ইউক্রেইন নিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্যে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে ‘নীতিগত’ভাবে রাজি হয়ে কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেকে জয়ী ভাবতে পারেন জো বাইডেন।
Published : 22 Feb 2022, 12:24 AM
তবে তা যে তার জন্যই বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে, তা তুলে এনেছে সিএনএন। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমটির এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ্ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে কিংবা কৌশলগতভাবে বাইডেনের জন্য বুমেরাং হয়ে আসতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কঠিন এক সময়ে রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন, যা অনিশ্চিত, আবার শর্তও যুক্ত করেছেন। আর এমন সময়ে তিনি সিদ্ধান্তটি জানালেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রই দাবি করছে যে ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
স্নায়ুযুদ্ধকালের দুই প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে এক বৈঠকে আনার এই উদ্যোগ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর, তবে তা ফলবে কি না তা এখনও গভীর অনিশ্চয়তায়। কেননা রোববার হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, যদি ইউক্রেইনে আগ্রাসন না ঘটে, তবেই এই বৈঠক হতে পারে।
এই বৈঠক হবে কি না, তা এখন নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন আর রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের আসন্ন বৈঠকের উপর। এই সপ্তাহে এই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বৈঠক হওয়াটাও আবার আরেক শর্তের জালে আটকা। তাহল রুশ সৈন্যরা যেন ইউক্রেইনের দিকে আর না এগোয়।
“ব্লিংকেন ও লাভরভ আবার বসতে পারেন, যদি রুশ সৈন্যরা আর না এগোয়। যদি তা হয়, বৈঠকের সম্ভাবনাও শেষ,” সিএনএনকে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা।
ইউক্রেইন সীমান্তে সাজ সাজ রব চললেও যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ প্রেসিডেন্ট কোথায় বসবেন, কখন বসবেন, তার কিছুই এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
এর মধ্যেই হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জেন সাকি বলে দিয়েছেন, যদি রাশিয়া আগ্রাসনের পথই বেছে নেয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রও তাদের কঠোর পরিণতির দিকে ঠেলে দিতে দেরি করবে না। আর বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনেই হচ্ছে, ইউক্রেইনে দ্রুত আক্রমণ করার সব প্রস্তুতিই চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া।
বাইডেনের সঙ্গে আলাপ সেরে পুতিনকে ম্যাঁক্রোর টেলিফোনের পরপরই দুই প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য বৈঠকটি আলোচনায় আসে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বলে আসছেন, ইউক্রেইনে সময় অভিযানের নির্দেশ পুতিন এরই মধ্যে তার কমান্ডারদের দিয়ে রেখেছেন বলেই তারা গোয়েন্দা সূত্রে খবর পেয়েছেন।
বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান বর্তমান সঙ্কট ভয়াবহ দিকে মোড় নেওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে সোমবারই বলেছেন, আর কয়েকদিনের মধ্যেই ভয়াল আক্রমণ দেখতে হতে পারে।
এনবিসি টিভির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “এর পরিণতি হিসেবে দেখা যাবে ইউক্রেনিয়ান ও রুশদের মৃত্যু, শুধু সামরিক নয়, অসামরিক মানুষদেরও। এছাড়াও আমাদের কাছে এমন গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে এটা দুই পক্ষের প্রচলিত যুদ্ধের মতো হবে না। ইউক্রেইনকে দমনের জন্য রাশিয়ার নৃশংস একটি যুদ্ধ হবে।”
এই ঘটনায় যে পক্ষগুলো জড়িত, সেই রাশিয়া, ইউক্রেইন কিংবা পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চরম আস্থাহীনতা, যা কূটনীতিক পর্যায়ে উত্তেজনা প্রশমনও দূরে সরিয়ে রেখেছে। দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক সম্পর্কও এমন, যাকে সংশয়াচ্ছন্ন, বিদ্বেষমূলক- এমনভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়।
এই পরিস্থিতিতে লাভরভ ও ব্লিংকেনের বৈঠকে যে ফল আসবে, এমন নিশ্চয়তা মেলাই ভার হয়ে পড়েছে।
আবার যদি এমন বৈঠকের ফল হিসেবে ইউক্রেইনকে একটি গণতান্ত্রিক, কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়, তা রুশ প্রেসিডেন্টের জন্য হবে পরাজয়েরই নামান্তর।
ইউক্রেইন সীমান্তে এখন দেড় লাখ রুশ সৈন্য যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন স্থানীয় সংঘাতও বড় হয়ে কূটনৈতিক সমাধানের পথ বন্ধ করে দিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্রদের এমন মনে হতেই পারে যে পুতিন এখন আলোচনা চান এজন্য নয় যে তিনি গাড্ডায় পড়েছেন, বরং আক্রমণের আগে তিনি চাইছেন ওয়াশিংটনকে তার মিত্রদের থেকে আলাদা করতে।
কিন্তু পুতিন যদি আক্রমণের পথ থেকে সরে দাঁড়ান, তবে সেটাও যুক্তরাষ্ট্রের আপাত বিজয় হিসেবেই দেখা হবে।
যুদ্ধটা যে কোনো সময়ই আটকে যেতে পারে, যা বহু মানুষের প্রাণক্ষয়, হাজারো মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার মতো বেদনাদায়ক অধ্যায় দেখা থেকে পরিত্রাণ দেবে।
যে কারণে সবাই চাইবে যুদ্ধটা যেন না হয়। তাই পুতিন ও বাইডেনকে বসাতে চাওয়া ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এক কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি সর্বাত্মক, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে।”
বাইডেনের রাজনৈতিক জুয়া
যদি পুতিনের সঙ্গে বৈঠকটি হয়ও, সেটাও হবে বাইডেনের জন্য বড় একটি জুয়া।
কট্টর রিপাবলিকানরা নিশ্চিতভাবেই তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে এই বলে যে তিনি ইউক্রেইনকে জিম্মি করে স্বার্থ আদায়ের সুযোগ করে দিয়েছেন পুতিনকে।
আবার যদি এই বৈঠক ব্যর্থ হয় এবং যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলেও বিপদ তার জন্য। সেক্ষেত্রে তিনি দুর্বল প্রেসিডেন্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়বেন।
যদি বাইডেন আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ান, আর যুদ্ধ যদি শুরু হয়ে যায়, তাহলেও এই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হবে বাইডেনকে যে কেন তিনি কূটনৈতিক তৎপরতা চালালেন না।
তবে যদি পুতিন পিছু হটেন, আর বৈঠক না হয়, তবে রাজনৈতিকভাবে হালে পানি পেতে পারেন বাইডেন।
ব্লিংকেন অবশ্য প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলো ব্যাখ্যা করে আসছেন, যদিও তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন যে যুদ্ধ অত্যাসন্ন।
রোববারই সিএনএনের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, “আমরা বিশ্বাস করি, প্রেসিডেন্ট পুতিন তার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ট্যাংকের চেইন না গড়ায়, বিমান না ওড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা চালাব। আমরা এটাও দেখতে চাইব যাতে কূটনৈতিক তৎপরতায় প্রেসিডেন্ট পুতিনকে থামানো যায়।”
বৈঠকের কথা তুলে বাইডেনের আগ্রহের বিষয়টি প্রকাশ করলেও ‘নীতিগত’ বলার মধ্য দিয়ে সংশয়ের সুরও রেখে দিয়েছে হোয়াইট হাউস। আবার রাশিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের কথাও আছে হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে।
এটা এই ধারণাই দেয় যে হোয়াইট হাউস রাষ্ট্রপতিকে নিজের দেশে রাজনৈতিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে চাইছে।
আবার এই ঝুঁকি নেওয়ার পেছনে ঘরের কারণও আছে। যাকে নিয়ে এত কিছু, সেই ইউক্রেইন ন্যাটো জোটে নেই বলে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সৈন্য পাঠাতে পারবে না। তবুও বাইডেন যুদ্ধ এড়াতে চান এই জন্য যে এতে বিশ্ব বাজারে গ্যাসের দাম আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। আর তা হলে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়লে তা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের ভরাডুবি ঘটাতে পারে।
ওদিকে বাইডেন বৈঠক করলে যুদ্ধ হোক বা না হোক, পুতিনের পাল্লা ভারীই থাকছে। কারণ সোভিয়েত পতনের পর রাশিয়াকে দুর্বল বলেই দেখে আসছিল পশ্চিমারা। সেখানে পুরনো আসন নেওয়ার পথ পাচ্ছেন পুতিন, আর তাকে সেই মঞ্চে বসানোর দায় বাইডেনের উপরই বর্তাবে।
বড় বেশি দূরত্ব
পুতিন আর বাইডেনের বৈঠকটি হলেও তা সফল হবে কি না, তা নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে দুই রাষ্ট্রের বর্তমান দূরত্বের সম্পর্কের কারণে।
ইউক্রেইন ন্যাটো জোটে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা চাইছে রাশিয়া। সেইসঙ্গে বলছে, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়ার মতো দেশগুলোতেও কোনো ন্যাটো সৈন্য বা অস্ত্র রাখা যাবে না।
কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মেনে নেওয়া কঠিন। কারণ তাদের বক্তব্য হচ্ছে, কোন দেশ কী করবে, সেই সিদ্ধান্ত সেই দেশই নেবে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় ন্যাটোর বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের গড়া ওয়ারশ জোটে ছিল পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। ওয়ারশ বিলুপ্তির পর ন্যাটো এখন সেদিকে ঢুকতে চাইছে।
এনিয়ে রাশিয়া অভিযোগ করে এলেও যুক্তরাষ্ট্র তা পাত্তা দেয়নি। আর রাশিয়াকে সোভিয়েত যুগের মতো বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে বসাতে চাওয়া পুতিন কোনো মতেই মানতে চাইছেন না, সোভিয়েত ব্লকের কেউ ন্যাটোতে যাক।
ইউক্রেইন সেই পথে হাঁটতে চাওয়ায় এখনকার এই যুদ্ধ পরিস্থিতি। তবে পুতিন যদি উপলব্ধি করতে পারেন যে ইউক্রেইনে যুদ্ধ শুরু করলে তাকে বিদেশে নানা নিষেধাজ্ঞা আর দেশের ভেতরে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানোর দাম তাকে দিতে হবে, তখন কূটনৈতিক পন্থায় তাকে নিবৃত্ত করতে পারবেন বাইডেন।
পরমাণু অস্ত্র কিংবা প্রচলিত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ, সাইবার জগত নিয়ন্ত্রণ, এমন অনেক বিষয়ে দ্বন্দ্ব দুই পক্ষের মধ্যে রয়েছে। আলোচনার পথটি তৈরি না থাকায় তা ইউক্রেইন সঙ্কটের মধ্যে সেগুলোও আবার ফুটতে শুরু করেছে।
পাশাপাশি তা এটাও স্পষ্ট করছে যে পুতিন-বাইডেনকে এক বৈঠকে দেখার আগ পর্যন্ত কেন অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে, আর কেনইবা বৈঠক হলেও তার সাফল্য নিয়ে সংশয় থেকেই যায়।