কারণ ব্যাখ্যা করতে না পারলেও বিষয়টি যে উদ্বেগের, তা বলছেন বিজ্ঞানীরা
Published : 26 Apr 2023, 01:49 AM
পৃথিবীর সাগরগুলোতে দ্রুত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সতর্ক হয়ে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা। কেন এমনটা ঘটছে, তার কূল-কিনারা না করতে পারলেও তাদের উদ্বেগ, এই প্রবণতা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার আরও বাড়িয়ে দেবে।
এপ্রিলে বিশ্বের সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণ তাপমাত্রা আরেকটি নতুন রেকর্ড গড়েছে। এর আগে কখনও এত দ্রুত, এত বেশি গরম হয়নি সাগরের উপরিভাগ।
বিবিসি জানিয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি কেন এই ধরনের পরিণতি। কিন্তু তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।
সমুদ্রপৃষ্ঠের এই উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে অন্যান্য আবহাওয়া সম্পর্কিত ঘটনাবলী যোগ করে তারা আশঙ্কা করছেন, আগামী বছরের শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি হয়ত উদ্বেগজনক এক উচ্চতায় পৌঁছে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী কয়েক মাসজুড়ে একটি শক্তিশালী এল নিনোর প্রভাব আসতে পারে। এল নিনো হচ্ছে আবহাওয়ার সেই অবস্থা, যাতে বিশ্বের মহাসাগরগুলোতে উষ্ণতা বাড়ে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, উষ্ণতর মহাসাগরগুলোতে জলজ প্রাণীর মৃত্যু বেড়ে যেতে পারে, মহাসাগর বেশি উষ্ণ হয়ে উঠলে তা চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার পরিধি বাড়িয়ে দিতে পারে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে। তাছাড়া উষ্ণতর মহাসাগর পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া গ্রিনহাউজ গ্যাস শোষণেও কম কার্যকর।
গত সপ্তাহে প্রকাশিত একটি নতুন গবেষণাপত্রে আবহাওয়ার এই উদ্বেগজনক প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে পৃথিবীতে যে পরিমাণ তাপ জমা হয়েছে, তা এর আগের ৪৫ বছরের সঞ্চিত তাপের সমপরিমাণ। আর এই অতিরিক্ত শক্তির বেশিরভাগই মহাসাগরগুলোতে যাচ্ছে। এর বাস্তব পরিণতি ভোগ করতে হবে বিশ্ববাসীকে। এটা শুধু এই বছরের এপ্রিলে বিশ্বের মহাসাগরগুলোর তাপমাত্রাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়নি, বরং কিছু অঞ্চলে এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব হবে ব্যাপক।
এ বছরের মার্চে উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে সাগরপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১৯৮১ থেকে ২০১১ সালের গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
গবেষক দল মারক্যাটর ওশেন ইন্টারন্যাশনালের সমুদ্রবিজ্ঞানী ও এই গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক কারিনা ফন শুকমান বলেন, “কেন এই হঠাৎ ও ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে, তার কারণটি এখনও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
“জলবায়ু ব্যবস্থায় আমরা গত ১৫ বছরে তাপমাত্রা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফেলেছি, আমি বলতে চাই না এটা জলবায়ু পরিবর্তন, বা প্রাকৃতিক ঝুঁকি, অথবা দুটোর মিশেল, আমরা এখনও জানি না। কিন্তু আমরা এই পরিবর্তনটি দেখতে পাচ্ছি।”
বিবিসি লিখেছে, আগ্রহের বিষয় হল, মহাসাগরে এই পরিমাণ তাপ বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে, জাহাজ চলাচল থেকে দূষণ কমে যাওয়া।
জাহাজের জ্বালানি থেকে সালফার বা গন্ধকের দূষণ কমাতে ২০২০ সালে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অরগানাইজেশন একটি নিয়ন্ত্রণাদেশ জারি করে। এই সিদ্ধান্তের একটি তাৎক্ষণিক প্রভাব দেখা যায়, অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলে বস্তুকণা ছড়িয়ে পড়া কমে যায়।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এই অ্যারোসল বাতাসকে দূষিত করলেও এটা একইসঙ্গে সূর্য থেকে আসা তাপকে প্রতিফলিত করে তা আবার আকাশের দিকেই ফেরত পাঠাতেও ভূমিকা রেখে আসছিল। এখন বায়ুমণ্ডলে অ্যারোসল কমে যাওয়ায় তাপ সরাসরি পানিতে যাওয়ার সুযোগ বেশি পাচ্ছে।
বিজ্ঞানীদেরকে যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে, তা হলো পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে মহাসাগরগুলোতে একটি নিয়মিত আবহাওয়ার প্রবণতা- এল নিনো।
গত তিন বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে সংঘটিত এই আবহাওয়ার প্রবণতাটি শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় ছিল, যা এল নিনা নামে পরিচিত। এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়া চলার কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল।
পৃথিবীর মহাসাগর অঞ্চলে এল নিনার বিপরীত প্রক্রিয়াই হচ্ছে এল নিনা।
বিজ্ঞানীরা এখন ধারণা করছেন, লা নিনা প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এখন একটি শক্তিশালী এল নিনো প্রক্রিয়া সংঘটিত হতে যাচ্ছে, যা বিশ্বে একটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
ফিরেছে এল নিনো, চলতি বছর রেকর্ড তাপমাত্রার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব
অস্ট্রেলিয়ার আবহাওয়া বুরোর কর্মকর্তা হিউ ম্যাকডয়েল বলেন, “অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরোর মডেল দৃঢ়ভাবেই একটি শক্তিশালী এল নিনোর পূর্বাভাস দিচ্ছে। এবং সাম্প্রতিক প্রবণতাও সেদিকেই নির্দেশ করছে এবং প্রচলিত সবগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মডেলই একটি আরও শক্তিশালী এল নিনো প্রক্রিয়া শুরু হবে বলেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
ম্যাকডয়েল অবশ্য এ ধরনের পূর্বাভাস নিয়ে কিছুটা সতর্কতাও ধরে রেখেছেন। তার মতে, বছরের এই সময়ে এ ধরনের পূর্বাভাস তুলনামূলক কম বিশ্বাসযোগ্য। তবে অন্য গবেষকেরা অবশ্য তার মতো সতর্কতা রাখছেন না, তারা অনেকটাই নিশ্চিত।
এরইমধ্যে পেরু ও ইকুয়েডরের উপকূলীয় অঞ্চলে এল নিনোর প্রভাব শনাক্ত করা হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, একটি পূর্ণাঙ্গ এল নিনো প্রক্রিয়া শুরু হবে যার প্রভাব দেখা যাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রায়।
পোস্টডাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট রিসার্চের গবেষক ড. জোসেফ লুডেশার বলেন, “এই এল নিনোর উপরে যদি আরেকটি আসে, সেক্ষেত্রে আমরা হয়ত অতিরিক্ত ০.২ থেকে ০.২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি দেখতে পাব।”
তিনি বলেন, “সাধারণত এল নিনোর সর্বোচ্চ পর্যায়টি কেটে যাওয়ার কয়েক মাস পর পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি অনেকটা শিথিল হয়ে যায়, আর এ কারণেই আমরা সম্ভবত ২০২৪ সালে আমাদের রেকর্ডে থাকা সবচেয়ে উষ্ণ বছরটি পেতে যাচ্ছি।
“এবং হয়ত আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় (শিল্প বিপ্লব পূর্বকালের চেয়ে) দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি দেখতে পাব এবং হয়ত সাময়িকভাবে তার চেয়ে কিছুটা বেশিও দেখতে পেতে পারি।”
বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বর্তমান ধারা বদলে দিতে পারে এল নিনো। এর প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে যেতে পারে এবং অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলের ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।
কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তা হল যেহেতু বেশি হারে তাপ মহাসাগরে যেতে পারছে, তাই এই জলরাশির অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয়ের সক্ষমতা হয়ত কমে যেতে পারে। আর এ কারণেই উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে যে মহাসাগরে আটকে পড়া তাপ হয়ত সেখানে নাও অবস্থান করতে পারে।
এই প্রতিবেদন তৈরির সময় বিবিসি মন্তব্য জানতে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা এর প্রভাব ও তাৎপর্য নিয়ে এখনই আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একজন তো বলেই ফেলেছেন যে তিনি ‘দারুণ উদ্বিগ্ন ও ভীষণ মানসিক চাপ অনুভব করছেন’।
কারিনা ফন শুকমান অবশ্য এই পরিস্থিতি নিয়েও কিছু আশার বাণী শুনিয়েছেন। তার মতে এল নিনোর প্রভাব কমে গেলে তাপমাত্রাও হয়ত আবার কমে আসবে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমাদের এখনও কিছু সুযোগ আছে যেখানে আমরা কাজ করতে পারি এবং বিরূপ পরিণতি এড়াতে আমাদের এই সুযোগ ব্যবহার করা উচিৎ।”