রাশিয়ায় ভাড়াটে ওয়াগনার যোদ্ধাদের ২৪ ঘণ্টার সশস্ত্র বিদ্রোহের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছে বিবিসি।
Published : 25 Jun 2023, 05:29 PM
জুনের দীর্ঘ এক রাত আর দিন মিলিয়ে ২৪ ঘণ্টায় রাশিয়ায় সুস্পষ্ট এক বিদ্রোহ মঞ্চস্থ করেছেন দেশটির কুখ্যাত ভাড়াটে বাহিনীর নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন; মস্কো অভিমুখে সাঁজোয়া যানের বহর পাঠিয়েছেন, সেই সঙ্গে ক্রেমলিনের ক্ষমতা কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দখল কতখানি, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন।
পরিস্থিতি এমন জায়গায় রুশ প্রেসিডেন্টকে ঠেলে দিয়েছিল, যে তিনি তার একসময়ের মিত্র প্রিগোজিনকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়েও অভিযুক্ত করেন, এই সশস্ত্র বিদ্রোহকে অভিহিত করেন ‘রাশিয়ার পিঠে ছুরিকাঘাত’ হিসেবে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ঘটনা বেশি দূর আগায়নি; শনিবার দিনের শেষভাগে ওয়াগনারপ্রধান বিদ্রোহে ক্ষান্ত দেন এবং সৈন্যদের ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
“২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমরা মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গেছি। এই সময়ের মধ্যে আমরা নিজেদের যোদ্ধাদের এক ফোঁটা রক্তও ঝরতে দিইনি,” বলেছিলেন তিনি।
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রবল বিক্রমে ইউক্রেইনে আক্রমণ করেন পুতিন। দিশাহীন হয়ে পড়া সে যুদ্ধ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই যুদ্ধই শনিবার রুদ্ররূপ নিয়ে ছুটছিল পুতিনের ঘরের দুয়ার পানে। ওয়াগনার গ্রুপের ২৪ ঘণ্টার সেই সহিংস হট্টগোলের নানান দিক তুলে ধরেছে বিবিসি।
প্রিগোজিন কি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন?
প্রিগোজিন তার বিদ্রোহকে অভ্যুত্থান নয়, বরং ‘ন্যায়বিচারের জন্য পদযাত্রা’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তবে সেটা যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তার পরিসমাপ্তি হয়েছে খুব দ্রুত।
কয়েক মাস ধরে তিনি ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। তার ওয়াগানার গ্রুপ হাজার হাজার যোদ্ধাকে রিক্রুট করেছে, এর মধ্যে আছে কারাবন্দিরাও।
ইউক্রেইনে যুদ্ধ পরিচালনকারী সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তার বিরোধও অনেক দিন ধরেই প্রকাশ্য; কিন্তু ১ জুলাইয়ের মধ্যে ওয়াগনারকে রুশ সামরিক কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে আনার ঘোষণা প্রিগোজিনকে বিদ্রোহে নামিয়ে দেয়।
ওয়াগনারের যোদ্ধারা পূর্ব ইউক্রেইন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় বড় শহর রস্তোভ-অন-দনে প্রবেশ করে। এরপর ভরোনেজ হয়ে প্রধান সড়ক ধরে মস্কো অভিমুখে রওনা দেয়।
মনে হচ্ছিল, এটি বোধহয় ইউক্রেইনে ১৬ মাস ধরে চলা রুশ হামলার নতুন কোনো সন্ধিক্ষণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু ওয়াগনারের সাঁজোয়া যানের কাফেলা উত্তরের দিকে অগ্রসর হওয়ার পথেই চুক্তির খবর আসে, অদ্ভুতভাবে ওই চুক্তির মধ্যস্থতাও করেন বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো।
গল্পটা এতই সহজ- খুব কমই লোকই তা বিশ্বাস করবেন; অবশ্য ক্রেমলিন যেমনটা বলছে, তা সঠিক হলে এই হাঙ্গামার মধ্য দিয়েই ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং রাশিয়ায় প্রিগোজিনের ভূমিকার সমাপ্তি হতে পারে।
ক্রেমলিন বলেছে, প্রিগোজিন বেলারুশে চলে যাচ্ছেন, তাকে ফৌজদারি অভিযোগের মুখোমুখিও হতে হবে না। তার বাহিনীর যোদ্ধাদেরও সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
তার এই বিদ্রোহ কি রক্তপাতহীন ছিল? এটা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি, কেননা শনিবার অন্তত একটি সামরিক হেলিকপ্টার গুলি করে ভূপাতিত করার খবর মিলেছিল।
ওয়াগনার বনাম রাশিয়ার সামরিক প্রধানরা
ইউক্রেইনে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায় কয়েক মাস ধরেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে প্রিগোজিনকে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন ইউক্রেইনে যুদ্ধরত সব ভাড়াটে গোষ্ঠীকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে আসতে বলেন, তখনই প্রিগোজিন তা প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক বাহিনীর অধীনে তার বাহিনী ঢুকে পড়লে, তার প্রভাব যে খর্ব হবে তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি।
এরপর ২৩ জুন দীর্ঘ এক বক্তৃতায় রাশিয়ানদের উদ্দেশে ক্রুদ্ধ প্রিগোজিন বলেন, ইউক্রেইন যুদ্ধের সমস্ত যৌক্তিকতাই মিথ্যার ওপর দাঁড়ানো। অল্প কজনের অসাধু একটি চক্র জনগণ ও প্রেসিডেন্টকে ভুল বুঝিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে এই যুদ্ধে নেমেছে।
এই বক্তব্যের পর রুশ সামরিক নেতাদের সঙ্গে প্রিগোজিনের বিরোধ মারাত্মক আকার ধারণ করে।
এর পরই ওয়াগনারপ্রধান তার যোদ্ধাদের ওপর মারাত্মক হামলা চালানোর জন্য রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। প্রমাণ হিসেবে প্রিগোজিন যে ভিডিওটি দিয়েছেন, তাতে কিছু পরিষ্কার হওয়াও যায়নি।
শুক্রবার রাতে তিনি ঘোষণা করেন, তার ‘ন্যায়বিচারের পদযাত্রা’ শুরু হয়েছে এবং তা চলমান।
“আমাদের ২৫ হাজার লোক আছে। দেশে কেন এমন বিশৃঙ্খলা, তা খুঁজে বের করতে যাচ্ছি। যারা চান, আমাদের সঙ্গে যোগ দিন।”
ইউক্রেইনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিন প্রিগোজিনকে পিছু হটতে এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের কর্তৃত্ব মানতে আহ্বান জানান।
রাতে সীমান্ত পেরিয়ে রস্তোভ-অন-দনে যোদ্ধাদের নিয়ে আসার পর প্রিগোজিন রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক সদর দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করেন; এই দপ্তর থেকেই ইউক্রেইনে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে তার ভিডিওতে এও দেখানো হয়, শহরের কেন্দ্রস্থলে তার লোকেরা কোনো প্রতিরোধের মুখেও পড়ছে না।
শনিবার সকালে তিনি বলেন, ‘আমরা (সামরিক) সদর দপ্তরের ভেতরে আছি’।
শহরটি কোনো ‘গুলি করা ছাড়াই’ দখলে নিয়েছি, বলেন তিনি।
এর পরই রাশিয়ার ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস-এফএসবি একটি ফৌজদারি মামলা করে। পুরো মস্কো অঞ্চলজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়। সতর্কতা জারি হয় মস্কো আর রস্তোভ-অন-দনের মাঝে থাকা ভরোনেজেও।
টেলিভিশনে পুতিনের ভাষণ
শনিবার সকালে কঠোর ও দৃঢ়চেতা ভঙ্গিতে ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তার পাঁচ মিনিটের বক্তব্যে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে উদাত্ত আহ্বান জানান।
জাতির উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা এখন যা সম্মুখীন হচ্ছি, তা সুনির্দিষ্টভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা।”
একসময়কার মিত্রের নামোল্লেখ না করে তিনি বলেন, সামরিক বিদ্রোহের পেছনে যারা রয়েছে তারা রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং এর জবাব পাবে।
প্রিগোজিন সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্যকে ‘চরম ভুল’ অভিহিত করে এর সমালোচনাও করেন তিনি।
এর আগ পর্যন্ত কখনোই তিনি সরাসরি পুতিনকে আক্রমণ করে কিছু বলেননি। যদিও তার ব্যাঙ্গাত্মক ‘হ্যাপি গ্র্যান্ডফাদার’ শব্দচয়নকে পুতিনের প্রতি পরোক্ষ সমালোচনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
“যুদ্ধে কীভাবে জিতবে রাশিয়া, যদি দেখা যায় যে এই গ্র্যান্ডফাদার পুরোপুরি গর্দভ?” গত মাসে এই প্রশ্নও ছুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
রস্তোভ-অন-দন থেকে রওনা দেওয়া ওয়াগনারের সাঁজোয়া যানকে কিছু সময় পরই ভরোনেজ এবং পরে আরও উত্তরের লিপেৎস্ক ধরে সামনে অগ্রসর হতে দেখা যায়।
ভরোনেজে ‘বিমান হামলায়’ একটি জ্বালানি ডিপোতে আগুন ধরে যায়, তবে কীভাবে এটি হয়েছিল তার বিস্তারিত জানা যায়নি।
পুতিনের শাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ?
প্রিগোজিন বলেছিলেন, তিনি ইউক্রেইনে রাশিয়ার যুদ্ধকে চ্যালেঞ্জ করছেন না, তার চ্যালেঞ্জ যুদ্ধের দায়িত্বে যারা আছেন সেই ‘ভাঁড়দের’ উদ্দেশ্যে।
তার সামরিক বাহিনীর দাবি পূরণ না হলে মস্কোর দিকে যাওয়ার ঘোষণা দিলেও তিনি বলেছিলেন, পুতিনের নেতৃত্বের বিরোধিতা করছেন না তিনি।
অথচ শনিবার বেশ কয়েক ঘণ্টা পুতিনকে এমন একজন নেতার মতো দেখাচ্ছিল, যিনি হঠাৎ দ্রুত বদলে যাওয়া পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। অবশেষে শনিবার সন্ধ্যায় চুক্তির খবর নিয়ে ত্রাতা হয়ে আসেন পুতিনের আরেক ঘনিষ্ঠ মিত্র, বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো।
সমঝোতা হয়, প্রিগোজিনের মামলা প্রত্যাহার হবে, তিনি বেলারুশ চলে যাবেন। পরে একটি গাড়িতে করে তাকে রস্তোভ ছেড়ে যেতেও দেখা যায়।
তার ওয়াগনার যোদ্ধাদেরও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না, যারা চাইবেন তারা এমনকি রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চুক্তিতেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
এই বিদ্রোহ পুতিনকে কোথায় নিয়ে যাবে?
দিনভর ভাড়াটে যোদ্ধাদের এই বিদ্রোহে পুতিনকে দুর্বল মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল প্রিগোজিনের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী এমন এক প্রেসিডেন্ট যার দেশে সারাদিন ধরে এমন এক হাঙ্গামা চলতে পারে।
বেলারুশ নেতার ওপর ভরসা করাটাও বেমানান। কারণ ২০২০ সালের নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা যখন বেলারুশকে অস্থির করে তুলেছিল তখন লুকাশেঙ্কোকে রাশিয়াই সমর্থন দিয়ে রক্ষা করেছিল।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় বলেছে, পুতিনের মুখে চুনকালি পড়েছে।
আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গিও আছে। যাতে বলা হচ্ছে, রাশিয়ানরা পুতিন প্রেসিডেন্ট পদে না থাকলে কেমন হতে পারে তার একটি নমুনা এ বিদ্রোহের মাধ্যমে দেখে ফেলল, যেখানে কয়েক ঘণ্টা ধরে কেবল অরাজকতাই চলছে বলে মনে হচ্ছিল।
সামরিক বাহিনীও এখন ২৫ হাজার যুদ্ধবাজ ভাড়াটে সৈন্যকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় খুঁজে পেল।
সামরিক বাহিনীর ভেতর খেলা হয়তো আরও চলবে, কিন্তু ওয়াগনারের অশান্ত নেতাকে সেখানে খুঁজে পাওয়া কঠিনই হবে, তিনি তো এখন দৃশ্যপটের বাইরে।
আরও পড়ুন-
রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ কী, তাতে আছে কারা, করে কী?
নিজ দেশে রক্তপাত এড়াতে পারলেন পুতিন?
বাখমুত পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি রাশিয়ার ওয়াগনার প্রধানের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ ওয়াগনার বাহিনীর