সেখান থেকে কাজ শেষ করে বাসায় ফেরার পথে দারুণ কিছু সময় কাটে মেট্রোরেল স্টেশনে। ব্যস্ত শহরে রেল স্টেশনে খুব অল্প সময়ই কাটায় মানুষজন। আর এই ফাঁকে শিল্পের একটু সৌন্দর্য যদি মানুষের মনকে ছুঁয়ে দেয়, তাহলে কি আনন্দই না লাগে!
প্রথমেই ট্রেনের ভাড়া মেটানোর জন্য স্টেশনের ইলেট্রনিক ফেয়ার কালেকশন সিস্টেমে ক্যাশ কার্ড পাঞ্চ করে ভেতরে ঢোকলাম। কিছুটা পথ হাঁটার পর নিচতলায় নেমে ট্রেনের কাছে যেতে হবে।
হেঁটে কিছুটা পথ এগোতেই দেখতে পেলাম সামনের দেয়ালে বড় একটা অংশ জুড়ে বিশাল আকারের অনেকগুলো পোস্টার। পোস্টারগুলোর কাছে আসতেই অবাক হলাম, এগুলো তো একেকটি আলোকচিত্র!
আরও কিছুটা পথ হাঁটার পর একটা ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই ধাঁধায় পড়ে গেলাম। ছবির মানুষগুলোকে বেশ পরিচিত লাগছে। জীর্ণশীর্ণ লুঙ্গি পরা কিছু মানুষের ছবি, ভাঙা নৌকা আর শুটকির আড়তের ছবি।
আরে, এগুলো তো আমাদের কক্সবাজারের ছবি! পাশেই শিল্পীর পরিচয় ও শিল্পকর্মের বর্ণনা দেয়া। ছবিগুলো তুলেছেন বেলজিয়ামের আলোকচিত্রী ডেইভিড ভারবেক্ট। তিনি গত দু'বছর বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং ভারতে আশ্রিত দেশহীন মানুষের ওপর কাজ করেছেন।
ছবিতে তিনি তুলে এনেছেন কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকতা না পাওয়া উদ্বাস্তু মানুষের জীবনকথা। ছবিগুলো দেখে মনে হলো, তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারি এবং রোহিঙ্গাদের ছবি তুলেছেন।
পরে জানতে পারলাম, এখানে ‘সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র উৎসব’ এর প্রদর্শনী চলছে। শুধু লিটল ইন্ডিয়ায় নয়, সিঙ্গাপুরের আরো পাঁচটি মেট্রোরেল স্টেশনে চলছে এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
মেট্রোরেলের স্টেশনে এমন আলোকচিত্র প্রদর্শনে সহযোগীতা করেছে ভূমি যোগাযোগ কর্তৃপক্ষ। জনগণের কাছে আলোকচিত্র প্রদর্শনী তুলে ধরতেই আয়োজকরা এমন জনবহুল মেট্রোরেল স্টেশনগুলো বেছে নিয়েছেন।
টিকেট কেটে কোনো গ্যালারিতে গিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখা হয় না বললেই চলে। তবে এমন একটি জায়গায় এই আয়োজন করায় সবার মতো আমিও শিল্পের কিছুটা স্বাদ নিতে পারলাম। মেট্রোরেল স্টেশনের মতো একটি জনবহুল স্থানে এমন অসাধারণ আয়োজন দেখে সত্যিই খুব ভাল লেগেছে আমার।
ভালো লাগাটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল যখন লিটল ইন্ডিয়া মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে গেলাম ট্রেনে ওঠার জন্য। সেখানে দেয়ালে বড় বড় পোস্টারে “হ্যাপি দিওয়ালি” লিখে শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে।
এর আগে র্যাফেলস প্লেসের মেট্রোরেল স্টেশনে দেখেছিলাম, খুব সুন্দর ছিমছাম আর নান্দনিকতায় ভরা একটি স্টেশন। সিঁড়ির পাশে লাগানো হয়েছে সারি সারি অর্কিডের গাছে। গাছগুলোতে খুব চমৎকার অর্কিড ফুলও ধরেছে।
কোনো একদিন চলার পথে হঠাৎ কোনো একটি মেট্রোরেলের স্টেশনে দাঁড়িয়ে এমন শিল্পকর্ম দেখার সুযোগ হবে তো? সেখানে দামি অর্কিড লাগানো না থাকলেও, কিছু গাঁদা বা গোলাপের গাছে সিঁড়িগুলো সাজানো থাকবে তো?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টেরই পাইনি। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম, বাংলাদেশের কোনো এক মেট্রোরেলের স্টেশনে আলোকচিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে। পথচারীরা সেখানে হেঁটে যাচ্ছে আর পোস্টারগুলোর ওপর পানের পিক ফেলছে।
কেউ আবার পোস্টারের কোণা টেনে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ পোস্টারের এক কোণায় দাঁড়িয়ে মূত্রত্যাগ করছে। হঠাৎ এক লোক মেট্রোরেল স্টেশনের সিঁড়িতে লাগানো ফুলের গাছ থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে আমার মুখের ওপর ছুঁড়ে মারলো! তখনি আমার নিদ্রাভঙ্গ হলো।
আশা করি, ঢাকায় মেট্রোরেল হবার পর সেখানকার স্টেশনে গেলে এমন করে আমার স্বপ্নভঙ্গ হবে না। মেট্রোরেল হোক ঢাকাবাসীর নিরাপদ যানবাহন।
লেখক: সাংবাদিক, rokeya.lita@hotmail.com
ছবি তুলেছেন জাকারিয়া রেহমান