সিঙ্গাপুরের চিঠি: ফল সংরক্ষণে বিকল্পের খোঁজ

কমলার খোসা। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বলেই জানতাম। কমলা খাওয়ার সময় খোসা ফেলে দেই সবসময়। সেই খোসা খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না!

রোকেয়া লিটাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 April 2017, 06:43 AM
Updated : 23 April 2017, 06:43 AM

শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি হলো, সেই কমলার খোসা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে খাবার হিসেবে বিক্রি হয়। নাহ্, আমি কাঁচা খোসার কথা বলছি না।

গত বছর মালয়েশিয়ার গেন্টিং হাইল্যান্ডের একটি শুকনো ফলের দোকানে খেয়েছিলাম। কমলার খোসাকে শুকিয়ে তাতে স্বাদ মতো লবণ-চিনি দিয়ে এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে যে, আমার মনেই হচ্ছিল না- আমি কমলার খোসা খাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছিল, আমি খুব সুস্বাদু একটি খাবার খাচ্ছি।

পাঠক, দয়া করে ভেবে বসবেন না যে কমলার খোসার স্বাদ বাড়িয়ে দিতে আমার এই লেখার অবতারণা। এই লেখার উদ্দেশ্য বুঝতে হলে আরও কিছুদূর পড়তে হবে।

যাই হোক, গেন্টিং হাইল্যান্ডের ওই শুকনো ফলের দোকানটিতে নাম না জানা অনেক ফলই দেখতে পেলাম। স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহল হতে পারে, না জানি ফলগুলো খেতে কেমন? দোকানদার নিশ্চিত ক্রেতাদের এই কৌতুহলের বিষয়টি বুঝেছিলেন। দোকানে সব ধরনের শুকনো ফল ছোঠ ছোট টুকরা করে স্যাম্পল আকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতার মন চাইলে এক টুকরো খেয়ে দেখতে পারে স্বাদ কেমন।  

আমরা ঘুরতে ঘুরতে পুরো দোকানটির প্রায় সব ফলরই দুই-এক টুকরা খেয়ে দেখলাম। বাংলাদেশে আমরা পেয়ারা খাই। সেই পেয়ারা যে লবণ, মরিচ দিয়ে শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা যায়, আর তা খেতে যে এত অসাধারণ লাগে, তা গেন্টিং হাইল্যান্ডের ওই শুকনো ফলের দোকানেই প্রথম টের পাই। সিঙ্গাপুরেও বিভিন্ন শপিং মলে ঘুরলে এমন শুকনো ফলের দোকান চোখে পড়ে। পুরো দোকান জুড়েই থাকে শুকনো ফল।

সিঙ্গাপুরে আসার পর প্রথম প্রথম খেয়াল করেছি, বাজার থেকে ফল এনে দুই-তিনদিন রেখে দিলেই পচন ধরে। এই বিষয়টার সাথে আমরা খুব একটা অভ্যস্ত ছিলাম না। বাংলাদেশে ফল কিনে এনে বাসায় রাখলে দিনের পর দিন সেই ফল ভালো থাকত। অর্থাৎ বাংলাদেশে ফলে প্রচুর ফরমালিন দেওয়া হয়। ফল উৎপাদনকারীদের দোষ দিয়ে লাভ কী বলেন? বাংলাদেশে সব ফলই পাকলে দাম বেড়ে যায়, কাঁচা ফল পানির দামে বিক্রি হয়। ফলে চাষিরা ফল পাকার অপেক্ষায় থাকে। আর পাকা ফল দীর্ঘ সময় ধরে বিক্রির আশায় ফরমালিন মেশায়।

কাঁচা ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন এখনও বাংলাদেশে লাভজনক হয়ে ওঠেনি। অল্প কয়েকটা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি ফলের আচার, জ্যাম, জেলি বা জুস বাজারজাত করলেও শুকনো ফল বাজারজাতকরণের কোনো নমুনাই নেই দেশে।

আমের মতো একটি সুস্বাদু ফলের কথাই ধরুন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডে সারাবছরই কাঁচা অথবা পাকা আম পাওয়া যায়। কাজেই আম শুকিয়ে বিক্রি করার কোনো প্রয়োজনই নেই এসব দেশে।

তারপরও বাজারে গেলে দেখা যায়, দোকানে দোকানে ‘ড্রাইড ম্যাঙ্গো’ (শুকনো আম) প্যাকেটে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে এবং মানুষ তা কিনছেও। কারন, শুকনো ফল বেশ সুস্বাদু। কাঁচা আম তো খেতে টক লাগে। কিন্তু এসব দেশে চিনি, অনুমোদিত রং ও প্রিজারভেটিভ দিয়ে কাঁচা আমকে এমনভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করা হয় যে, দেখলে মনে হয় পাকা আম কেটে প্যাকেট করে দোকানে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

আমি ২০১৫ সালে বান্দরবানের থানছি হয়ে তিন্দুতে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখেছি, রাস্তা-ঘাটে, নদীর ধারে আম পড়ে আছে, কেউ খায় না। বিক্রি করা তো আরও কষ্টকর। এই অঞ্চলের মানুষ অভাবের কারণে ঠিক মতো খেতে পায় না। অথচ গাছে এত আম তাদের কপাল ফেরাতে পারে না। কারন তিন্দু থেকে পাকা আম পাঠাতে পাঠাতে নষ্ট হয়ে যায়, আর কাঁচা আমের চাহিদা নেই।

প্রতি বছর আমের মৌসুমেও দেখা যায়, ফরমালিন দেওয়ার অভিযোগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রচুর আম জব্দ করে নষ্ট করে দেয়। কী যে অপচয়! আমি নিশ্চিত, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডের মতো আম শুকিয়ে বাজারজাত করার উপায় জানলে চাষীরা এত ফরমালিন ব্যবহার করত না। কারণ তখন কাঁচা আমও ভালো দামে বিক্রি করা যেত।

তাই, ফরমালিন ব্যবহারের কারণে ফল চাষিদের বা ব্যবসায়ীদের এককভাবে দায়ী করে লাভ কী? তাদের হাতে বিকল্প কিছু কি আমরা তুলে দিতে পেরেছি?

আমাদের ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানিগুলো এখনও জ্যাম, জেলি আর আচার নিয়েই বসে আছে। কাঁচা ফল-মূল যে আরও কতভাবে বাজারজাত করা যায়, তা তারা জানে না, এমন তো নয়। তারা বছরে দুই-একবার থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ায় এসে ঘুরে বেড়ায় না, তেমনও নয়।

কাজেই দেশে ফল-মূলে ফরমালিনের বাড়াবাড়ি ব্যবহারে শুধু ফল ব্যবসায়ীদের দোষ দিলেই চলবে না। তাদের হাতে বিকল্প তুলে দিতে হবে। ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানিগুলোকে সেই ডাইনোসর আমলের জ্যাম-জেলি, আচারের বাইরেও অনেক কিছু ভাবতে হবে। শুকনো ফল প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাতকরণ হতে পারে তেমনি একটি সমাধান।

লেখক: ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক

ই-মেইল: rokeya.lita@hotmail.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!