আল কাদির ট্রাস্ট মামলা: কী অভিযোগ ইমরান খানের বিরুদ্ধে

পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, অলাভজনক আল-কাদির ট্রাস্টে মাত্র দুইজন ট্রাস্টি, তারা হলেন ইমরান খান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবি।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 May 2023, 11:00 AM
Updated : 10 May 2023, 11:00 AM

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ইমরান খান মঙ্গলবার দুটি মামলায় আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে ওই দুই মামলায় নয়, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরেকটি দুর্নীতির মামলায়, যাকে বলা হচ্ছে আল কাদির ট্রাস্ট মামলা।  

দেশটির ইংরেজি সংবাদপত্র ডন জানিয়েছে, ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পরপরই মহাপরিদর্শক আকবর নাসির খানের বরাতে ইসলামাবাদ পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আল কাদির ট্রাস্ট মামলায়, যেখানে পিটিআই প্রধান ও তার স্ত্রী বুশরা বিবির বিরুদ্ধে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির কাছ থেকে কয়েক বিলিয়ন রুপি এবং কয়েকশ কানাল (পাকিস্তানে জমি পরিমাপের একটি একক, ১ কানাল=৫০৬ বর্গমিটার) জমি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।       

পাকিস্তানের জিও টিভি বলছে, ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, আল কাদির ট্রাস্টের ৬০ বিলিয়ন রুপি আত্মসাতের মামলায় পিটিআই প্রধানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কী এই আল কাদির ট্রাস্ট মামলা?

ঘটনার সূত্রপাত পাঁচ বছর আগে। সে সময় যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) পাকিস্তানের ধনী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজের সঙ্গে ১৯ কোটি পাউন্ডের একটি আপস রফায় আসে। যুক্তরাজ্যে ৫ কোটি পাউন্ডের একটি সম্পত্তিও রয়েছে (১ হাইড পার্ক প্লেস, লন্ডন, ডব্লিউ২ ২ এলএইচ) এর মধ্যে। ওই অর্থের পুরোটাই মালিক রিয়াজের জব্দ করা ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে বলে এনসিএর এক বিবৃতিতে জানানো হয় সে সময়।

পাকিস্তানে পিটিআই ক্ষমতায় আসার পরপরই ২০১৮ সালে যুক্তরাজ্যে রিয়াজের সম্পদ নিয়ে এনসিএর অনুসন্ধানের তথ্য প্রথম প্রকাশ্যে আসে। ২০১৯ সালের ১৪ অগাস্ট তাদের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আটটি ব্যাংক হিসাবে থাকা ১০ কোটি পাউন্ড জব্দ করার আদেশ হয়েছে। ওই অর্থ কোনো একটি বিদেশি রাষ্ট্রে ঘুষ এবং দুর্নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল। এর মধ্যে ২ কোটি পাউন্ড ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে জব্দ করা হয় দুর্নীতিতে জড়িত এক ব্যক্তির কাছ থেকে।

এর আগে ওই বছরই মালিকের রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বাহরিয়া টাউন লিমিটেডের বিরুদ্ধে করাচির মালির জেলায় কয়েক হাজার একর জমি অবৈধভাবে দখলের অভিযোগ উঠলে ৪৬০ বিলিয়ন রুপি জরিমানা করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।

ওই রায়ের পরপরই মালিক এক টুইটে জানিয়েছিলেন, ৪৬০ বিলিয়ন রুপি জরিমানার বিপরীতে তার জব্দকৃত অর্থ সুপ্রিম কোর্টে যাবে। পরে সেই অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না হয়ে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।

এনসিএ ৩ ডিসেম্বর অর্থ জব্দের বিষয়টি জানানোর পর পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা বিষয়ক বিশেষ সহকারী (এসএপিএম) মির্জা শাহজাদ আকবর দাবি করেছিলেন, ওই অর্থ সরাসরি দেশে আসবে।

Also Read: ইমরানের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে পাকিস্তানজুড়ে হরতালের ডাক

Also Read: কড়া নিরাপত্তার মধ্যে পুলিশ লাইনসের আদালতে ইমরান

বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিলে আকবর সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছিলেন, “সুপ্রিম কোর্ট কি সরকারের অংশ নয়? যদি অর্থ সর্বোচ্চ আদালতে যায়, তার মানে হল তা দেশেই এসেছে।”

যুক্তরাজ্যসহ এ মামলায় জড়িত সব পক্ষের গোপনীয়তা রক্ষার কারণ দেখিয়ে সে সময় তিনি ওই অর্থের উৎস এবং তা কীভাবে দেশে এল, তা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

“গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে আমরা যুক্তরাজ্য সরকারের চুক্তিবদ্ধ এবং এ কারণেই আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত বলতে পারছি না।”

ইমরান যেভাবে আসামি

২০২২ সালের জুনে মালিক রিয়াজ ও তার মেয়ের মধ্যে ফোনালাপের একটি অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। তখন বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। ওই অডিওতে তাদের ইমরান খানের স্ত্রী বুশরা বিবির বন্ধু ফারাহ খান ওরফে গোগির বিষয়ে কথা বলতে শোনা যায়।

ইমরান খান সরকারের কিছু অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন তারা। ওই ফোনালাপে যে নারীকণ্ঠ শোনা যায়, ধারণা করা হয় সেটি মালিক রিয়াজের মেয়ের। তিনি বাবাকে বলছিলেন- ফারাহ তাকে বলেছেন, সাবেক ফার্স্ট লেডি তাকে ডেকে দুই ক্যারেটের হীরার আংটি নিতে অস্বীকার করেছেন, তার পরিবর্তে পাঁচ ক্যারেটের একটি আংটি দাবি করেছেন।

রিয়াজ পরে দাবি করেন, এর সঙ্গে রাজনৈতিক কোনো বিষয় জড়িত নয়। এক টুইটে তিনি বলেন, ফাঁস হওয়া অডিও ক্লিপটি ‘বানোয়াট’।

ওই ঘটনার এক সপ্তাহ পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ অভিযোগ করেন, ইমরান ও তার স্ত্রী একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিকে মুদ্রাপাচার মামলা থেকে বাঁচাতে ৫ বিলিয়ন রুপি এবং কয়েকশ কানাল জমি নিয়েছেন। 

ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাহরিয়া টাউন যুক্তরাজ্যে একজন পাকিস্তানি নাগরিকের ব্যাংক হিসাবে অবৈধভাবে ৫০ বিলিয়ন রুপি জমা করেছে। অর্থ জমার ঘটনাটি উদঘাটন করেছে যুক্তরাজ্যের এনসিএ, যারা পরে পিটিআই সরকারকে এ অপরাধের বিষয়টি জানায়।

পাকিস্তানি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো দাবি করেন, ওই সময় প্রধানমন্ত্রী ইমরানের নির্দেশনা পেয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন তার জবাবদিহিতা বিষয়ক কর্মকর্তা শেহজাদ আকবর। যে অর্থ রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় কোষাগারের সম্পত্তি, সেই ৫০ বিলিয়ন রুপির বিষয়টি নিয়ে বাহরিয়া টাউনের সঙ্গে মিটমাট করা হয়। এই ঘটনায় ইমরান ও তার স্ত্রীর জড়িত থাকার অভিযোগ তদন্তে পরদিনই একটি কমিটি করা হয়।

সানাউল্লাহর তথ্য অনুযায়ী, বাহরিয়া টাউন কয়েকশ একর জমি দিয়েছে আল কাদির ট্রাস্টকে। আর এসব চুক্তিতে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অর্থের যোগানদাতা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানের স্ত্রী বুশরার স্বাক্ষর রয়েছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, অলাভজনক এই ট্রাস্টে মাত্র দুইজন ট্রাস্টি, তারা হলেন ইমরান খান এবং তার স্ত্রী বুশরা বিবি। তিনি জানান, আরো ২৪০ কানাল জমি দেওয়া হয়েছে ফারাহ শেহজাদির নামে।

তৎপর এনএবি

রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী মালিক রিয়াজ এবং তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পিটিআই চেয়ারম্যান ইসমরান খানের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আগে পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো (এনএবি) রিয়াজ এবং তার থেকে সুবিধা নেওয়া কয়েকজনকে ১ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়।

এনএবির নোটিস বলা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া এবং যুক্তরাজ্য থেকে অর্থ আনার ক্ষেত্রে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তদন্ত করতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

এনএবির দাবি, পাকিস্তান সরকারের অর্থ ফিরিয়ে আনতে ব্রিটেনের এনসিএর সঙ্গে আদালাতের বাইরে সমঝোতা করেছিলেন আলী রিয়াজ মালিক এবং অন্যরা।

তলবী নোটিসে বলা হয়, মেসার্স বাহরিয়া টাউন আল কাদির ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটির জন্য ঝিলাম জেলার সোহাওয়া তহসিল মৌজা বরকলায় ৪৫৮ একর, ৪ মারলা এবং ৫৮ বর্গফুট জমি দিয়ছে।

এর আগে, এনএবি ইমরান খানের মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্যকেও নোটিস পাঠিয়েছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- গোলাম সারওয়ার খান, মুরাদ সাঈদ, পারভেজ খাত্তাক, শাফকাত মাহমুদ, শিরিন মাজারি, আলী হায়দার জাইদি, হাম্মাদ আজহার এবং জুলফি বুখারি।

গত ২৯ নভেম্বর বুখারিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এনএবি। কয়েক দফা শুনানিতে হাজির হতে ব্যর্থ হওয়ার পর সবশেষ ১০ জানুয়ারি ফের জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হন তিনি। 

ইমরান খান মঙ্গলবার অন্য মামলার শুনানিতে হাই কোর্টে হাজির হলে রেঞ্জার্স সদস্যরা তাকে আটক করে।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ বলেন, আল-কাদির ট্রাস্টের মামলায় ইমরানকে আটক করেছে এনবি। এর বাইরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরো কয়েক ডজন মামলার তদন্ত চলছে।

তিনি দাবি করেন, দুর্নীতি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদে হাজির হতে ইমরানকে কয়েক দফা নোটিস দিয়েছিল এনএবি। যখন থেকে এসব মামলার নথিপত্র ও তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা হয়, তখন থেকেই ইমরান যদি সাড়া দিতেন, তাহলে আরো তদন্তের প্রয়োজন হত না।

“তার উচিত ছিল তলবে হাজির হওয়া এবং সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি হাই কোর্টে ওইসব নোটিস চ্যালেঞ্জ করেন এবং আদালত বলেছে, আইনি কোনো প্রক্রিয়া থেমে থাকবে না। তার উচিত ছিল তদন্তকাজের অংশ হওয়া এবং নিজের মতামত দেওয়া, কিন্তু তার পরিবর্তে তিনি তদন্তের অংশ হওয়ার বিষয়টি অনুধাবনই করতে পারেননি। এ কারণেই এনএবি তাকে গ্রেপ্তার করেছে।” 

Also Read: ইমরান গ্রেপ্তার, পাকিস্তানের সংকটে নতুন মাত্রা

Also Read: ইমরান গ্রেপ্তার: পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সহিংসতা

Also Read: দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার ইমরান, পাকিস্তান জুড়ে চলছে ব্যাপক বিক্ষোভ