ভাড়াটে যোদ্ধা রাশিয়ায় অবৈধ হলেও দেশটির নিবন্ধিত কোম্পানি হয়ে ইউক্রেইনসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছে এই গ্রুপ।
Published : 24 Jun 2023, 06:15 PM
হঠাৎ করে বিদ্রোহী হয়ে আলোচনায় এখন রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপ।
বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ওয়াগনার গ্রুপের হয়ে রাশিয়ার পক্ষে এখন ১০ হাজার ভাড়াটে সৈন্য ইউক্রেইনে যুদ্ধ করছে বলে ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি ইউক্রেইনের সৈন্যদের থেকে বাখমুতের দখল নিতে দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল লড়াইয়ে এই যোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
নিজেকে বেসরকারি সামরিক কোম্পানি হিসেবে দাবি করা এই গ্রুপ রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করলেও রুশ সরকার এখন এর লাগাম টানার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু ওয়াগনার আসলে কী, কারা এই গ্রুপে এবং কী কাজ করছে, সেইসঙ্গে রুশ সরকার এখন কেন তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করছে, তা তুলে এনেছে বিবিসি।
ওয়াগনার গ্রুপ কী, কারা সেখানে?
আনুষ্ঠানিকভাবে ‘পিএমসি ওয়াগনার’ নামে পরিচিত ওয়াগনার গ্রুপ প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৪ সালে। সেসময় পূর্ব ইউক্রেইনে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করছিল তারা।
যখন এটি একটি গোপন সংগঠন ছিল, তখন এর সদস্যরা আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে কাজ করছিল। সেসময় এর ৫ হাজার যোদ্ধা ছিল বলে মনে করা হয়, যাদের বেশিরভাগই রাশিয়ার অভিজাত বাহিনৗ ও বিশেষ বাহিনী থেকে আসা প্রবীণ অভিজ্ঞ যোদ্ধা। এরপর থেকে ওয়াগনারের কার্যক্রম যথেষ্ট বেড়েছে।
ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গত জানুয়ারিতে জানায়, ওয়াগনার এখন ইউক্রেইনে তাদের প্রায় ৫০ হাজার যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ইউক্রেইন অভিযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
বাখমুত পুরো নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি রাশিয়ার ওয়াগনার প্রধানের
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ অভিযোগ ওয়াগনার বাহিনীর
তারা বলছে, ওয়াগনার গ্রুপ ২০২২ সালে বিশাল পরিমাণে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে; কারণ রাশিয়া তার নিয়মিত সৈন্যদের জন্য লোক খুঁজে পাচ্ছিল না।
মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল চলতি বছরের শুরুতে জানায়, ইউক্রেইনে ওয়াগনারের প্রায় ৮০ শতাংশ যোদ্ধাকে আনা হয়েছে কারাগার থেকে।
ভাড়াটে যোদ্ধা রাশিয়ায় অবৈধ হলেও ২০২২ সালে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় ওয়াগনার গ্রুপ। এরপর তারা সেইন্ট পিটার্সবার্গে একটি সদরদপ্তর খোলে।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ডা. স্যামুয়েল রামানি বলেন, রাশিয়ার শহরগুলোতে বিলবোর্ডে প্রকাশ্যে নিয়োগ কার্যক্রম চালাচ্ছে এই গ্রুপ। রুশ সংবাদমাধ্যমে একে ‘দেশপ্রেমিক সংগঠন’ হিসেবেও উল্লেখ করা হচ্ছে।
কী করছে তারা ইউক্রেইনে?
পূর্ব ইউক্রেইনে রাশিয়ার বাখমুত দখল নেওয়ার সময় ব্যাপকভাবে যুক্ত ছিল ওয়াগনার গ্রুপ। ইউক্রেইনীয় সৈন্যরা বলছে, খোলা ময়দানে এই গ্রুপের প্রচুর পরিমাণ যোদ্ধাকে আক্রমণে পাঠানো হয়েছিল, ফলে অনেকে মৃত্যুও হয়েছে।
প্রথমে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওয়াগনার গ্রুপের যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করেনি। যাহোক, ‘সাহসী’ ও ‘নিঃস্বার্থ’ ভূমিকা পালনের জন্য পরবর্তীতে এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের তারা প্রশংসা করে।
শুরুটা কীভাবে
ওয়াগনার গ্রুপকে নিয়ে বিবিসির এক অনুসন্ধানে প্রাক্তন রুশ সেনা কর্মকর্তা দিমিত্রি উটকিনের জড়িত থাকার কথা তুলে ধরা হয়। চেচনিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অভিজ্ঞ সমর কৌশলী তিনি, যিনি ওয়াগনারের প্রথম ফিল্ড কমান্ডার ছিলেন বলে মনে করা হয়। তার পুরনো রেডিও কল সাইনের নামানুসারে গ্রুপটির নামকরণ করেছিলেন তিনি।
ওয়াগনারের মস্কোতে যাওয়ার হুমকি কতোটা বাস্তব?
ওয়াগনার গ্রুপের এখনকার প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। ধনাঢ্য এই ব্যবসায়ীকে ‘পুতিনের শেফ’ নামেও ডাকা হয়, কারণ তিনি ক্রেমলিনে খাবার সরবরাহ করতেন।
ওয়াগনার গ্রুপের প্রথম অপারেশন ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়া দখলে রাশিয়াকে সাহায্য করেছিল, বলছেন কিংস কলেজ লন্ডনের ‘সংঘাত ও নিরাপত্তা’ বিষয়ের অধ্যাপক ট্রেসি জার্মান।
ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহ আগে ক্রেমলিনের আক্রমণের অজুহাত দাঁড় করাতে ওয়াগনার ‘ভুয়া হামলা’ চালিয়েছিল বলে মনে করা হয়।
রাশিয়ার সামরিক কমান্ডারদের সঙ্গে সংঘাত কীভাবে?
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বারবার ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সেগেই শোইগু এবং ইউক্রেইনে রুশ বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমোভকে অদক্ষতা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়াগনার যোদ্ধাদের কম করে ইউক্রেইনে পাঠানোর অভিযোগ তোলেন।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এখন বলছে, তাদের হয়ে ইউক্রেইনে কাজ করা ‘স্বেচ্ছাসেবক কাঠামোগুলোকে’ জুনের শেষের মধ্যে সরকারের সঙ্গে চুক্তি সই করতে হবে।
সরকারের এই ঘোষণায় ওয়াগনার গ্রুপের নাম না থাকলেও এই উদ্যোগকে সংগঠনটির ওপর নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রিগোজিন এক বিবৃতিতে জোর গলায় বলেছেন, তার বাহিনী এসব চুক্তি বয়কট করবে।
ওয়াগনার গ্রুপ আর কোথায় কাজ করছে?
২০১৫ সাল থেকে সিরিয়ার রয়েছে ওয়াগনারের যোদ্ধারা। তারা সরকারপন্থী বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করছে এবং তেলের খনিগুলো পাহারা দিচ্ছে।
লিবিয়াতেও এই বাহিনী রয়েছে। তারা জেনারেল খলিফা হাফতারের অনুগত বাহিনীকে সমর্থন করছে।
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (সিএআর) হীরার খনি পাহারা দেওয়ার জন্য ওয়াগনার গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সুদানে সোনার খনি পাহারা দেওয়ারও কাজ করছে বলে মনে করা হয়।
পশ্চিম আফ্রিকার মালি সরকার ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহার করছে।
প্রিগোজিন ওয়াগনার গ্রুপের অপারেশনগুলো থেকে অর্থ উপার্জন করছেন বলে মনে করা হয়। মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বলছে, নিজের খনি কোম্পানিগুলোর সমৃদ্ধির জন্য ওয়াগনারের উপস্থিতিকে কাজে লাগান প্রিগোজিন। তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার অধীনে রেখেছে ট্রেজারি বিভাগ।
ওয়াগনারের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ
ওয়াগনার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর গত জানুয়ারিতে নরওয়েতে আশ্রয়ের দাবি করেছিলেন ওই কোম্পানির সাবেক এক কমান্ডার। নিজেকে ইউক্রেইনে যুদ্ধাপরাধের প্রত্যক্ষদর্শী বলেও দাবি করেন তিনি।
ইউক্রেইনের প্রসিকিউটররা তিনজন ওয়াগনার যোদ্ধার বিরুদ্ধে ২০২২ সালের এপ্রিলে কিইভের কাছে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ তুলেন।
এছাড়া ওই বছরের মার্চে ওয়াগনার কর্মীদের বিরুদ্ধে বুচা শহরের বাসিন্দাদের গণহত্যার অভিযোগ করেন জার্মান গোয়েন্দারা। যুক্তরাষ্ট্র ও ফরাসি সরকার সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিকে ধর্ষণ ও ডাকাতির অভিযোগও তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে।
২০২০ সালে লিবিয়ার ত্রিপোলিতে ওয়াগনার কর্মীরা ল্যান্ডমাইন স্থাপন করেছে বলে দাবি করে মার্কিন সামরিক বাহিনী।