ইউক্রেইন সঙ্কটে উত্তেজনার পারদ যখন ক্রমশ চড়ছে, সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত গিয়ে আটকাচ্ছে এক জায়গায়- রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আসলে কী করতে চান।
Published : 19 Feb 2022, 11:13 PM
মস্কোর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের বিশ্বাস, পুতিন মূলত যুক্তিবাদী একজন নেতা। ইউক্রেইন আক্রমণ কত বড় ঝুঁকি তৈরি করবে, সেটা তার ভালোই বোঝার কথা। এরপরও সীমান্তে বিশাল সৈন্যবাহিনী মোতায়েনের একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে, তিনি আসলে ‘বিশ্বাসযোগ্য ধাপ্পা’ দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চান।
তবে কেউ কেউ এমন ধারণার কথাও মাথায় রাখতে চান যে, করোনাভাইরাস মহামারীর এই সময়ে পুতিনের ব্যক্তিত্বের মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আর এই পরিবর্তন তাকে করে তুলেছে অস্থিরমতি, আহত অহমে বেপরোয়া।
সপ্তাহ দুই আগে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সংকট নিয়ে আলোচনার সময় পুতিন ২০ ফুট দীর্ঘ যে টেবিল ব্যবহার করে কোভিড বিধির শারীরিক দূরত্ব তৈরি করেছেন, একে পুরো বিশ্বের সঙ্গে পুতিনের বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হিসেবেই দেখছেন পর্যবেক্ষকরা, যারা তাকে দীর্ঘদিন ধরে দেখছেন।
পুতিন গত দুই বছর ধরে নিজেকে যেভাবে ভাইরাসমুক্ত একটি ‘কোকুনে’ আবদ্ধ করে রেখেছেন, পশ্চিমের আর কোনো নেতাকে ততটা করতে দেখা যায়নি।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেখা গেছে, তিনি একা একটি কক্ষে বসে টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলো করছেন। বিরল দুয়েকটি ঘটনায় মন্ত্রীদের সঙ্গে একই কক্ষে তাকে দেখা গেছে, তবে তারা বসেছেন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। প্রয়োজনে তাদের একজন একজন করে ডেকে নিয়েছেন পুতিন।
একজন নেতার মনের খবর নিয়ে অনুমান করতে গেলে সবসময়ই ভুল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু পুতিনের সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত মুহূর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ইউক্রেইনের বিষয়ে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা অনুমান করতে গিয়ে ধন্দে পড়ে যাচ্ছেন মস্কোর বিশ্লেষকরা। আর এমন ক্ষেত্রে যুক্তির সুতো মিলিয়ে পুতিনের মন বোঝার চেষ্টা করা ছাড়া বিকল্পও তেমন কিছু নেই।
গত কিছুদিনে জনসম্মুখে কেমন দেখা গেছে পুতিনকে? তার মানবাধিকার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী একাতেরিনা শুলম্যান বলেছেন, তার চেহারায় ‘বিরক্তির ছাপ আগ্রহের অভাব আর নতুন কিছু আবিষ্কারে অনীহা’ তিনি দেখতে পেয়েছেন।
“জনসাধারণকে দেখানো হচ্ছে যে, সেই ২০২০ সালের বসন্তে মহামারী শুরুর পর থেকে দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া পুরোপুরি আইসোলেশনে রয়েছেন তিনি।”
বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, এখন ইউক্রেইনে বড় আকারে কোনো অভিযান চালালে তার প্রতিক্রিয়া পুতিনের আগের যে কোনো আগ্রাসনের তুলনায় অনেক বেশি তীব্র হবে। ২০১৪ সালে ক্রেমলিনের চতুর কৌশলে রুশ বাহিনী কোনো গুলি না ছুড়েই ক্রিমিয়া দখলের সুযোগ পেয়েছিল। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে কৃত্রিম বিদ্রোহ আর গোলযোগের সৃষ্টি করে পুতিন দেখাতে চেয়েছেন, এসবের পেছনে মস্কোর কোনো হাত নেই।
মস্কোর ‘হায়ার স্কুল অব ইকোনমিক্সের’ বিশ্ব অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের ডিন আনাস্তাসিয়া লিখাচেভা বলেন, “পুরোদস্তর একটা যুদ্ধ শুরু করার ইচ্ছা পুতিনের আছে বলে মনে হয় না। তার সেরকম কোনো ইচ্ছা হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে বলেও আমার মনে বিশ্বাস হয় না।”
লিখাচেভা বলছেন, পুতিন যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু করেন এবং ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হন, সেটা তার প্রত্যাশার উল্টো ফলই বয়ে আনবে, কারণ তিনি বলে আসছেন, পূর্ব ইউরোপে নেটোর অতিরিক্ত উপস্থিত রশিয়া চায় না।
যুদ্ধ বেঁধে গেলে নেটো মিত্ররা ‘আগের চেয়ে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ’ হবে এবং সম্ভবত রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে শক্তিশালী নতুন সমরসজ্জার ব্যবস্থা করবে বলে লিখাচেভা মনে করেন।
দেশে পুতিন সর্বদাই নিজেকে একজন ধীরস্থির রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেখাতে আগ্রহী। রাশিয়ার টকশো ও পার্লামেন্টে জাতীয়তাবাদী দলগুলো ইউক্রেনের আরও অংশ দখলে নিতে বছরের পর বছর ধরে উসকানি দিয়ে গেছে, তবে পুতিন সেসবে কান দেননি।
পুতিন দেখানে চান, তার উপস্থিতির মানেই হল রাশিয়ার স্থিতিশীলতার নিশ্চিয়তা। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঘটনা ঘটলে, পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হলে, সামাজিক প্রতিবাদ তৈরি হলে, তার সেই ভাবমূর্তি হুমকির মুখে পড়বে। তাছাড়া রাশিয়ার লাখ লাখ নাগরিকের আত্মীয় রয়েছে ইউক্রেইনে।
মস্কোর জরিপ সংস্থা লেভাদা সেন্টারের পরিচালক ডেনিস ভলকভ বলছেন, রুশদের অধিকাংশই ক্রেমলিনের ভাষ্যে বিশ্বাস রাখছেন, তারা মনে করছেন, পশ্চিমারাই আসলে ইউক্রেইন সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে।
রাশিয়া শিগগিরই ইউক্রেইনে হামলা চালাতে পারে বলে যে উদ্বেগের বার্তা ওয়াশিংটন প্রচার করছে, তাতে রুশদের ওই দৃষ্টিভঙ্গি আরও জোরাল হচ্ছে। তাদের মনে হচ্ছে, পশ্চিমারাই চাপ আর উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
ভলকভ বলেন, “পুতিন যদি ২০০৮ সালে জর্জিয়ার বিরুদ্ধে পাঁচ দিনের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের মত সীমিত পরিসরে সামরিক অভিযান চালাতেন, রুশরা একে সমর্থন করবে বলে হয়ত তিনি আশা করতে পারতেন।
“কিন্তু তা যদি একটি দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের রূপ নেয়, তাহলে আমরা এমন একটি পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাব, যে পরিণতি নিয়ে আগেই কিছু বলা অসম্ভব। স্থিতিশীলতা শেষ হয়ে যাবে।”
এই ধরনের একটি যুদ্ধ ডেকে আনা মস্কোর অনেকের কাছে অচিন্তনীয় এবং অযৌক্তিক একটি বিষয়। আর রুশ পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞরা ইউক্রেইন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতিকে পুতিনের লক্ষ্য পূরণের শেষ চেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
প্রতিবেশী দেশগুলো নেটোর সমর্থন পেলে তা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে বলেই পুতিন মনে করেন। আর তিনি চান, পশ্চিমারাও তার দেশের এই উদ্বেগের বিষয়টি মেনে নিক, সেজন্য দীর্ঘ দিন ধরেই তিনি চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
১৯৯০ এর দশকে পশ্চিমারা তখনকার দুর্বল রাশিয়াকে একটি নতুন ইউরোপীয় নীতি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। রাশিয়ার পশ্চিমে ভূ-রাজনৈতিক একটি ‘বাফার জোনের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা’ সেখানে উপেক্ষিত হয়েছিল।
মস্কোর বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষক ফিয়োদর লুকিয়ানভ বলছেন, স্নায়ুযুদ্ধের যে ফলাফল বিশ্ব দেখেছে, তা আংশিকভাবে হলেও ‘সংশোধন করতে’ পশ্চিমাদের বাধ্য করাই এখন পুতিনের লক্ষ্য।
তবে লুকিয়ানভ এখনও বিশ্বাস করেন, বড় ধরনের কোনো অভিযানে হয়ত পুতিন যাবেন না। তার বদলে তিনি হয়ত পশ্চিমাদের কেবল এটাই বিশ্বাস করাতে চান যে, রাশিয়া সত্যিই হামলার জন্য প্রস্তুত।
“আপনি যদি ধাপ্পা দিতে চান, সেটা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। আর ইউক্রেইনের সীমান্তে রাশিয়ার ব্যাপক সমরপ্রস্তুতি সেই কাজটা করছে ২০০%।
একই ধরনের চিন্তা থেকে রাশিয়ার বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিনকে একজন বুদ্ধিমান শয়তানের অতিরঞ্জিত রূপে দেখতে শুরু করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং নেটো সম্প্রসারণ নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে পুতিনের অতীতের আলোচনা যেহেতু ব্যর্থ হয়েছিল, সেহেতু ক্রেমলিন এখন এমন একটি অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যেখানে তার স্বার্থ উপেক্ষা করা পশ্চিমের পক্ষে সম্ভব হবে না।
গবেষণা সংস্থা কার্নেগি মস্কো সেন্টারের প্রধান দিমিত্রি ট্রেনিন বলেন, “পুতিন নিজের একটি নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন অত্যন্ত সফলভাবে, যা তাকে দানব হিসাবে চিত্রিত করছে।”
পুতিন তাকে নিয়ে এই ভীতিকে পুঁজি করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, তিনি একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু করতে প্রস্তুত।
“পরিকল্পনাটা হল, এমনভাবে একটা হুমকি তৈরি করতে হবে যাতে মনে হয়, সত্যি সত্যি একটা যুদ্ধ লেগে যেতে পারে” বলেন ট্রেনিন।
অবশ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা আগেও ভুল হয়েছে অনেক সময়। ২০১৪ সালে মস্কোর খুব কম বিশ্লেষকই রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপের পূর্বাভাস দেখেছিলেন, কিন্তু পুতিন ঠিকই ক্রিমিয়া দখল করে নেন।
সিএনএ এর রাশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক মাইকেল কফম্যান বলেন, “পুতিন গত বছরে বেশ কিছু সীমানা অতিক্রম করে এসেছেন। যারা বিশ্বাস করেন যে নাটকীয় কিছু ঘটা অসম্ভব, তারা গত দুই বছরে পুতিনের সেই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করেননি।”
আরও খবর