কদিন আগের মিত্র ওয়াগনার বাহিনী মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল; যা ২৩ বছরের শাসনামলে প্রথমবার এত কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলেছে পুতিনকে।
Published : 25 Jun 2023, 01:58 AM
বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত থামানো গেছে মস্কো অভিমুখে ‘যুদ্ধযাত্রা’ শুরু করা ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের ওয়াগনার বাহিনীকে।
যারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে।
লুকাশেঙ্কোর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, ‘তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার বিনিময়ে’ ওয়াগনার যোদ্ধারা ফিরে যেতে রাজি হয়েছে।
এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বেলারুশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থা বেল্টা জানায়, প্রিগোজিনকে ‘যুদ্ধযাত্রা’ থামাতে রাজি করানোর পর লুকাশেঙ্কো নিজেই টেলিফোনে পুতিনকে সেই খবর দিয়েছেন। পুতিনের অনুমতি নিয়েই লুকাশেঙ্কো ওয়াগনার প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন বলেও জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি।
সৈন্যদল ফিরে যাবে: ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিন
গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রবল বিক্রমে ইউক্রেইনে আক্রমণ করেন পুতিন। দিশাহীন হয়ে পড়া সে যুদ্ধ পুরো বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই যুদ্ধই শনিবার রুদ্ররূপ নিয়ে ছুটছিল পুতিনের ঘরের দুয়ার পানে।
পুরো দুনিয়া উৎকণ্ঠা নিয়ে সারাদিন ধরে দেখছিল ওয়াগনার বাহিনীর মস্কোর পানে ছুটে চলা। পুতিন যেটিকে ‘বিদ্রোহ’ এবং ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।
সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছিলেন, রাশিয়ার কিছুতেই এই বিদ্রোহকে অভ্যুত্থান অথবা বৈশ্বিক সংকটের রূপ নিতে দেবে না।
পশ্চিমাদের সতর্ক করে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘‘যদি রাশিয়ার পরমাণু অস্ত্র দস্যুদের হাতে পড়ে যায় তবে তা পুরো বিশ্বকে বিপর্যয়ের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেবে।”
রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও শনিবার এক বিবৃতিতে পশ্চিমাদের সতর্ক করে বলা হয়, তাদের ‘রুশোফোবিয়ার লক্ষ্য অর্জনে’ ভাড়াটে ওয়াগনার বাহিনীর বিদ্রোহকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা একদমই উচিত হবে না।
ওয়াগনারদের হঠাৎই এ বিদ্রোহে পশ্চিমাদের হাত আসলে কতটা ছিল তা হয়তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জানা যাবে।
তবে লুকাশেঙ্কোর চেষ্টায় ‘যুদ্ধযাত্রা’ যে থামানো গেছে সেটাই বড় কথা।
প্রিগোজিনের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রচার করা এক ভয়েস নোটের ‘রক্তপাত এড়াতে’ তিনি যোদ্ধাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও বলেছেন।
বলেছেন, তারা ওয়াগনার সামরিক কোম্পানিকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। আমরা ২৩ জুন ন্যায়বিচারের পদযাত্রা শুরু করি এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মধ্যে মস্কোর ২০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছি। এই সময়ে আমরা আমাদের যোদ্ধাদের এক ফোঁটা রক্তপাতও হতে দেইনি।
‘‘তবে এখন সেই মুহূর্ত এসেছে, যখন রক্ত ঝরতে পারে। বুঝতে পারছি ... যে রাশিয়ানদের রক্তই একদিকে ছিটকে পড়বে। তাই আমরা আমাদের বহর ঘুরিয়ে দিচ্ছি এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি।”
এতে করে গত দুই দিনের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অনেকটা স্তিমিত হয়ে যায় শেষ আধা ঘণ্টার নাটকীয় ঘোষণায়। টেলিগ্রামে ওয়াগনার প্রধানের মস্কো অভিমুখে অগ্রযাত্রা বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যে তা ৩০ লাখ মানুষ দেখেছেন।
দিনভর যা হয়েছে
ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছে ভাড়াটে সেনাদের দল ওয়াগনার বাহিনী। যাদের নেতৃত্বে তীব্র লড়াইয়ের পর গত মাসে ইউক্রেইনের বাখমুত শহরের দখল পায় রাশিয়া।
ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন, যিনি পুতিনের ঘনিষ্ঠজন বলেই পরিচিত। হঠাৎ করেই তিনি অভিযোগ করেন, রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্ব গত শুক্রবার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে তার বাহিনীর বহু সেনাকে হত্যা করেছে, তাই তিনি তাদের নিজ নিজ পদ থেকে অপসারণ করে শাস্তি দিতে চান।
এ অভিযোগ জানানোর কয়েক ঘণ্টা পর শনিবার ভোররাতে প্রিগোজিন জানান, তার ওয়াগনার বাহিনীর যোদ্ধারা ইউক্রেইন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার রস্তোভ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং তারা মস্কোর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। তার বাহিনীর ২৫ হাজার যোদ্ধা তার সঙ্গে আছে বলেও দাবি করেন তিনি।
শনিবার দিনভর ওয়াগনার বাহিনী রস্তোভ থেকে ১,১০০ কিলোমিটার দূরে মস্কোর পথে অগ্রসর হয়েছে।
তাদের থামাকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী আকাশ থেকে ওয়াগনার বাহিনীর উপর গোলাবর্ষণ করেছে বলে জানিয়েছে প্রায় সবকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু তাদের অগ্রযাত্রার গতি কমাতে পারেনি।
গত ২৩ বছর ধরে রাশিয়া শাসন করছেন পুতিন। দীর্ঘ এই শাসনামলে প্রথমবার তিনি এতটা গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। তাও আপন লোকদের দ্বারাই।
শনিবার এক ভাষণে পুতিন উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ বলে বর্ণনা করেন। এ পরিস্থিতিকে তিনি এক শতাব্দী আগে রাশিয়ায় হওয়া গৃহযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে একে কঠোর হাতে দমনের প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন।
ইউক্রেইনের দোনেৎস্ক প্রদেশে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছিল, মস্কো অভিমুখে যাত্রা করা ওয়াগনার দলটিতে প্রায় পাঁচ হাজার যোদ্ধা ছিল। যাদের নেতৃত্বে ছিলেন জ্যেষ্ঠ ওয়াগনার কমান্ডার দিমিত্রি উৎকিন।
ওয়াগনার বাহিনী যেভাবে দ্রুত গতিতে মস্কোর অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল তা দারুণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল নগরীর মেয়র সের্গেই সোবিয়ানিন। তিনি সেটিকে ‘কঠিন পরিস্থিতি’ বর্ণনা করে মস্কোকে ‘সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।
এমনকি ঝুঁকি কমাতে আগামী সোমবারকে মস্কোয় ‘নন-ওয়ার্কিং ডে’ বা ‘কর্মহীন দিবস’ বলেও ঘোষণা করা হয়। বাসিন্দাদেরও ভ্রমণ এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
নগরীর সড়কগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং ধাতব ব্যারিকেড দিয়ে বিখ্যাত রেড স্কয়ারে যাওয়ার পথও আটকে দেওয়া হয়।
প্রিগোজিনের দাবি ছিল, তার যোদ্ধারা দুর্নীতিবাজ ও অযোগ্য কমান্ডার যারা ইউক্রেইন যুদ্ধের জন্য দায়ী তাদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে ‘ন্যায়ের মিছিলে’ নেমেছে।
অন্যদিকে, শনিবার স্থানীয় সময় সকালে টেলিভিশনে এক ভাষণে পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়ার অস্তিত্ব হুমকির মুখে ছিল।
‘‘আমরা আমাদের জনগণের জীবন ও নিরাপত্তার জন্য, আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার জন্য এবং হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করছি।
‘‘যারা ইচ্ছাকৃতভাবে বিশ্বাসঘাতকতার পথে পা দিয়েছে, যারা সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রস্তুতি নিয়েছে, যারা হুমকি দিয়ে সুবিধা আদায় এবং সন্ত্রাসবাদের পথ বেছে নিয়েছে, তারা অনিবার্য শাস্তি ভোগ করবে। আইন এবং আমাদের জনগণ উভয়ের কাছেই তাদের জবাবদিহি করতে হবে।”