কেন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামতে চায় ভারত

আগামী দুই বছরে বিভিন্ন দেশের নয়টি চন্দ্রাভিযান মিশন রয়েছে, সবারই নজর পৃথিবীর উপগ্রহটির দক্ষিণ মেরুতে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2023, 08:21 AM
Updated : 23 August 2023, 08:21 AM

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাশিয়ার ‘লুনা ২৫’ নভোযান চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার কয়েকদিন পরই চাঁদের সেই দক্ষিণ মেরুতেই নামতে চলেছে ভারতের মহাকাশ যান চন্দ্রযান-৩।

বুধবারের এ অভিযান সফল হলে চাঁদের ওই অংশে চন্দ্রযান পাঠানো প্রথম কোনো দেশ হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেবে ভারত।

রাশিয়ার ‘লুনা ২৫’ নভোযানেরও চাঁদের এই মেরুতে নামার কথা ছিল। কিন্তু রোববার সেটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

একই সময়ে চন্দ্রাভিযানের লক্ষ্য নিয়ে ভারত ও রাশিয়ার মহাকাশযানের যাত্রাকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটি সামনে আসছিল। চন্দ্রযান দুটির অবতরণের সময়ও ছিল এই সপ্তাহেই।

ফলে সবারই কৌতূহল, চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়েই কেন ভারতসহ অন্য দেশগুলোর আগ্রহ? কেন তারা সেই অঞ্চলে রোবটযান পাঠাতে চাইছে?

Also Read: চাঁদের বুকে ধ্বংস হল রাশিয়ার ‘লুনার ২৫’ নভোযান

Also Read: চন্দ্রযান-৩: চাঁদের বুকে নিরাপদে নামার জায়গা খুঁজছে বিক্রম

Also Read: চাঁদের খুব কাছাকাছি চন্দ্রযান-৩, পরের ধাপেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ

Also Read: চাঁদের ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে ছবি পাঠালো চন্দ্রযান-৩

চন্দ্রযান-৩ এখন চাঁদের আবছায়া ওই অংশে সফট ল্যান্ডিংয়ের চেষ্টা করছে। অবতরণের সময় দুর্ঘটনা এড়াতে উপযুক্ত জায়গা খুঁজছে। কারণ চাঁদের ওই অংশটি ছায়ায় ঢাকা আর খানাখন্দে ভরা। আর এদিক-সেদিক হলেই ভেস্তে যেতে পারে সমস্ত আয়োজন।

ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- ইসরোর প্রাক্তন কর্মকর্তা সুরেশ নায়েক হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, প্রত্যেক মিশনে ইসরো ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে। সুতরাং এবারের চন্দ্রাভিযানের এটি একটি বিষয়। দ্বিতীয়টি হল চাঁদের ওই পর্যাপ্ত পানির উৎস খুঁজে বের করা।

তার মতে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অনেক গভীর বড় বড় গর্তের কারণে সম্পূর্ণ ছায়াযুক্ত এলাকা রয়েছে। সেইসঙ্গে চন্দ্রপৃষ্ঠে ক্রমাগত ধূমকেতু এবং গ্রহাণুর বর্ষণ হচ্ছে। মহাজাগতিক এই বস্তুগুলো যখন চন্দ্রপৃষ্ঠে বিধ্বস্ত হয়, তখন আইস ও ‘মিসিং পার্টিকল’ অপসারিত হয়।

চাঁদের ওই অংশে পানি পাওয়ার আশা রেখে সুরেশ নায়েক বলেন, সেখানে জমাট বাঁধা বরফে প্রচুর পানি থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। আরেকটি কারণ হল এর অনন্য ভূ-গঠন বা বৈশিষ্ট্যের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হতে পারে। একদিকে রয়েছে বিশাল ছায়াময় এলাকা, অন্যদিকে রয়েছে অনেক চূড়া। আর এই চূড়াগুলো সবসময় সূর্যালোকের নিচে থাকে।

“সুতরাং, নিকট ভবিষ্যতে সেখানে মানব বসতি স্থাপন করার জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু সুবিধাজনক স্থান। ২০৩০ সালের মধ্যে সেখানে মানুষের বসতি স্থাপনের কথা ভাবছে চীন। এছাড়া চাঁদে অনেক মূল্যবান খনিজ পাওয়া যায়। এর একটি হল হিলিয়াম-৩, যা আমাদের আমাদের দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ তৈরিতে সাহায্য করতে পারে।”

নায়েক জানান, আগামী দুই বছরে বিভিন্ন দেশের নয়টি চন্দ্রাভিযান মিশন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই দক্ষিণ মেরুতে অভিযানের পরিকল্পনা করেছে। এর আগে ২০১৯ সালে ভারত চন্দ্রযান-২ পাঠিয়ে দক্ষিণে মেরুতে পা ফেলতে ব্যর্থ হয়। এবার সেই ক্ষত সেরে পরিকল্পনা মাফিক আগাচ্ছে চন্দ্রযান-৩ মিশন।

২০১৯ সালের দ্বিতীয় অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।

ইসরো প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমনাথ আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই অভিযানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন তারা।

“আমরা যদি নতুন কিছুর সন্ধান পেতে চাই, তাহলে আমাদের চাঁদের এমন জায়গায় যেতে হবে, যে এলাকা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। চাঁদের দক্ষিণ মেরু আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে। তবে ওই অংশে অবতরণের ঝুঁকিও অনেক বেশি।”

কেন ২৩ অগাস্ট বেছে নেওয়া হল?

আনন্দবাজার জানিয়েছে, চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার পর চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম এবং রোভার প্রজ্ঞান তাদের বাকি অভিযান পরিচালনা করবে। এজন্য ব্যবহার করবে সৌরশক্তি। কিন্তু চাঁদের এক মাস সমান পৃথিবীর ২৮ দিন। এক চান্দ্রমাসে টানা ১৪ দিন রাত আর টানা ১৪ দিন দিনের ভাগ থাকে। ফলে ল্যান্ডার যদি এমন সময়ে অবতরণ করে যখন চাঁদ অন্ধকারে ডুবে থাকে, সেসময় এটি কাজ করবে না। তাই সূর্যের আলো থাকতেই ল্যান্ডার ও রোভার চাঁদের মাটিতে নামাতে চাইছে ইসরো।

সংস্থাটির হিসাবে ২২ অগাস্ট চাঁদের রাতের ভাগ শেষ হচ্ছে। ২৩ অগাস্ট থেকে টানা ১৪ দিন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে দিন থাকবে। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করবে চন্দ্রপৃষ্ঠ। ফলে সৌরশক্তি ব্যবহার করে নিজেদের কাজ চালাবে বিক্রম ও প্রজ্ঞান। পাশাপাশি, ভবিষ্যতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করে রাখবে তারা।

ইসরোর প্রাক্তন পরিচালক প্রমোদ কালের মতে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রা মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। তীব্র শীতে দক্ষিণ মেরুতে চন্দ্রযান চালানো সম্ভব নয়। এ কারণেই চন্দ্রযান অবতরণের জন্য এমন সময় বেছে নেওয়া হয়েছে, যখন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের আলো থাকবে।

কাছাকাছি সময়ে ভারত ও রাশিয়া চাঁদের একই অংশে পা ফেলার চেষ্টা করলেও রাশিয়ার নভোযানটি অবতরণের আগে গতিপথ বদলাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ে। রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা কর্তৃপক্ষ রসকসমস নভোযানটি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার খবর দিয়ে পরে জানায়, ‘অপ্রত্যাশিত কক্ষপথে চলে যাওয়ার পর’ চন্দ্রপৃষ্ঠের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে এটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

১৯৭৬ সালে লুনা ২৪ মিশনের পর রাশিয়া গত প্রায় পাঁচ দশকে আর চন্দ্রাভিযানের উদ্যোগ নেয়নি। দীর্ঘ সময় পর ফের উদ্যোগ নিলেও তা ব্যর্থ হয়। নভোযান ধ্বংস হওয়ার এই ঘটনা রাশিয়ার মহাকাশ প্রকল্পে বড় এক ধাক্কা। কারণ, সোভিয়েত যুগের পর রাশিয়া থেকে পরিচালিত প্রথম চন্দ্রাভিযান ছিল এটি।