ল্যান্ডার বিক্রমের আগামী ২৩ অগাস্ট বুধবার নাগাদ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার কথা।
Published : 21 Aug 2023, 08:35 PM
চাঁদের খুব কাছে পৌঁছে গেছে ভারতের চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার বিক্রম। এখন এটি চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুতে নিরাপদে অবতরণের জায়গা খুঁজছে বলে জানিয়েছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা-ইসরো।
এরইমধ্যে ইসরো থেকে চাঁদের দূরবর্তী অংশের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করা হয়েছে বলে জানায় বিবিসি। ছবিগুলো তুলেছে ল্যান্ডার বিক্রম।
যেটি গত বৃহস্পতিবার চন্দ্রাভিযানের শেষ ধাপের যাত্রা শুরু করে। রোববার সকালে দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত ডি-বুস্টিং অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয় বলেও খবর দিয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
ল্যান্ডার বিক্রমের আগামী ২৩ অগাস্ট বুধবার নাগাদ চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার কথা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পর্বের দিকেই এখন গভীর মনোযোগ ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
বিক্রমের পাঠানো চাঁদের সর্বশেষ ছবি প্রকাশের একদিন আগে রাশিয়ার চন্দ্রযান লুনা-২৫ চাঁদের বুকে আছড়ে পড়ে ধ্বংস হয়ে যায়।
গত জুলাই মাসে কাছাকাছি সময়ে দুই দেশ চন্দ্রাভিযান শুরু করায় এবং দুই দেশই এবার চাঁদের অজানা দক্ষিণ মেরুকে তাদের অভিযানের লক্ষ্যবস্তু করায় কে কার আগে পৌঁছাতে পারে এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। যদিও দুই দেশের মহাকাশ গবেষণা সংস্থাই বলেছে, তাদের মধ্যে কোনো ধরণের প্রতিযোগিতা নেই।
রোববার রাশিয়ার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস থেকে তাদের লুনা-২৫ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার খবর দেওয়া হয়। বলা হয়, আগেরদিন শনিবার থেকে লুনা-২৫ এর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ধ্বংস হওয়ার আগে সেটি চাঁদের কক্ষপথে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
সাবেক সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে রাশিয়া হওয়ার পর এটিই ছিল দেশটির প্রথম চন্দ্রাভিযান। স্বাভাবিকভাবেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর তাদের এই চন্দ্রাভিযান দেশটির জন্য দারুণ মর্যাদার ছিল। লনার-২৫ ধ্বংস হওয়ার মধ্য দিয়ে যে অভিযান ব্যর্থ হলো। ১৯ থেকে ২১ অগাস্টের মধ্যে রুশ নভোযানটির চাঁদের বুকে অবতরণের কথা ছিল।
এদিকে, সোমবার সকালে ইসরোর পক্ষ থেকে বলা হয়, চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার আগামী বুধবার ভারতীয় সময় বিকাল ০৬টা ৪ মিনিটে (জিএমটি ১২:৩৪) চাঁদের ভূমি স্পর্শ করবে।
“যেটি বর্তমানে কোথায় অবতরণ করবে সেই জায়গার মাপজোখ করছে এবং ‘বিপদ শনাক্ত ও তা এড়িয়ে যেতে, ক্যামেরা দিয়ে সেই এলাকার ছবি তুলছে।
“ল্যান্ডার বিক্রমের পাঠানো সাদা-কালো সেইসব ছবি ইসরোর বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন এবং অবতরণের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। যাতে বোল্ডার বা গভীর গর্ত এড়িয়ে যাওয়া যায়।”
বিক্রম যদি ঠিকঠাক অবতরণ করতে পারে তবে ভারতই হবে চাঁদের রহস্যঘেরা দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছানো প্রথম এবং চাঁদের বুকে সফলভাবে নামতে পারা চতুর্থ দেশ। এর আগে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের মহাকাশযান নিরাপদে চাঁদের মাটিতে নামতে পেরেছে।
চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে মানুষের গবেষণা খুব বেশি এগোয়নি। ছায়ায় ঢাকা ওই অঞ্চল চাঁদের উত্তর মেরুর চেয়ে অনেকটা বড়। ধারণা করা হয়, সবসময় অন্ধকারে থাকা ওই অঞ্চলে বরফ বা পানির অস্তিত্ব থাকলেও থাকতে পারে। এই বরফ বা পানি খোঁজাই ভারতের এবারের চন্দ্রাভিযানের মূললক্ষ্য।
যেভাবে শুরু হলো যাত্রা:
গত ১৪ জুলাই দুপুরে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-৩ এর সফল উৎক্ষেপণ করে ইসরো।
চাঁদে পৌঁছানোর চেষ্টায় এর আগে দুটো অভিযান চালিয়েছে ভারত। ২০০৮ সালে প্রথম অভিযানে চন্দ্রযান-১ পৌঁছেছিল চাঁদের কক্ষপথে। চাঁদের ভূপৃষ্ঠের গঠন ও পানির উপস্থিতি নিয়ে বড় পরিসরে গবেষণা চালানো হয় সে সময়। দিনের বেলায় চাঁদে যে একটি বায়ুমণ্ডল সক্রিয় থাকে, ওই গবেষণাতেই তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
২০১৯ সালের দ্বিতীয় অভিযান আংশিকভাবে সফল হয়েছিল। চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার আজও চাঁদের চারপাশ প্রদক্ষিণ করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে। কিন্তু এর ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তের জটিলতায় চাঁদের মাটিতে বিধ্বস্ত হয়।
চন্দ্রযান-৩ এর ওজন ৩ হাজার ৯০০ কেজি, যা বানাতে খরচ হয়েছে ৬.১ বিলিয়ন রুপি (সাড়ে ৭ কোটি ডলার)। এই মহাকাশযানও তৈরি হয়েছে অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার- এই তিনটি অংশ নিয়ে।
ইসরোর প্রতিষ্ঠাতার নামে চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডারের নাম রাখা হয়েছে বিক্রম, যার ওজন প্রায় দেড় হাজার কেজি। ওই বিক্রমই তার পেটের মধ্যে বহন করছে ২৬ কেজি ওজনের রোভার বা রোবটযান প্রজ্ঞানকে।
ল্যান্ডার বিক্রমের অবতরণের সময়টা হতে হবে একেবারে নির্দিষ্ট, চাঁদের কোনো এক দিনের ঠিক সূচনায়। কারণ ল্যান্ডার আর রোভারের ব্যাটারি চার্জ হতে সূর্যালোক দরকার হবে।
বিক্রম ঠিকঠাক চাঁদে নামতে পারলে এর পেট থেকে বেরিয়ে আসবে ছয় চাকার প্রজ্ঞান। চাঁদের পৃষ্ঠে ঘুরে ঘুরে সে পৃথিবীতে পাঠাবে তথ্য আর ছবি। এই রোভার সক্রিয় থাকবে চাঁদের এক দিন, যা পৃথিবীর ১৪ দিনের সমান।
পাঁচ ধরনের যন্ত্র বহন করছে চন্দ্রযানের রোভার। চন্দ্রপৃষ্ঠের গাঠনিক বৈশিষ্ট্য, পৃষ্ঠের কাছাকাছি বায়ুমণ্ডল এবং ভূগর্ভে নিচে কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করবেন বিজ্ঞানীরা।
ইসরো প্রধান শ্রীধরা পানিকার সোমনাথ আশা প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই অভিযানে নতুন কিছু খুঁজে পাবেন তারা।
“আমরা যদি নতুন কিছুর সন্ধান পেতে চাই, তাহলে আমাদের চাঁদের এমন জায়গায় যেতে হবে, যে এলাকা নিয়ে খুব বেশি গবেষণা হয়নি। চাঁদের দক্ষিণ মেরু আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে। তবে ওই অংশে অবতরণের ঝুঁকিও অনেক বেশি।”
তিনি আরো বলেছিলেন, চন্দ্রযান-২ বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় সমস্ত তথ্য তারা সংগ্রহ করেছেন এবং বিশ্লেষণ করেছেন, যাতে আগেরবারের মত জটিলতা এড়ানো যায়।
চন্দ্রপৃষ্ঠের যে জায়গায় চন্দ্রযান-৩ এর ল্যান্ডার নামাতে চাইছে ইসরো, সেই জায়গার অনেক ছবি চন্দ্রযান-২ এর অরবিটার গত কয়েক বছরে পাঠিয়েছে। ফলে সেখানে ঠিক কতগুলো বোল্ডার এবং গর্ত আছে, সে বিষয়ে বেশ ভালো ধারণা পেয়েছেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা।
এখন অপেক্ষা শুধু সেই মহেন্দ্রক্ষণের।