ইমরান খান হত্যাচেষ্টা: পাকিস্তান এবার কোন পথে?

এই সঙ্কট পাকিস্তানকে নতুন করে খাদের কিনারে নিয়ে যেতে পারে, আবার সব মিলিয়ে ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে লাভবানও হতে পারেন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Nov 2022, 07:40 PM
Updated : 4 Nov 2022, 07:40 PM

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গুলি করে হত্যার চেষ্টার পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন অস্থিরতা।

লং মার্চ চলার মধ্যে হামলার শিকার হয়েও প্রাণে বেঁচে ফেরা সাবেক এই ক্রিকেট তারকার সমর্থনে তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) কর্মীবাহিনী দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেছেন।

হামলার পর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, সহিংসতা ছড়িয়েছে অর্থনীতিতে টালমাটাল দেশটির বিভিন্ন এলাকায়।   

শুক্রবার হাসপাতালে হুইল চেয়ারে বসে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী ইমরান। হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর শীর্ষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফয়সালকে সরাসরি দায়ী করেছেন তিনি।

সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় গত এপ্রিলে ক্ষমতা হারানো ইমরানের দাবি, হত্যাচেষ্টা যে হবে, সে খবর তিনি আগেই পেয়েছিলেন।

তিনি বলেছেন, “যতক্ষণ বিচার না পাবে, ততক্ষণ দেশ মুক্ত হতে পারবে না। হামলা পরিকল্পনায় যে তিনজন জড়িত, তাদের পদত্যাগ করতে হবে। না হলে, তদন্ত হতে পারে না।”

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ এর পাল্টায় ইমরান খানের লং মার্চের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকার জন্য পাঞ্জাব সরকারকে দোষারোপ করেছেন। তার বক্তব্য, এমন লংমার্চ কিং অন্য যে কোনো সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের।

মুসলিম লীগ সরকারের (নওয়াজ) আরেক মন্ত্রী খাজা সাদ রফিক হামলার ঘটনা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে বলেছেন, “আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই, তাও আপনারা নাম বলা শুরু করেছেন। ইমরান প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কোনো ছবিও নেই। হতে পারে এটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।”

আর পাকিস্তানের আইএসপিআর ইমরানের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন’ আখ্যায়িত করেছে।

Also Read: পাকিস্তান: অনেক নাটকের পর আস্থাভোটে ক্ষমতাচ্যুত ইমরান খান

Also Read: ইমরান খান: রাজনীতির খেলায় হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায়

নতুন নির্বাচনের দাবি তুলে ইমরান পাকিস্তানে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ লংমার্চের ডাক দিয়েছিলেন। গত ২৯ অক্টোবর লাহোর থেকে শুরু হয় সেই কর্মসূচি। বৃহস্পতিবার পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে সমাবেশের মধ্যে অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে গুলি চালানো হয়।

পায়ে ‍গুলি লাগায় হাসপাতালে নেওয়া হয় ইমরানকে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরও দশজন ওইসময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, নিহত হয়েছেন পিটিআইয়ের এক কর্মী। 

হামলার সময় ইমরানের সঙ্গে থাকা পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ নেতা ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, দলের প্রধানের ওপর হামলাটি ছিল ‘পরিকল্পিত হত্যাচেষ্টা’। এখন প্রতিশোধ নিশ্চিত করতে রাস্তায় নেমে এসেছেন দলের কর্মীরা।

পরিস্থিতি যে নতুন করে সংঘাতের দিতে যাচ্ছে, হামলার পরের ২৪ ঘণ্টায় সরকার ও বিরোধী শিবিরের কথার লড়াইয়ে তা স্পষ্ট।

দেশটির রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে গত এপ্রিলে ইমরানকে অপসারণের পর যেসব বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, সবশেষ হামলাকে তারই ফল হিসেবে দেখা হয়েছে প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ডনের এক বিশ্লেষণে।

সার্বিকভাবে রাজনৈতিক গোষ্ঠীবাদ নতুন চেহারা পাওয়ায় দেশটির সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে।

দেশটির প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইকরাম সেহগাল মনে করেন, হামলার ঘটনা কেন, কীভাবে ঘটেছে তা হয়ত এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু এ ঘটনা ইমরানকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুযোগ এনে দিতে পারে।

পাকিস্তানের ইতিহাসে বেনজীর ভুট্টো ও লিয়াকত আলী খানও হামলার শিকার হয়েছেন, কিন্তু এবারের পরিস্থিতি জটিল ঠেকছে ইকরাম সেহগালের কাছে।   

তিনি বলেন, “যাই ঘটে থাকুক, এর ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিদ্বেষ ও সহিংসতা আরও বাড়িয়ে দেবে। সব মিলিয়ে ইমরান খান রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারেন, কারণ লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাকে জীবনের ঝুঁকির নিতে দেখা যাবে, যা ভাসমান ভোটারদেরকে আকৃষ্ট করতে পারে।”

ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান ২০১৮ সালে ভোটে জিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। দেশটির রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী সেনাবাহিনীর সমর্থন তখন তার দিকে থাকলেও কিছু দিন পর তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।

সেনা সমর্থন হারানো ইমরানের বিরুদ্ধে এই বছরের শুরুতে জোট বেঁধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে দেশটির বড় দুই রাজনৈতিক দল। তাতে হেরে গত এপ্রিলে ইমরানের সরকারের পতন ঘটলে প্রধানমন্ত্রী হন মুসলিম লিগের শাহবাজ শরিফ, যিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই।

রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে দুর্বল অর্থনীতি যে আরও নাজুক হবে তা মনে করিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ এশিয়া সেন্টার অব দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের ফেলো সুজা নওয়াজ।

তিনি মনে করেন, পাকিস্তান এখন রাজনৈতিক আলোচনায় নেই, দলগুলো একে অপরের অতীত নিয়ে পড়ে আছে। হামলার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।

“পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত জরুরি, প্রথমত পাঞ্জাব সরকারের তরফে এবং তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। গুলি ও অস্ত্রের ফরেনসিক প্রমাণ জরুরি। তা না হলে আগামীর রাজনৈতিক অস্থিরতা টালমাটাল অর্থনীতিকে পর্যদুস্ত করে ফেলবে।”

পাকিস্তানের সেরাইকি পার্টির প্রধান নুখবাহ তাজ বলেন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে অসহনশীলতা ও ঘৃণা বেড়েই চলেছে। নিজেরা সংশোধন না হলে মানুষের জীবন দিনকে দিন সস্তা থেকে আরও সস্তা হয়ে উঠবে।

দেশটির সাংবাদিক মোশাররফ জাইদি মনে করেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পিটিআইয়ের বিবৃতিতে আগের চাইতে বেশি ক্ষোভ থাকবে। রানা সানাউল্লাহর (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মত ক্ষমতাসীন নেতাদের বক্তব্য বিদ্বেষ আরও বাড়িয়ে তুলবে। সব মিলিয়ে মার্চের পর থেকে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে তা সমাধানের তেমন কোনো আশা দেখা যাচ্ছে না।