভাড়া দিচ্ছে, কেউ আবার খুচরা টাকা দিয়ে ভাড়া মেটাচ্ছে। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা আর দশটা বাসে যদি ক্যাশ-কার্ডে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা না থাকে,তাহলে কেন মানুষ শুধু একটি বাসের জন্য ক্যাশ-কার্ড পকেটে নিয়ে ঘুরবে! ঢাকা শহরের ব্যস্ত বাস কাউন্টারগুলোতে দেখা যায় ছাতার নিচে বসে পরিবহন কর্তৃপক্ষের একজন টিকিট বিক্রি করছে, একই রুটে আবার কয়েকটি কোম্পানি বাস পরিচালনা করছে। আপনি হয়তো ‘ক’ পরিবহনের একটি টিকেট কিনে অপেক্ষা করছেন, এমতাবস্থায় ‘খ’ পরিবহনের একটি বাস আসলো। কিন্তু আপনি ওই বাসে উঠতে পারছেন না। কারন, ওই যে আপনি আগেই ‘ক’ পরিবহনের টিকেট কিনে বসে আছেন, ‘খ’ পরিবহন তো ওই টিকেটে আপনাকে তার বাসে নিবে না।

ঢাকা শহরের পরিবহনে আরও একটি মজার দৃশ্য দেখা যায়। বিভিন্ন পয়েন্টে বাস কর্তৃপক্ষ লোকজন দাঁড় করিয়ে রাখে। এইসব পয়েন্টে বাস এসে থামলে কোম্পানির ওই লোকগুলো বাসে উঠে যাত্রী গণনা করে, কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করে যে এতোজন যাত্রী বাসে ছিলো। এটা নিশ্চিতভাবেই পরিবহন মালিক এবং চালক বা কন্ডাকটরের মধ্যকার অবিশ্বস্ত সম্পর্ককেই প্রমাণ করে। কিন্তু তাতে সমস্যা তো হচ্ছে যাত্রীদের। বিভিন্ন জায়গায় বাস থামার কারনে তাদের সময় অপচয় হচ্ছে। যদি ঢাকা শহরের সব পরিবহনেই ক্যাশ-কার্ডে ভাড়া মেটানোর ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে নিশ্চয়ই যাত্রীদের এমন বিড়ম্বনার শিকার হতে হতো না।

জুরং পয়েন্ট শপিং মলে বাসের জন্য কিউতে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের দেখে আমার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে।