ইউক্রেইন সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে মস্কো ইঙ্গিত দিলেও ওই এলাকায় রুশ সৈন্যের উপস্থিতি না কমে বরং বাড়ছে বলে সতর্ক করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
Published : 17 Feb 2022, 02:12 PM
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও এস্তোনিয়া বুধবার এ সতর্কবার্তা দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
উত্তর ইউরোপের দেশ এস্তোনিয়া জানিয়েছে, ইউক্রেইনের ‘মূল ভূখণ্ড’ দখলে সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যে রুশ যুদ্ধবাহিনীগুলো অগ্রসর হচ্ছে।
প্রকাশ্যে দেওয় বিরল এক বিবৃতিতে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধান বলেছেন, ইউক্রেইন সীমান্তের কাছে আরও অনেক সাঁজোয়া যান, হেলিকপ্টার ও ফিল্ড হাসপাতাল দেখা গেছে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউক্রেইন সীমান্তে আরও প্রায় ৭ হাজার রুশ সেনাকে আনা হয়েছে, এর অনেকেই বুধবার এসেছেন- কোনো তথ্যপ্রমাণ না দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ দাবি করেছেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী প্রভাব বিস্তার এবং জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে ঠোকাঠুকি চলায় কয়েক দশকের মধ্যে পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে জটিল সংকটে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব শক্তিগুলো।
রাশিয়ার চাওয়া, তার প্রতিবেশী ইউক্রেইন যেন নেটো জোটে যোগ না দেয়।
আর পশ্চিমা দেশগুলোর ইঙ্গিত, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পদক্ষেপই উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখবে। যে কোনো মুহুর্তে হামলা হতে পারে এই ভাবনা থেকে তারা এরই মধ্যে তাদের নাগরিকদের ইউক্রেইন ছাড়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
রাশিয়া বলেছে, ইউক্রেইন আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
“এটা রাশিয়া বলছে এবং তারপর তারা যা করছে তাতে আমরা এখন পর্যন্ত তাদের কোনো ধরনের সেনা প্রত্যাহার দেখিনি।
“আমরা দেখছি, গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোকে ধারাবাহিকভাবে সীমান্তে নিয়ে আসা হচ্ছে, সীমান্ত থেকে সরানো হচ্ছে না,” এমএসএনবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন।
এস্তোনিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মিক মারান বলেছেন, ইউক্রেইন সীমান্তে ১০টির মতো যুদ্ধ দল এগিয়ে যাচ্ছে বলে তাদের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে; ইউক্রেইন সীমান্তে এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ৭০ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হয়েছে বলেও অনুমান তাদের।
মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে রাশিয়া হামলা চালাতে পারে এবং ‘মূল ভূখণ্ড’ দখলে নিতে পারে, বলেছেন তিনি।
“রাশিয়া যদি ইউক্রেইনে সফল হয় তাহলে তারা সামনের বছরগুলোতে বাল্টিক দেশগুলোর ওপর চাপ বাড়াতে উৎসাহী হতে পারে। যুদ্ধের হুমকিই পুতিনের নীতির মূল হাতিয়ার,” বলেন এস্তোনিয়ার এ কর্মকর্তা।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, তাদের সেনারা ইউক্রেইনের কাছে অবস্থিত দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলীয় সামরিক জেলাগুলোতে মহড়া শেষে ঘাঁটিতে ফিরছে।
আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে পশ্চিম রাশিয়ায় থাকা সেনারাও তাদের স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরবে বলে জোর দিয়ে বলেছেন আয়ারল্যান্ডে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ভিডিওতে ট্যাংক, পদাতিক যুদ্ধযান ও স্ব-চালিত আর্টিলারি ইউনিটগুলো ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ছাড়ছে বলে দাবি করা হয়েছে।
এদিকে নেটোর সামরিক কমান্ডাররা ইউরোপে নতুন যুদ্ধ ইউনিট মোতায়েনের ছক কষছেন; এসব ইউনিটগুলো বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ায় মোতায়েন হতে পারে বলে ধারণা কূটনীতিকদের।
মূল যুদ্ধক্ষেত্রে যদি অতিরিক্ত সেনা পাঠানোর প্রয়োজন হয় তার জন্য সময় বের করতে সাধারণত এ ধরনের ইউনিটগুলো মোতায়েন করা হয়। এ ধরনের বেশ কিছু ইউনিট পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশগুলোতে মোতায়েন করা আছে।
নেটোর বাহিনী মোতায়েনের অংশ হিসেবে ব্রিটেন সামনের দিনগুলোতে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ছোট বাল্টিক দেশ এস্তোনিয়ায় তাদের সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ এবং ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
এদিকে ইউক্রেইনও বেলারুশ সীমান্তে রক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়েছে। বেলারুশ রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র; দেশটিতে এখন যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশ নিতে প্রায় ৯ হাজার রুশ সেনা অবস্থান করছে বলে অনুমান পর্যবেক্ষকদের।
দেশবাসীর মনোবল চাঙা রাখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে বেড়ানো ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও বুধবার জেভেলিন অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইলসহ তার সামরিক বাহিনীর মহড়া পর্যবেক্ষণ করেছেন।
রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চালাতে পারে এ ধারণা থেকে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দিয়ে বুধবার দিনটিকে ছুটির দিনও ঘোষণা করা হয়েছিল।
“আমরা যেভাবে ভালোভাসি, তেমনটা আর কেউ আমাদের দেশকে ভালোবাসবে না। এবং কেবলমাত্র আমরাই ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে পারি,” বলেছেন তিনি।
এদিন রুশ আগ্রাসনের আশঙ্কার বিরুদ্ধে একতা দেখাতে ইউক্রেনীয়রা জাতীয় পতাকা ওড়ায় ও জাতীয় সঙ্গীত গায় বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
দেশটির সরকার এরই মধ্যে তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বড় ধরনের সাইবার হামলা হওয়ার কথাও জানিয়েছে। এই হামলার জন্য মস্কোর দিকেও আঙ্গুল তুলছে তারা। রাশিয়া সাইবার হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা এখনও ইউক্রেইনে সাইবার হামলার জন্য কারা দায়ী তা বের করতে পারেনি, বলেছেন হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি।
পশ্চিমা দেশগুলোর ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, ফেব্রুয়ারির বাকি সময়জুড়েও ইউক্রেইনে রুশ আগ্রাসনের সম্ভাবনা বিদ্যমান।
কোনো ধরনের সতর্ক করা ছাড়াই কিংবা যৎসামান্য সতর্ক করেই রাশিয়া ইউক্রেইনে হামলা চালিয়ে বসতে পারে, বলছেন তারা।
নেটো জানিয়েছে, রাশিয়া যে ইউক্রেইন সীমান্ত থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয়নি, উপগ্রহের ছবির সাহায্যেই তা প্রমাণ করা যেতে পারে।
“আরও সেনা পথে রয়েছে,” বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ।
মস্কোর অভিযোগ, পশ্চিমা দেশগুলো সম্ভাব্য রুশ হামলা নিয়ে একের পর এক সতর্তবার্তা দিয়ে যুদ্ধ নিয়ে ‘হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো অপপ্রচার’ চালাচ্ছে।
ইউক্রেইন নেটোতে যোগ দিলে তা মস্কোর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে বলে মনে করা রাশিয়া বলেছে, পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দিলে রুশ জ্বালানি অন্য বাজারগুলোতে সরবরাহেও প্রস্তুত তারা।
ইউক্রেইনে রাশিয়া আগ্রাসন চালালেই মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা।
রুশ অর্থমন্ত্রী আন্তন সুলিয়ানভ বলেছেন, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা ‘অপ্রীতিকর’ হলেও তার দেশ সব ব্যাংকে জমা ও লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
এসবের পাশাপাশি উত্তেজনা নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও অব্যাহত আছে।
বুধবার বাইডেন ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলাৎজ এক ফোনালাপে ‘আটলান্টিকের এপার-ওপারের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর’ জোর দিয়েছেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
রাশিয়ার পার্লামেন্ট ইউক্রেইনের স্বঘোষিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের স্বীকৃতি দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা নিয়ে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে আলোচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছে ইউক্রেইন।
চলতি সপ্তাহে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কিয়েভ সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে; মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে ব্লিনকেন যাবেন জার্মানিতে।
“কূটনীতির দরজা খোলাই থাকছে,” বলেছেন সাকি।